somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সিআরএসি আন্তর্জাতিক আর্টক্যাম্প: সাঙ্গ হলো মেলা

১৫ ই জানুয়ারি, ২০১১ রাত ৯:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




জ্ঞানার্জনের বিশাল পরিসর থেকে যখন কেউ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, কিংবা কাউকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই ধ্যান নষ্ট হয়। সংকুচিত ও বিচ্ছিন্ন পরিবেশে আবার তা গড়ে ওঠে হয়ত, কিন্তু তা কখনোই সেই বিশালত্বের সমকক্ষ হতে পারে না কিংবা হতে দেয়া হয় না। তবু কেউ কেউ এমনটাই ভাবে। যেমন মহাভারতের একলব্য। এই উপাখ্যানের সাথে বেশখানিকটা মিল খুঁজে পাওয়া যায় কুষ্টিয়ায় অনুষ্ঠিত হওয়া সিআরএসি আন্তর্জাতিক আর্ট ক্যাম্পটির। আর্ট ক্যাম্প আয়োজনের ঐতিহ্যবাহী পথের বাইরে, প্রথাগত কর্মকাণ্ড অনুসরণ না করে, কর্পোরেট স্পন্সরের অনুকম্পার তোয়াক্কা না করে শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা আর শিল্পভাবনা প্রকাশের নতুন পথ সন্ধানের সাধনা এই আর্ট ক্যাম্প আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য। চতুর্থবারের সফল আয়োজন দেখে প্রথমে তাই একলব্যের কথা মনে পড়ে। দ্রোনাচার্যের প্রত্যাখ্যানের পর নিজ অধ্যাবসয়ের ধারাপাতে সফল তীরন্দাজের কথা স্মরণ হওয়ার আরো নানা কারণ আছে।

শুধু চারুশিল্পীদের জন্য নয়, ২০০৭ সালের প্রথম আয়োজনের সময় থেকে আর্টক্যাম্পটি উন্মুক্ত করে দেয়া হয় শিল্প ও সংস্কৃতির সকল শাখায় বিচরণকারীদের জন্য। আর্টক্যাম্প আয়োজনের সনাতনী প্রথা ভেঙ্গে এর অন্দরমহলে কণ্ঠশিল্পী, গবেষক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকর্মী, ফটোগ্রাফার, কবি, বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ধর্মীয় সমপ্রদায়ের মানুষসহ শিল্পের বিভিন্ন শাখায় বিচরণকারী মানুষজনের অংশগ্রহণের পথ খুলে দেয়া হয়। এর ফলে বছর শেষের সাতদিন আর নতুন বছরের প্রথম দিনটি পরিণত হয়ে ওঠে শিল্প ও সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখার মানুষদের নানাধরনের চিন্তা ও ভাব প্রকাশের এক বর্ণিল সমাবেশে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সবদেশেই আর্টক্যাম্পের আয়োজন চোখে পড়ে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, চারুশিল্প ও অন্যান্য শিল্পকলার সমন্বয়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এধরণের ক্যাম্প আয়োজনের নজির নেই। পৃথিবীর অন্যকোন দেশে হয় কিনা তার সংবাদ আমাদের জানা নেই। একটি বিষয় উল্লেখ্য করা প্রয়োজন- শিল্প ও সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে আছে মানুষ আর মানুষের সাথে জড়িয়ে আছে তার জীবনযাপন প্রক্রিয়া। একারণে এই আর্ট ক্যাম্পটিতে দেখা যায় নানা ধরণের বৈচিত্রময় শিল্পানুষঙ্গের প্রদর্শনী। এখানে অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা নিজেদের প্রোজেক্ট নির্মাণ করার জন্য যেমন ব্যবহার করে শব্দ সম্পাদনার আধুনিক প্রযুক্তি, তেমনি শিল্প নির্মাণের জন্য ব্যবহার করে ক্যাম্পের চারদিকে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন উপকরণ। একদিকে যেমন দেখা যায় প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীদের গতবাঁধা ফর্ম থেকে বেড়িয়ে এসে কাজ করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা, অন্য দিকে দেখা যায় অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীর নিজস্ব ফর্মের কাজ কিংবা একজন স্বভাব শিল্পীর স্থানীয় উপকরণে তৈরি সাদামাটা ইনস্টলেশন আর্টও। প্রাতিষ্ঠানিক- অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীদের সাথে চারুশিল্পের জগত থেকে বহুদূরের, ভিন্ন জগতের বাসিন্দা কণ্ঠশিল্পী, কবি, ফটোগ্রাফার কিংবা থিয়েটার এক্টিভিস্টদের অথবা অশিল্পীদের বিভিন্ন শিল্পকর্ম একই সারিতে প্রদর্শীত হয় এখানে আর্টক্যাম্পের চিরায়ত ঢং ভেঙ্গে। ফলে অংশগ্রহণকারী সবাই নিজেদের বিভিন্ন শিল্পানুষঙ্গের সাথে এবং পুরো আয়োজনটির সাথে একাত্মতাবোধ করে এবং বিলীন হয়ে যায় সৃষ্টির আনন্দে।

