আমার পিতা মেজর (অবঃ) ওয়াকিউজ্জামান একজন মুক্তিযোদ্ধা, ১৯৭১ এ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন সেকেন্ড লেফট্যানান্ট হিসেবে ৪ নং সাব সেক্টরে কমান্ড করেছেন। যুদ্ধের পর সেনাবাহিনী পুনর্গঠনে কাজ করেছেন। পরবর্তিতে ১৯৮১ সালা জেনারেল জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড হবার পর সৈয়দপুর ক্যন্টনম্যান্ট এ কর্মরত অবস্থায় জেনারেল এরশাদ সাহেবের রোষানলে পড়ে চাকুরী ছেড়ে প্রান বাচিয়ে সেনানিবাস থেকে আমাদের নিয়ে বেরিয়ে আসেন। প্রচন্ড অভীমানে জীবনে আর আর্মির পেনশন নেননি বা নেবার চেষ্টা করেন নি। অনেকবার আমরা বা তার সমসাময়িক অফিসাররা অনুরোধ করলেও তিনি পেনশন নিতে রাজি হননি। এরশাদ সাহেবের শেষ দিকে তাকে ডিওএইচএস এর একটি প্লট নেবের প্রস্তাব দিলেও তা প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তি জীবনে নানা চাকুরী করে একসময় নিজে একটি ছোটখাট ব্যবসা খুলেন, যেখানে আমি নিজের স্বল্পমেয়াদি সামরিক জীবন ছেড়ে এসে কাজ করছি। আর আমার বাবা মেজর ওয়াকি চলে গেলেন সুদুর আমেরিকায়। সেখানে ছোটখাট চাকুরী করে কাটিয়ে দিলেন দীর্ঘ ৯ বছর। তার পিছনে অবশ্য আরেকটা কারন ছিলো আমার মায়ের ক্যন্সারের চিকিৎসা। আলহামদুলিল্লাহ আমার মা এখন সুস্থতার পথে।
এ বছর আমার বাবা দেশে এসে থাকছেন প্রায় ১০ মাস। এসময়ে তার সেক্টরে যুদ্ধ করা সকল মুক্তিযোদ্ধাদের যখনি প্রয়োজন হয়েছে সাহাজ্য করেছেন, তাঁদের সার্টিফিকেটের জন্য সুপারিশ লিখেছেন বা বয়স্ক মুক্তিযোদ্ধাদের তাঁদের বাড়ীতে গিয়ে দেখে এসেছেন। হঠাত একদিন বললেন আমি যে মুক্তিযুদ্ধ করেছি তার কোন সার্টিফিকেট আমার কাছে নেই তাই আর্মি হেডকোয়ার্টারে লিখেছি যেন আর্মি থেকে একটা সার্টিফিকেট দেয়া হয়। যদিও মুক্তিযুদ্ধের গেজেট ও দলীলপত্রে তার নাম লিখা আছে কিন্তু তার কাছে কোন কাগজপত্র নেই। তার কাছে শুধু আছে বিভীন্ন পত্রপত্রিকায় ১ম ওয়ার কোর্সের কিছু পেপার কাটিং আর বিভীন্ন বই এ ছাপা হওয়া কিছু যুদ্ধের বীবরন। ঈদের কদিন আগে আর্মি হেডকোয়ার্টার হতে জানানো হলো তার সার্টিফিকেট তৈরী আছে এবং তিনি তা সংগ্রহ করতে পারেন। বাবা বেশ খুশী হয়ে গতকাল ১০ নভেম্বর ঢাকা গেলেন সার্টিফিকেট আনতে। আজ সকালে যখন কথা হলো বললেন সার্টিফিকেট পেয়ে তা যে অফিসার দিয়েছেন আর্মি হেডকোয়ার্টারে সে অফিসারের সামনে ছিড়ে ফেলে দিয়ে এসেছি। কারন জিজ্ঞেস করলে বললেন আমার ঠিকানা, বাবার নাম দেবার পরও তা ভুল লিখেছে আর একটা সাদা কাগজে সার্টিফিকেট দিয়েছে। আরো বললেন আমি আমার অধীনে যারা যুদ্ধ করেছে তাঁদের এর থেকে অনেক ভালো সার্টিফিকেট দিয়েছি, আর্মি থেকে কিছু নেইনি আর নেবোও না। হয়তো একজন মুক্তিযোদ্ধা অফিসার থেকে সেনাবাহিনীর একটি প্যাড এর পাতার দাম অনেক বেশি।
আমি জানি আমার বাবার মন খুব খারাপ হয়েছে। একজন খুব শান্ত মানুষ যিনি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন যার বিনিময়ে কোনদিন কোন সুযোগ সুবিধা নেননি তিনি চেয়ে যদি একটি সার্টিফিকেট না পান তাহলে কাদের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন? নিজের আপন সেনাবাহিনী যদি তাকে একটা সার্টিফিকেট দিতে এত তাচ্ছিল্য করে তাহলে আর কোথায় যাবেন তিনি? অনেক আগে একবার যখন মুক্তিযোদ্ধাদের নাম নিবন্ধন হচ্ছিলো তখন তিনি দেশে না থাকায় আমি গিয়েছিলাম আর্মড সার্ভীসে বোর্ডে, সেখানকার এক করণিক যিনি ফর্ম দিচ্ছিলেন, তিনি বলেছিলেন স্যারের নাম নিবন্ধন করতে লাগবেনা, উনার নাম না থাকলে দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়নাই। আমারো আজ মনে হচ্ছে কাদের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন আমার পিতা?
-------------------------------------------
যা হোক শেষ পর্যন্ত আর্মি হেড কোয়ার্টার থেকে একজন অতি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এসে আমার পিতার সাথে দেখা করে দুঃক্ষ প্রকাশ করেন। যার ফলে আমি এই লিঙ্ক টি দেখার অনুরোধ করছি। Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই নভেম্বর, ২০১১ ভোর ৪:০৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



