somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডিজিটাল মহেশ : একটি বলদের আত্মকাহিনী

১০ ই অক্টোবর, ২০১২ রাত ১১:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গ্রামের নাম বলদবান্ধা। ইহা একটি ডিজিটাল গ্রাম। গ্রামটি ছোট, তাই গ্রামের চেয়ারম্যানও খাটো। দেখিতে খাটো হইলে কি হইবে, লম্বা লাঠি লইয়া তিনি এবং তাহার চামচাগুলা সর্বক্ষণ গরু-ছাগল পিটাইয়া বেড়ায়। তাহার দাপটে গ্রামের কোন গরু হাম্বা শব্দটিও করিতে পারে না- এমনই প্রতাপ!

ডিজিটাল গ্রামে সর্বত্রই ডিজিটালের ছোয়া, এখানকার মানুষও ডিজিটাল, গরু-ছাগলও ডিজিটাল। ডিজিটালের ছোয়ায় আজ সর্বত্র মুঠোফোনের ছড়াছড়ি। তবে গরমকালে বিদ্যুতের বড়ই আকাল তৈরি হয়। গ্রামশুদ্ধ মুঠোফোন চার্জ করিতেই সমস্ত বিদ্যুৎ ফুরাইয়া যায়। তবে বাতাসটেলের ভালোবাসায়, মুঠোফোনের জালে বন্দি হইয়া গ্রামবাসী ভালোবাসার বাতাসেই পরাণ জুড়াইয়া লয়। পুরোদিনের বিদ্যুতের অভাব মিটাইতে হইলে একখানা উলালা কিংবা ছাম্যাক ছ্যাল্লো বাতাসটেলে শুনিলেই অভাগাগুলার আফসোস বলিতে কিছু থাকে না বৈকি। কথায় বলিয়া যায়," ভালোবাসার টানে, বুদ্ধিমানে বলদ বনে!"


পথের সীমানায় রিক্সাচালক গফুরের বাড়ি। গফুর এক মাস শহরে যাইয়া রিক্সা চালায় আর পরের মাস গ্রামে ফিরিয়া আয়েশ করে। গরীবের ঘোড়ারোগ প্রবাদখানা এইখানে অন্তত টিকিবে না। কারণ, গফুরের ঘোড়ায় চড়ার শখ নাই তথাপি তাহার একখানা বলদও রইয়াছে। যদিও বলদখানা অন্তঃসারশূণ্য, তাহাতেও গফুরের কষ্ট নাই। এই বলদ যৌবনকালে বহু গাভীরে সন্তানসম্ভবা করিয়াছে। উক্ত গ্রামের সকল গাভিরই ইহার নিকট একবার হইলেও আসিতে হইয়াছে। জীবনভর সকল বীর্য গাভীতে খরচ করিয়া বৃদ্ধকালে পদার্পন করা অসহায় বলদটিকে তাই গফুর বড় মায়া করে। উপকারী বৃক্ষের যেমন ছাল নেই, তেমনি উপকারী বলদও পুষ্টাভাবে তাহার সকল ছাল-চামড়া খুয়াইয়া বসিয়াছে। ভালোবাসিয়া গফুর বলদের নাম রাখিয়াছে মহেশ। মূর্খ গফুর মহেশ বলিতে বুঝিত, মহা যে ষাড়> মহা+ষাড়> মহেশ! সত্যই মহেশ মহা ষাড়ই ছিল বটে। গলার দড়ি খানা হইতে ছাড়া পাইবা মাত্রই সামনে গরু-ছাগল কাহাকেও মানিত না, উপুর্যপরি ক্রিয়া সম্পাদনে রত হইয়া যাইত। বৃদ্ধ হইয়াও তাহার ভিমরতি ধরিয়াছিল বলিয়া গফুর তাহারে নির্বীয করিয়া আনিয়াছে থানা পশু চিকিৎসালয় হইতে। সেই হইতে ষাড় মহেশ হইয়া গেল বলদ!