সিআরএসি আয়োজিত এই বহুমাত্রিক আর্টক্যাম্পটি এবার চার বছরে পদার্পন করলো। ২০০৭ সালে এটি যাত্রা শুরু করে দুজন শিল্পীর হাত ধরে। একজন শাওন আকন্দ, অন্যজন দেলোয়ার হোসেন। এর পরে ২০০৯ সালে ঢাকাস্থ শিল্প ও সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র (সিআরএসি) এই আয়োজনটির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে এটিকে আন্তর্জাতিক রূপ প্রদান করে। প্রতিবছর ২৫ ডিসেম্বর থেকে ১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হচ্ছে আর্টক্যাম্পটি। প্রথম আয়োজনটিও ছিলো বিভিন্ন কারণে সার্থক। সেবছর শিল্পী দেলোয়ার হোসেন দীর্ঘ প্রায় তিন দশকের নিরবতা ভেঙ্গে সরব হন ছবি আঁকার জগতে। সে ধারা এখনো অব্যহত রেখেছেন তিনি। ২০১০ সালের আয়োজনটিতেও দেখা গেছে তাঁর কাজ। এবছর ভারত এবং বাংলাদেশের প্রায় ২৯ জন শিল্পী অংশগ্রহণ করেছিলেন আর্টক্যাম্পে। এরা হলেন বাংলাদেশের পলাশ চৌধুরী, অনন্ত কুমার দাস, সঞ্জয় চক্রবর্তী, অসীম হালদার সাগর, পলাশ ভট্টাচার্য, সুমনা আখতার সুমা, তানজিনা খানম, ওয়াহিদুজ্জামান, কনক আদিত্য, আব্দুস সালাম, আ.ছা.ই.ম. সায়েম হোসেন, আসিফ-উজ-জামান, আবু নাসের রবি, শেখ সাব্বির আলম, আসিফ, আসিফ, রাহুল আনন্দ, শাওন আকন্দ, মাকসুদা স্বপ্না, দেলোয়ার হোসেন, তানজিম আহমেদ বিজয়, সুমনা আকতার সুমা, সবুজ সিদ্দিকী এবং পশ্চিমবঙ্গের মানস আচার্য্য, সৈয়দ তৌফিক রিয়াজ, শ্রাবণী কর, সন্দীপ সামাদ্দার (পান্টু), কমল কুমারী।

