somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কমনওয়েলথ গেমসের সাতকাহন

১৭ ই অক্টোবর, ২০১০ সকাল ৯:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আতশবাজির ঝলকানি ছিল সামান্যই। বাংলাদেশে এসএ গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হওয়া আতশবাজির দশ ভাগের এক ভাগও নয়। আয়োজকেরা বাজি পুড়িয়ে আর লেজার শোর নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করেননি (কারও মতে অপচয়)। দেশীয় সংস্কৃতি তুলে ধরে এই অনুষ্ঠানকে আকর্ষণীয় করেছেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরই দিল্লি কমনওয়েলথ গেমস সব নেতিবাচক প্রচারণা পেছনে ফেলে দেয়। পরদিন সবার মুখেই ছিল ওই অনুষ্ঠানের প্রশংসা। এরপর গেমস চলেছে নিজম্ব গতিতে। বিশাল নেহরু স্টেডিয়ামে তিন ঘণ্টার অনুষ্ঠানটা স্মৃতির সংগ্রহশালায় রেখে দেওয়ার মতোই। ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, কংগ্রেসের সভানেত্রীসহ বিরোধী দলের নেতারাও ছিলেন। দেশীয় কোনো আয়োজনে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদেরা থাকেন দুই মেরুতে। এখানে দেখা গেল, দেশের স্বার্থে সবাই এক।

দুই
গেমস দেখতে সাধারণ্যের কাতারে মিলে গেলেন নেহরু পরিবারের সদস্যরা! মাঠে বসে খোদ সোনিয়া গান্ধী খেলা দেখেছেন। ভারতের তেরঙা পতাকা উড়িয়েছেন। রাহুল গান্ধী, দুই সন্তানসহ প্রিয়াঙ্কা গান্ধী নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেদ করে সাধারণ গ্যালারিতে বসে যেভাবে খেলা দেখেছেন, একটা কথাই বারবার মনে হয়েছে, আমাদের নেতা-নেত্রীরা কিংবা তাঁদের সন্তানেরা কোনো দিন কি এভাবে নিজেদের সাধারণ ভাবতে পারবেন!
ভারতীয় রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি নিয়ে বহু কাহিনি আছে। কিন্তু ওভারব্রিজময় এই শহরে এসে মনে হলো, ভারতীয় রাজনীতিবিদেরা শুধু পকেট ভারী করেন না, দেশের উন্নয়নেও কাজ করেন!

তিন
‘এটা নেই’, ‘ওটা নেই’—এমন অভিযোগ গেমসে ওঠাটাই হতো স্বাভাবিক ব্যাপার। ১৯৮২ সালের এশিয়ান গেমসের পর এই প্রথম এত বড় একটি আয়োজন করেছে ভারত। তাদের হাত বলতে গেলে কাঁচাই ছিল। কিন্তু আয়োজন দেখে মনে হলো না, ভারত এত দিন পর এমন ক্রীড়াযজ্ঞের আয়োজন করেছে। আধুনিক ভেন্যু, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা—সবকিছুই সর্বোচ্চ মানের।
নিজের চোখে তো নয়ই, জানা মতে, বলার মতো কোনো অভিযোগ শোনাও যায়নি। প্রয়োজন মেটাতে এবং তথ্য দিতে কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন সদা প্রস্তুত। এঁরাই আসলে কোনো সমস্যা হতে দেননি।
গেমস আয়োজনের গোটা পদ্ধতিটাই ছিল কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত। ভারত তথ্যপ্রযুক্তিতে খুব ভালো করছে বলে এত দিন জানা ছিল। কতটা উন্নতি করেছে, চোখে না দেখলে পুরো বোঝা যাবে না। নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল কঠোর। অন্তত গোটা তিনেক স্তর পেরিয়ে তবেই গন্তব্য। এতে কখনো কখনো বিরক্ত হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আয়োজকেরা সবাইকে নিরাপদ রাখার জন্যই এটা করেছেন। কাজেই অভিযোগ করার কিছু নেই। বাংলাদেশের শ্যুটিং দেখতে চার দিন যেতে হলো মিডিয়া সেন্টার থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে কারনি সিং শ্যুটিং রেঞ্জে। ওখানে ল্যাপটপ খুলে অন করে চালিয়ে দেখিয়ে তবেই ভেতরে ঢুকতে হয়েছে। বুঝুন, নিরাপত্তাব্যবস্থা কেমন ছিল!

চার
মিডিয়ার যখন যা প্রয়োজন, সবই ছিল হাতের কাছে। খেলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফল সরবরাহ। প্রধান মিডিয়া সেন্টারে প্রায় ৭০-৮০টি বড় টিভি ছিল, বড় পর্দার বেশ কয়েকটি। অন্তত ৮-১০টি খেলা একই সঙ্গে একই পর্দায় সরাসরি সম্প্রচার করায় এক জায়গায় বসেই প্রায় সব খেলা দেখার সুযোগ ছিল। বিশাল সংবাদ সম্মেলনকক্ষে কখন কার সংবাদ সম্মেলন, সময়মতো জানিয়ে দেওয়া হতো। প্রধান মিডিয়া সেন্টারটি আমাদের পল্টন ময়দানের সমান। পাঁচ শতাধিক বিদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে বসে কাজ করার অভিজ্ঞতা অতুলনীয়।
এক পাশে নাইজেরিয়ান সাংবাদিক, আরেক পাশে কেনিয়ান। পাশের জন কোন দেশের হয়তো জানাই নেই। সামনের সারিতে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের মতো শক্তিধর দেশগুলোর মিডিয়াকর্মী। কেউ ফোনে লাইভ দিচ্ছেন, কেউ ল্যাপটপে লিখে চলেছেন অবিরাম। নাইজেরিয়ার এক সাংবাদিককে মনে পড়বে সব সময়। এক পা বিকলাঙ্গ। একটা লাঠিতে ভর দিয়ে চলাফেরা করেন। তার পরও তাঁর মুখে সারাক্ষণ লেগে থাকে হাসি।

