এই কথাটা শুনেই অনেকে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসবেন। কিন্তু আমার মনে হয়, শুধু আমি না, আমার প্রজন্মের যারা পড়ুয়া ছিলেন, তারা সবাই কোন না কোন সময় হুমায়ূন আহমেদ হতে চেয়েছেন। তার লেখার যাদু সব পাঠককে একজন হুমায়ূন হতে প্রলুব্ধ করে।
একটা সময় ছিল যখন ইমদাদুল হক মিলন হুমায়ূন আহমেদের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। তখন বই কেনার পাশাপাশি বই ভাড়া নিয়ে পড়ার প্রচলন ছিল। আমার বোনেরা গল্পের বই পড়তেন। বইয়ের তালিকায় অনেক বইই ছিল। তবে সবচেয়ে বেশি ছিল দস্যু বনহুর। তারপর মাসুদ রানা। আর ইমদাদুল হক মিলনের বই। প্রতি বইয়ের ভাড়া দুই টাকা। এক সপ্তাহ রাখা যেত। আমার শৈশব ভরে ছিল এই সব বই পড়ার অভ্যাস।
সেই সময়ে হুমায়ূন আহমেদের নাটক 'এই সব দিন রাত্রি' জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। মঙ্গলবার রাত আটটার সংবাদের পর সবাই টিভির সামনে বসে পড়ে। আর যখন 'কোথাও কেউ নেই' প্রচার হতে শুরু করল, তখন পথঘাট খালি হয়ে যেত। মনে হত শহরে কার্ফু দিয়েছে।
কলেজে পড়ার সময়ে লেখক হওয়ার বাতিক ছিল বলে বিভিন্ন সাহিত্য সভায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে। প্রায় সব সাহিত্য সভায় হুমায়ূন আহমেদের লেখাকে সস্তা ও ফালতু বলে অভিমত দিতেন সভায় উপস্থিত তথাকথিত লেখকবৃন্দ। আমি বয়সে ছোট ও অনভিজ্ঞ বলে তাদের এই সব কথার প্রতিবাদ করতে পারতাম না। আবার কখনও কখনও ভাবতাম, আমি হয়তো পাঠক হিসেবে খুবই সস্তা বলে হুমায়ূন আহমেদকে পছন্দ করি। এখন ভাবতে ভালো লাগে, সেই সব পণ্ডিত লেখকরা কালের আবর্তে হারিয়ে গেছেন, কিন্তু সেই 'সস্তা' হুমায়ূন আহমেরদ আজও পাঠকের মনে বেঁচে আছেন।
নিজে খুব বেশি লিখতে পারি নি। অল্প কিছু গল্প ও 'নাটকের মেয়ে' নামে একটা অতি সস্তা প্রকাশিত উপন্যাস দিয়ে আমার লেখালেখি শেষ। কিন্তু খেয়াল করেছি, আমার সমস্ত লেখায় হুমায়ূন আহমেদের মারাত্মক প্রভাব আছে। বলা যায়, নিজের অজান্তেই তাকে গুরু মেনে বসে আছি।
এখন বুঝি, লেখক হতে হলে অন্য লেখকের প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। লিখতে হয় নিজের মতো করে। নিজের অলসতার কারণে সেই নিজের মতো করে আর লেখা হল না। আর কোন দিন হবে কি না জানি না।
তবে একটা জিনিস খুব ভালো লাগে। সেই 'সস্তা' হুমায়ূন আহমেদ এখন আর 'সস্তা' নন। তিনি এখন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম স্মরণযোগ্য লেখক।
আমাদের দেশে বেঁচে থাকাকালীন মেধাবীদের অপমান অপদস্ত করা হয়। এই অপমান অপদস্ত হজম করে যারা কাজ করে যেতে থাকেন, তারাই এক সময় সফল হন। সবার এই রকম মনের জোর থাকে না। তবে একটা কথা সত্য, যেই মেধাকে আমরা তার জীবিত থাকার সময়ে সম্মান করি নাই, মরার পর তাকে মহান বানানোর জন্য আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে কত রগড় করি।
হুমায়ূন আহমেদ হচ্ছেন সেই বিরল প্রতিভা, যিনি তার জীবদ্দশায় সম্মান ও ভালোবাসা পেয়ে গেছেন।
আজ তার ৭০তম জন্মদিন। ভালোবাসা, প্রিয় লেখক।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৪:০৯