somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রবাসে ভাষার বাঁশে

০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক প্রতিবেশী সেদিন আমাদের এলাকায় একটা নতুন বাংলাদেশী মাংসের দোকানের খোঁজ দিলেন। রাষ্ট্রভাষায় 'বুচার শপ'। সময় করে একদিন গেলাম। প্রবাস জীবনে নতুনত্বের অভাব মেটাতে, মতান্তরে এডভেঞ্চারের জোগান বাড়াতে নতুন 'দেশী' মাংসের দোকানও সই।

সারি সারি তীর্যক কাঁচের দেয়ালের ওপাশে নানা রঙের পশু-পাখীর মাংস, পাশে রক্তের মত লাল অক্ষরে দাম লেখা। আমি সেখানে দাঁড়াতেই দোকানী বলে উঠলেন, 'লে লো ভাইয়া, আজ ল্যাম্ব বহুত ফ্রেশ হ্যায়'।

এডভেঞ্চারই বটে। অথবা শক থেরাপি বলা যায়। বাংলাদেশী দোকানের নাম শুনে অনেকটা পথ মাড়িয়ে এসে এই মধুর সম্বোধন। অবশ্য এখানে হিন্দীভাষীদের সংখ্যাটা অন্যান্য সকল ভাষার অভিবাসীদের সম্মিলিত সংখ্যার চেয়েও বেশী। ফলে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক নয় মোটেই, অন্ততঃ ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোন থেকে। শুধু যে হিন্দীভাষীরাই হিন্দী বলেন, তা নয় - উর্দুভাষীরা বলেন, তামিল-তেলেগু-মালয়লাম-কানাড়াভাষীরা বলেন, গুজরাটী-পাঞ্জাবী-নেপালীভাষীরা বলেন, আর দুই বাংলার বাংলাভাষীরা তো এমনি এমনিই বলেন। এই তল্লাটে দক্ষিন এশিয় প্রবাসীদের লিংগুয়া ফ্রাংকা হলো হিন্দী। এখানে বাংলাভাষীদের সংখ্যা অনেকটা বাংলাদেশে চাকমাভাষীদের সংখ্যার সাথে তুলনীয়। ধরলেই ধর্তব্য, তবে না ধরাটাই কর্তব্য।

আমি হাসিমুখে দোকানীকে পালটা প্রশ্ন করি, রাষ্ট্রভাষায়, 'তুমি কি পাকিস্তানের লোক, পেশোয়ার জালমি'র সাপোর্টার?' ভাবখানা এমন, যেন তার চেহারায় চাঁদ-তারা খোদাই করা আছে। আমার ইংগিতপূর্ণ প্রশ্নে সে সচকিত হয়, অপ্রস্তুতভাবে হাসে। অবশ্য বেশীক্ষণ সময় লাগে না আমাদের বাংলায় অবতীর্ণ হতে। অতঃপর 'দ্যাশের কি অবস্থা আজকাল', 'লইট্যা শুঁটকি নতুন আসছে', ইত্যাদি আলাপে মগ্ন হই আমরা।

ওদিকে আমার ছেলেরা এলাকার আরেক দেশী দোকানের মালিকের নাম দিয়েছে 'বাংলা আংকেল', যেহেতু বাসার বাইরে এই এক জায়গাতেই তারা দু'চার কলম বাংলা বলে। তবে সেই বাংলাটা হয় খিচুড়ী বাংলা - আমি উত্তরবঙ্গীয় টানে আধা-ঢাকাইয়া মেশানো বাংলা চালাই, আর দোকানদার তার ময়মনসিংহের বাংলার সাথে জি-বাংলা মেশায়ে চালায়ে দেন। দুইজনের বুলিতেই প্রচুর রাষ্ট্রভাষার মিশেল, অনেকটা বোম্বের ফিল্মস্টারদের হিংলিশের মত। ছেলেরা পানির মাছ ডাঙ্গায় তুললে যেমন অবস্থা হয়, সেই অবস্থায় পড়ে আমাদের কিম্ভুত ভাষার চাপে। তবে যেহেতু আমি এবং 'বাংলা আংকেল' দু'জনেই ভাষার ক্ষেত্রে 'ফারুকী স্কুল অফ মডার্ণ চলিত ভাষা'র সমর্থক, সেখানে আমার অবাংলাভাষী ছেলেদের এই সামান্য অসুবিধার কথা আমাদের হিসেবের বাইরে থেকে যায়।