পাঁচ
গেমসপল্লিতে দুদিন গিয়েছিলাম। বিশাল এলাকা। একটা নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত সাংবাদিকেরা প্রবেশ করতে পারেন। ওটাকে ইন্টারন্যাশনাল জোন বলে। সেখানে গিয়ে দেখলাম, প্রায় সাত ফুট উঁচু এক মহিলা খেলোয়াড়। দক্ষিণ আফ্রিকার নেটবল খেলোয়াড়টির সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে লিলিপুটই মনে হলো। চেষ্টা করেও কথা বলা গেল না। মুচকি একটা হাসি দিয়েই তিনি ঢুকে গেলেন স্যুভেনির শপে।
অস্ট্রেলিয়া দলের দুই অ্যাথলেটের কথা না বললেই নয়। ২০ কিলোমিটার হাঁটা প্রতিযোগিতায় সোনা জিতেছেন জ্যারেড ট্যালেন্ট। মেয়েদের বিভাগের রুপা ক্লেয়ার ট্যালেন্টের। দুজনের ইভেন্ট শেষ হওয়ার পরদিন স্থানীয় একটা পত্রিকায় ছাপা হওয়া ছবিটায় চোখ আটকে গেল। দুজনে চুমু খাচ্ছেন। এতে অবশ্য আপত্তির কিছু নেই, তাঁরা যে স্বামী-স্ত্রী।

ছয়
কোনো বাধা-বিপত্তি ছাড়াই গেমস কভার করা ভাগ্যই বটে। সবকিছুর আগে মনে পড়ছে, দিল্লি গেমসের পরিবহনব্যবস্থা। সময়মতো গাড়ি পাওয়া গেছে। এক সেকেন্ডও এদিক-ওদিক নয়। একজন সংবাদকর্মী থাকলেও তাঁকে নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছেছে বাস। গেমস মানেই মহাযজ্ঞ, এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এক ভেন্যু থেকে আরেক ভেন্যুতে দ্রুত যাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন আয়োজকেরা। কমনওয়েলথ গেমসের জন্য রাস্তায় আলাদা লেন ছিল, আর এটাই যানজটমুক্ত থেকে নির্বিঘ্নে চলাফেরার আসল রহস্য। গেমসটাকে যানজটমুক্ত রাখার জন্য একটা ধন্যবাদ পেতেই পারেন আয়োজকেরা।

সাত
৭১টি দেশের মধ্যে ১০-১২টি দেশের নামই তো কেউ কখনো শুনেছেন বলে মনে হয় না। নাউরু, মরিশাস, সিচেলেস, আইল অব ম্যান...আরও কত নাম না জানা দেশ! নাউরু নামটা প্রথম শুনলাম ভারোত্তোলন জিমনেসিয়ামে গিয়ে। পুরুষ বিভাগে এক ভারোত্তোলক বেশ ভালো ওজন তুলে ফেলেছেন। মাইকে দেশের নাম বলছে নাউরু। নাউরু আবার কোন দেশ রে ভাই...কৌতূহল মিটল মাইকে পরের ঘোষণায়।
....এখানে উপস্থিত কমনওয়েলথ ভারোত্তোলন ফেডারেশনের সভাপতি। দেখতে ছোটখাটো এই ভদ্রলোক নাউরুর নাগরিক। দাঁড়িয়ে সবাইকে শুভেচ্ছা জানালেন। কমনওয়েলথ গেমস ভারোত্তোলনে নাকি সাতটি সোনা জয় করেছেন তাদের প্রতিযোগীরা। খেলা শেষে হাত মিলিয়ে পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে বললেন, ‘জেন্টলম্যান, এখন নয় পরে।’
সলোমন দ্বীপপুঞ্জের কিছু খেলোয়াড়ের সঙ্গে ওখানেই দেখা। হাসি-আনন্দ করছেন। সময়টা উপভোগই করে গেল এই দেশগুলো। বিশাল এই স্রোতে মেশা যে তাদের কাছে অন্য রকম আনন্দের উপলক্ষ। কমনওয়েলথ গেমসটা এই সব ছোট দেশ সম্পর্কে জানার সুযোগও করে দিয়েছে!


উৎস জানতে ক্লিক করুন
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৩

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো
অজানার পথে আজ হারিয়ে যাব
কতদিন চলে গেছে তুমি আসো নি
হয়ত-বা ভুলে ছিলে, ভালোবাসো নি
কীভাবে এমন করে থাকতে পারো
বলো আমাকে
আমাকে বলো

চলো আজ ফিরে যাই কিশোর বেলায়
আড়িয়াল... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকরি বয়সসীমা ৩৫ বৃদ্ধি কেনো নয়?

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪২



চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি এটা ছাত্র ছাত্রীদের/ চাকরি প্রার্থীদের অধিকার তবুও দেওয়া হচ্ছে না। সরকার ভোটের সময় ঠিকই এই ছাত্র ছাত্রীদের থেকে ভোটের অধিকার নিয়ে সরকার গঠন করে। ছাত্র ছাত্রীদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×