সিআরএসি আর্ট ক্যাম্পের চতুর্থ আয়োজনের উন্মুক্ত প্রদর্শনীতে প্রায় ২০টি বিভিন্ন মাধ্যমের করা শিল্পকর্ম প্রদর্শন করা হয়। এর মধ্যে বেশিরভাগ শিল্পকর্ম ছিলো সাইট স্পেসিফিক ইনস্টলেশন। কিছু পারফর্মিং আর্ট আর কিছু অডিও-ভিডিও প্রজেক্ট। সাইট স্পেসিফিক ইনস্টলেশনগুলোর মধ্যে ছিলো পলাশ চৌধুরী ও অনন্ত কুমার দাসের করা স্ব-শরিক, সঞ্জয় চক্রবর্তীর করা স্মৃতি ও সংস্কৃতি, প্রকৃতি আর আমি, অসীম হালদার সাগর এর করা বিলুপ্ত প্রজাতি, পলাশ ভট্টাচার্যের পাখির জন্যই, ওয়াহিদুজ্জামানের কথোপকথন, মানস আচার্য্য ও সৈয়দ তৌফিক রিয়াজের আমার লালন, আব্দুস সালামের শূন্যের মাজার, আ.ছা.ই.ম. সায়েম হোসেনের একটি তুচ্ছ চিন্তার পরিণতি এবং অতঃপর..., আসিফ-উজ-জামানের আশ্রয়, আবুনাসের রবির শিরোনামহীন। ভিডিও মাধ্যমের কাজ ছিলো অসীম হালদার সাগরের পারাপার, রাহুল আনন্দের এ্যবিউজ, ইনভিজিবল লাইন, ইনার আই, লাইট এন্ড সাউন্ড প্রজেক্টের মধ্যে ছিলো রাহুল আনন্দের ক্যান্ডল ইন দ্য উইন্ড টু ডিয়ার ফাদার, সাউন্ড মাধ্যমের একমাত্র প্রজেক্টটি ছিলো কনক আদিত্যের একবার আপনারে চিনতে পারলে রে। ইনস্টলেশন ছিলো অসীম হালদার সাগরের আরবান সিটি, তানজিনা খানমের আপনা মাংসে হরিণা বৈরী, সুমনা আখতার সুমার সম্পর্ক, দেলোয়ার হোসেনের লাল সবুজ। প্লাস্টার অব প্যারিস মাধ্যমের একমাত্র কাজটি ছিলো শেখ সাব্বির আলমের অদৃশ্য শিরোনামের। এছাড়া ছিলো অসীম হালদার সাগর, রাহুল আনন্দ, আবুনাসের রবি, কনক আদিত্য, সন্দীপ সামাদ্দার পান্টু, মানস আচার্য্যর পারফর্মিং আর্ট। এই পারফর্মিং আর্টগুলো কখনো কখনো একক, আবার কখনো কখনো শিল্পীদের যৌথ প্রচেষ্টায় সম্পন্ন হয়। এছাড়াও প্রতিসন্ধ্যায় ছিলো স্থানীয় বাউল শিল্পীদের পরিবেশনা।

মূলত মানুষ, তার সমাজ জীবন, শিল্প-সংস্কৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গ ছিলো শিল্পীদের কাজের প্রতিপাদ্য বিষয়। প্রদর্শনীর প্রায় সকল মাধ্যমের কাজে মানুষ, মানুষের যাপিত জীবনের নানারকম শোষন-বঞ্চনার কথা এসেছে। এসেছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ভয়াবহতার কথা, মানুষের বিচ্ছিন্নতাবোধের কথা, প্রকৃতি আর মানুষের স্বাভাবিক সম্পর্কের কথা। এসেছে নানবিধ মানবিক সংকটের কথা। শৈশব-কৈশোরের হারিয়ে যাওয়া রঙিন দিনের কথাও এসেছে শিল্পীদের কাজে। কসমোপলিটন জীবনের বাইরে মফস্বলের শান্ত প্রকৃতির সান্নিধ্যে এসে শিল্পীরা তাদের কল্পনার ঝাঁপি খুলে দেবেন এটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা। হয়েছেও তাই। মেট্রপলিটন জীবনের বাইরে এসে শিল্পীরা তাদের জীবন, সমাজ, সংস্কৃতিকে দেখেছেন উপর থেকে, পাখির দৃষ্টিতে। ফলে নানা ধরণের জটিল এবং মানবিক বিষয় ধরা পড়েছে তাদের কাজে। মানুষে মানুষে সম্মিলনের এই মেলায় সেতু হিসেবে কাজ করেছে বাউল দর্শন প্রভাবিত কুষ্টিয়া অঞ্চলের মানুষের স্বাভাবিক আতিথেয়তা।

ঢাকাস্থ শিল্প ও সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রের (সিআরএসি) এই আয়োজন, শিল্প ও সংস্কৃতির বিভিন্ন অঙ্গনে বিচরণকারী মানুষজনের সাথে সাধারণ মানুষের আনন্দের প্রবহমানতাকে একসূত্রে বেঁধে দেয়ার এই আয়োজন আরো বর্ণিল ও গভীরতা লাভ করবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

প্রথম প্রকাশ
শিলালিপি
কালের কণ্ঠ
১৪ জানুয়ারি ২০১১/শুক্রবার





০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মব রাজ্যে উত্তেজনা: হাদির মৃত্যুতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪২

রোম যখন পুড়ছিল নিরো নাকি তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল; গতরাতের ঘটনায় ইউনুস কে কি বাংলার নিরো বলা যায়?



বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদটি সবসময় ছিল চ্যালেঞ্জিং।‌ "আল্লাহর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×