এলাকায় একটা নতুন ছেলে এসেছে দেশ থেকে। শুনেছি, সে নৌকায় চেপে এসেছে রোহিঙ্গাদের সাথে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগড় পাডি দিয়ে। ভারতীয়দের মালিকানাধীন কফি-চকোলেটের দোকানে গিয়ে হঠাত আলাপ হলো। দেখলাম, যে ছেলে দেশে হাইস্কুল পাশ করে নি, জীবিকার তাগিদে নানা রকমের শ্রমসাধ্য কাজ করেছে এবং করছে, সে এখানে এসে কাজ পেয়েছে তার হিন্দী ভাষার উপরে দখলের কারণে। ভাষার এমনই তাকত।

প্রবাসে ভাষার বাঁশে ভালই আছি। তবে চান্স পেলেই ভারতীয় সেই কফির দোকানে ঢুঁ মারি - অনেকটা ফেসবুকের কোন ইভেন্টে চেক-ইন দেওয়ার মত। আজাইড়া। সেই দেশী ছেলেটির সাথে দেখা হলে বলি, ভাইজান, কফিতে ঠিকমত চিনি দিতেছেন তো? না হলে মিষ্টি হবে ক্যামনে? সে বলে, ভাই আপনে মাঝে মইধ্যে আইসা আমারে একটু চিনি মিশাইয়া দিয়া যাইয়েন। এইখানে সব ইন্ডিয়ান কাস্টমার, হিন্দী বলতে বলতে বাংলা ভুইলা যাইতেছি।

আমি মনে মনে বলি, বাংলা ভুলবেন, সে কি এত সহজ কথা নাকি? বললেই হলো? বিদেশে থাকেন আর স্বর্গ-নরকে যান, সেটি আর হচ্ছে না। জন্ম যদি তব বঙ্গে, তবে বাংলাভাষা হলো আপনার 'হোটেল ক্যালিফোর্নিয়া'। You can check-out any time you like, But you can never leave.
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:৪৭
৭টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেসবুক বিপ্লবে সেভেন সিস্টার্স দখল—গুগল ম্যাপ আপডেট বাকি

লিখেছেন মহিউদ্দিন হায়দার, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৩০




কিছু তথাকথিত “বাংলাদেশি বিপ্লবী” নাকি ঘোষণা দিয়েছে—ভারতের সেভেন সিস্টার্স বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে! সহযোগী হিসেবে থাকবে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী আর পাকিস্তানি স্বপ্ন।শুনে মনে হয়—ট্যাংক আসবে ইনবক্সে। ড্রোন নামবে লাইভ কমেন্টে। আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গু এনালিস্ট কাম ইন্টারন্যাশনাল সাংবাদিক জুলকার নায়েরের মাস্টারক্লাস অবজারবেশন !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২৬

বাংলাদেশের দক্ষিণপন্থীদের দম আছে বলতে হয়! নির্বাচন ঠেকানোর প্রকল্পের গতি কিছুটা পিছিয়ে পড়তেই নতুন টার্গেট শনাক্ত করতে দেরি করেনি তারা। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ ঘিরে নতুন কর্মসূচি সাজাতে শুরু করেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদ: দিল্লির ছায়া থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৫:৫৭

একটা সত্য আজ স্পষ্ট করে বলা দরকার—
শেখ হাসিনার আর কোনো ক্ষমতা নেই।
বাংলাদেশের মাটিতে সে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত।

কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ হয়নি।

ক্ষমতা হারিয়ে শেখ হাসিনা এখন ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

×