চেয়ারম্যানের ছোট পুত্রের জন্মদিন আজ। পুত্রের আবদার বলিয়া কথা! ব্যাটারি চালিত টেলিভিশনে ফ্রুটিকা জুসের বলিহারি সত্য বলিবার বিজ্ঞাপন দেখিয়া পুত্রের সত্য বলিবার বড়ই শখ হইয়াছে। জন্মদিন বলিয়া চেয়ারম্যান, পুত্রের আবদার মিটাইবার নিমিত্তে বাজার হইতে সত্যসুধা ফ্রুটিকা ক্রয় করিয়া বাড়ি ফিরিতেছিল। পথিমধ্যে বাবলা গাছের তলায় কংকালসার মহেশরে দেখিয়া তাহার মন আকুপাকু করিয়া উঠিল। অন্যদিন বলদ দেখিবামাত্রই লাঠির চটা নীতিতে বিশ্বাসী চেয়ারম্যান, ছাল-চামড়াহীন মহেশরে দেখিয়া শুধুমাত্র চোখের পানি ফেলিতেই বাকি রাখিল। এইদিকে গফুর এবং তাহার কন্যা আমিনা মিলিয়া ২০ টাকা খরচ করিয়া ভালোবাসাটেলে উলালা উপভোগ করিতেছিল। চেয়ারম্যান হাক ছাড়িতেই আমিনা বের হইয়া আসিল। আমিনারে দেখিয়াই চেয়ারম্যান কহিল, "এই বলদরে না খাওয়াইয়া মারিয়া ফেলিবি নি? বাপে বেটি মিলিয়া উলালা শুনিয়া কেলাইতেছ, আবার অবলা প্রাণীটার কষ্ট চক্ষুগোচর হয়না? শরীরে নাই চাম আবার তাতে রাধা-কৃষ্ণের নাম!"

আমিনা ডরে ডরে কহিল, "বাপে মোর জ্বরে মরিয়াই যায়, উলালা শুনিতে পাইয়া খানিক প্রাণ পাইছে। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়াই মোদের মহেশের জন্যে খড় ভিক্ষা চাইলাম, তাহাতেও কাহার মায়া হইল না। পাশের বাড়ির সবিতা তো কমেন্টই করিয়া গেল মোদের মহেশ নাকি তাহাদের ঘরে ঢুকিয়া গোবর বিসর্জন দিয়াছিল। যেইখানে আপনার ডরে ছাগল গুলাই ম্যা ম্যা করিতে পারে না সেইখানে মহেশ নাকি ঘর নষ্ট করিবে! মোরা গরীব হই্তে পারি তবে মোদের মহেশ ছেচ্চর নহে!"

এইদিকে চেয়ারম্যানরে দেখিয়া ছুটিয়া আসিতে চাহিল মহেশ। গলায় দড়ি ছিল বলিয়া এই যাত্রায় পারিল না। আমিনা কহিল, "মশাই, আপনার হাতের রংগিন পানি দেখিয়া মোদের মহেশের বড় শখ হইয়াছে! কয়েকফোটা অবলা প্রাণীটারে দিয়া যান না!"


"ঈশ! একে তো ফকিন্নীর ছাও, গলা খেকায় ঘাউ ঘাউ! এই বলদের আবার নামও রাখিছে মহেশ! ছাল-চাম নাই কিছু, নাম তাহার মহাঋষু। এইবার বলদটারে কিছু খাইতে দে। নইলে ইহা মরিলে ঘোর অন্যায় হইবে। বামুণ গ্রামে গরু মারিলে শিকে ভরিব তোদের। যত্তসব কাইলা জিরা, রূপ দেখাও ফিরা ফিরা", চেচাইয়া চেচাইয়া চেয়ারম্যান চলিল বাড়িপানে।

ঘরে ঢুকিয়াই আমিনা মরা কান্না জুড়াইয়া দিল। "দুইদিনের চেয়ারম্যান হইয়া মহেশরে বলদ বলিয়া গেল। ছুচায় যদি আতর মাখে, তাইতে কি আর গন্ধ ঢাকে রে মা! চেয়ারম্যান হইল ফাটা বাশ, গলা ফাটায় ঠাস ঠাস। তুই কাদিস নারে মা, কাল সকালে উঠিয়াই রিক্সা লইয়া ছুটিব", জ্বর গলায় মিন মিন করিয়া বলিল গফুর।

