
ডিসেম্বর আসার আগে থেকেই একটা উৎসব উৎসব আমেজ কাজ করতো। ১৬ ডিসেম্বরকে ঘিরে চলতো কুচকাওয়াজ আর ডিসপ্লেতে (সাংস্কৃতিক কোরিওগ্রাফি) অংশগ্রহণের মহড়া। সেই সাথে লাল সবুজ পতাকায় ঘরের সাজসজ্জা আর মোবাইলে বাজত দেশাত্মবোধক গানের রিংটোন। লাল-সবুজ রঙ শোভা পেতো পড়নের কাপড়ে, মোবাইল স্ক্রিনে, আর সোশাল মিডিয়ার প্রোফাইল বা কাভার ফটোতে।
মনে পরে “সেনাবাহিনী” লেখা সবুজ বাসে করে স্বপরিবারে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে কুচকাওয়াজ দেখতে যাওয়ার আনন্দঘন মুহূর্তের কথা। যদিও এসব এখন শুধুই স্মৃতি। বিজয় দিবসের উপলব্ধি তখন এসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু যখন বিজয় দিবসের বাস্তবিক প্রেক্ষাপট অনুধাবন করতে শুরু করলাম তখন থেকেই পানসে হতে শুরু করলো বিজয় দিবসের এসব জমকালো মনভোলানো উৎসব।
এখন ১৬ ডিসেম্বর আর আগের মত উৎসবমুখর হয়ে আসে না। লাল সবুজ আর শোভা পায় না পড়নের কাপড়ে, মোবাইলের রিংটোনে, ওয়ালপেপারে, সোশ্যাল মিডিয়ার প্রোফাইল কিংবা কাভারে।
এখনও ১৬ ডিসেম্বর আসে তবে বিজয় উৎসব নিয়ে নয় বরং এক বুক বিশাদ আর বিরহের বীণা বাজিয়ে। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে প্রাপ্ত এ স্বাধীনতা যেন আজ মলিন।
এ এক আমির অন্তরালের গল্প। এরুপ আমি এখন বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে পাওয়া যাবে। যারা কিনা বিজয় দিবসের প্রকৃত অর্থ বাস্তবতার সাথে মিলাতে পারে না। বিজয় উৎসব আজ নির্দিষ্ট গুষ্ঠির কাছে কুক্ষিগত। বিজয় উৎসব আজ বাহ্যিক জৌলুসে সীমাবদ্ধ এক অন্তঃসার শূন্য নীরব কান্না।
পরাধীনতার বেড়াজালে আমরা এখনও আবদ্ধ। এই পরাধীন জীবন যাপনের জন্যই কি আমাদের পূর্বসূরিদের এ মহান আত্মত্যাগ? যদি তা নাই হয় তবে এর অন্তর্নিহিত কারণ কী? কেনই বা ইদানীং কালে মুক্তিযুদ্ধারা জীবন সায়হ্নে এসে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত হতে অস্বীকৃতি জানায়? আর কেনই বা তাঁরা এতটা মর্মাহত? কার প্রতি তাদের এই ক্ষোভ? এসব প্রশ্নের উত্তর তারাই ভাল জানেন। তবে আপামর জনসাধারণেরও তা একেবারই অজানা নয়।
আমরা কখনও ধর্মের নামে দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার আদর্শের বলী হয়েছি, কখনও হয়েছি কারোর স্বামীর আদর্শের বলী, আবার কখনও হয়েছি কারোর পিতার আদর্শের বলী। এ বলিদানের শেষ কোথায়?
রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, দলাদলী, ব্যক্তিগত স্বার্থ এসবের দ্বারা পিষ্ট আমাদের স্বাধীনতা। জাতিগত বৈশিষ্ট্য হিসেবে হুজুগে বাঙ্গালীয়ানায় বাঁচিয়ে রেখেছি গুঁজব, অন্ধ বিশ্বাস, তোষামোদ, আর কুসংস্কারের বস্তা পচা অপসংস্কৃতি। এ দায় ভার কি কারো একার? কখনই তা নয়?
কারো একার প্রচেষ্টায় যেমন দেশটা স্বাধীন হয়নি প্রয়োজন হয়েছে লাখো শহীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও আত্মত্যাগ তেমনি এই স্বাধীনতা রক্ষা করাটাও কারোর একার কাজ নয় প্রয়োজন লাখো কোটির সম্মিলিত ও নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টা।
তবে রাষ্ট্রের এ পরিস্থিতির জন্য সেসব ব্যক্তিরাই দায়ী যাদেরকে বিশ্বাস করে জনগণ নির্বাচিত করে এসেছে, যাদের হাতে তুলে দিয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার গুরু দায়িত্ব। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে আজ অবধি এসব ব্যক্তিরা রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে কোনো না কোনো ক্ষেত্রে চরম ভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। রাষ্ট্রের বিচারহীনতা, দলীয় বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, আত্মকেন্দ্রিক (দলীয়করণ) মনোভাব, কুক্ষিগত প্রশাসন, দমননীতি, স্বজনপ্রীতি, ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার, দুর্নীতি, স্বাধীন মত প্রকাশে বাঁধা, প্রচার মাধ্যমে হস্তক্ষেপ সহ নানান বিষয়ের সার্বিক অব্যাবস্থাপনার জন্য সবাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে কম বেশি দায়বদ্ধ হয়ে আছেন। তবে সেই সাথে যৎসামান্য ও লোক দেখানো অবকাঠামোগত চাকচিক্যের উন্নয়নের কৃতিত্বটাও রয়েছে তাদের ।
তবে এসব আপেক্ষিকতাকে উপেক্ষা করে আমাদের মনে রাখা উচিৎ ব্যক্তিস্বার্থর উর্ধ্বে উন্নয়নের জন্য কাজ করতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। সুবিধাবাদী ও তোষামোদকারীদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে। দেশপ্রেমের নামে কোনো অন্ধ রাজনৈতিক সমর্থন যেন আপামর জনগোষ্ঠীর ক্ষতি সাধন না করে সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।
তবেই বিজয় দিবস পাবে স্বার্থকতা, রাষ্ট্র পাবে স্বাধীনতার রক্ষা কবজ। স্বাধীন হোক প্রতিটি মানুষে ও তাদের চিন্তা চেতনা, পূর্ণ হোক প্রত্যাশা, প্রতিটি দিন হোক বিজয়ের উৎসবে মুখর।
সবাইকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:৫৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