পরদিন অসুখ লইয়াই গফুর রিক্সা নিয়া শহরে ছুটিল। আর আমিনা মহেশের জন্য খড় জুটাইতে বেরুল। এদিকে ক্ষুধার জ্বালায় মহেশ দড়ি ছিড়িয়া পালাইল। যাইবি তো যাইবিই একেবারে চেয়ারম্যানের বাড়ি গিয়াই উপস্থিত হইল। চেয়ারম্যানের ছোটপুত্র ঘরে বসিয়া গলায় ফ্রটিকা ঢালছিল আর টেলিভিশনে মুন্নীর বদনাম হবার কাহিনী চোখে গিলিতেছিল। ঘরের বাহির হইতে ফ্রুটিকা দেখিয়া মহেশ যতনা উজ্জবীত হইল, মুন্নীর বদনাম দেখিয়া ততখানিই উদ্দিপীত হইয়া গেল। নিজেরে নির্বীয জানিয়াও ভিমরতি চাপিল তাহার গোমস্তকে। শিংখানা উচাইয়া তাড়িয়া গেল সোজা টেলিভিশন পানে। পথিমধ্যে চেয়ারম্যানপুত্র মহেশের ক্ষুরের চটা খাইয়া ফ্রুটিকা ফালাইয়া এক দৌড়ে পাগারপার হইয়া গেল। আর মহেশ মুন্নীর বদনাম ঘুচাইতে যাইয়া টেলিভিশনটারে শিং দিয়া গুতাইয়া পিষাইয়া ফালাইল। মুন্নীর আওয়াজ থামিলে মাটিতে পড়িয়া থাকা সত্যবাদী রংগিন পানিখানিও চাটিয়া লইল।

হেন খবর শুনিয়া চেয়ারম্যান তাহার স্বরূপে ফিরিয়া আসিল। খাটো চেয়ারম্যান লম্বা লাঠি রাখিয়া, হাতের নিকট লাংগলের মাথা পাইয়া তাহা দিয়া অবলা মহেশের মাথায় সজোরে আঘাত করিল। বৃদ্ধ মহেশ সেইটা আর সহ্য করিতে পারিল না। সম্মুখ আর পশ্চাতের পাগুলো দিয়া মাটি আছড়াইয়া মরিয়া গেল।

রাত্রিতে ফিরিয়া মৃত মহেশরে দেখিয়া গফুর চোখের পানি ধরিয়া রাখিতে পারিল না। হাহাকার করিয়া ঈশ্বরের নিকট আর্জি করিতে লাগিল,"শকুনগুলার দোয়াতেও গরুটারে মারিলে না আর চেয়ারম্যানের হাতে ছাড়িয়া দিলে? এই মহেশ মোরে যৌবনকালে জমিতে চাষ দিয়াছে, সার দিয়াছে, সারা গ্রামের গাভীগুলারে সবল সন্তান দিয়াছে! শুধু গোস্তখানাই দেওয়া বাকি রইয়াছে। ভাবিয়াছিলাম ইহারে জবাই করিয়া বাপে-মেয়ে মিলিয়া মাসভর আয়েশ করিয়া উলালা শুনিতাম। আমার মহেশ ফ্রুটিকা খাইয়া মরিয়াছে আর মোরা মরিবার আগে গোস্তও খাইতে পারিলাম না। চেয়ারম্যানের অনেক আছে, ওরা দিল না। তোমার সকল মাঠ-ঘাট, সেও দিলে না। এই কসুর মাফ করিব না বলে দিলাম।"

বি:দ্র: শরৎভক্তগণরে অতিশয় দুঃখিত না হইতে অনুরোধ করা হইল। ইহা বরাবরের মত নিতান্তই একখান রিমিক্স রম্য। সুতরাং মনে দুঃখ লইলেও তাহাতে লেখকের দায়ভার থাকিবে না।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ৮:৩২
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×