রাতের রমনায় আঁধার জড়ায়া দাঁড়ায়া থাকা বিষণ্ণ কিশোরী মেয়েটার মত শিরোনামহীন একটা কবিতা আমার মগজের ধার ঘেঁইষা দাঁড়ায়া আছে। অনেকক্ষণ। তাকায়া দেখলাম। এলোমেলো গোটা দশেক অপুষ্ট শব্দ। ছন্দ নাই। মাত্রা নাই। উৎকট বিরক্তি নিয়া দৃষ্টি ফিরাইতেই ঠিক চোখের দূরত্বে নাইমা আইসা দাঁড়াইল পুর্ণ যৌবনা চাঁদ। ছিনাল চাঁদটারে ঘিরা অর প্রণয়প্রার্থী লক্ষ কোটি মর্ষকামী নক্ষত্রের শীৎকার মুহূর্তেই আমারে কেমন যেন বধির কইরা দিল। মাথার ভিতরে চালচুলাহীন ছন্নছাড়া কবিতার মৈথুন। রৈখিক সমীকরণে গসিয়ান এলিমিনেশন যেইভাবে একটার পর একটা অজানা চলক বিনাশ কইরা দেয়, সেই রকম দক্ষতায় মাথার ভিতর থেইকা কবিতার নগ্ন হলাহল এড়ায়া স্রোতহীন বিষণ্ণ নদীগুলার মত আবার পথে নামলাম।
শাহবাগ, বাংলা একাডেমী ডিঙায়া নাজিমুদ্দিন রোড। মিতালি হোটেলের পিছনে সিতারা ভাবির ঘিয়া রঙের সাড়ে চারতলা বাড়ি। এদিক দিয়া যাওয়ার সময় নিয়ম কইরা মুখ তুইলা দেখি। ভাগ্য ভালো হইলে সিতারা ভাবিরে দেখা যায়। সিতারা ভাবির টিপ লেপ্টানো মুখ। সিতারা ভাবির গজদাঁত উপচানো হাসি। সিতারা ভাবির ভ্রু আঁকা চোখের ইশারা। সিতারা ভাবির সবকিছুই একদিন আমার অধিকারে আছিলো। এখন নাই আর। সিতারা ভাবির বনসাই বাগানে নতুন গাছ আসছে। আজকে মুখ তুলতেই দেখলাম সাতরঙা পর্দা ছিঁড়া সাড়ে চার তলার জানালার গ্রিলে ঝুইলা আছে সিতারা ভাবির কালা বিলাইটা। অর নাম মনে থাকে না আমার। অবশ্য...এখন আর আমার কিছুই যায় আসেনা।
মিতালি হোটেলে পরটা আর মগজ ভুনা খাইতে খাইতে প্রথম রাইতে বিলাই মারার গল্পটা মনে আসলো। খুব ভুল হয়া গেছে। সিতারা ভাবির বিলাইটা মারা হয় নাই। মিতালি হোটেলের ম্যানেজার হায়দার আমারে দেইখা হাসলো। সে হয়তো এইরকম কইরা আমার আগে আরো অনেকরে দেইখা হাসছে। অরেও মারতে হবে। সিতারা ভাবিরে মারতে হবে। মেসের বাড়িওয়ালা শরাফত আলীরেও মারতে হবে। খুনের তালিকা বাড়তেছেই। কাউরে নতুন কইরা খুনের তালিকায় ঢুকাইতে পারলেই অদ্ভুত এক রকমের আনন্দ হয়। মাথার ভিতর টগবগ কইরা ফুটতে থাকা গরম পানির মতো ওগলানো রাগটা কইমা আসে।
রোজকার মতন অনেকগুলা খুনের তালিকা মাথায় গাইথা নিয়া মিতালি হোটেল থেইকা বাহির হয়া আগামসি লেইনের ঘুটঘুটা অন্ধকার মেসঘরের দিকে হাঁটতেছিলাম। কিছুদূর আগাইতেই আমার পাশে নাইমা আসল একটা বামন তারা। কৃষ্ণ বামন। আলো নাই। তাপ নাই। ঠিক আমার মত। কৈশোরের বন্ধুর মতন আমরা পরস্পরের কাঁধে হাত রাইখা হাঁটছিলাম। আমাদের বিষণ্ণতা কাইটা গেছিল। অনেক অনেকদিন পর আমরা প্রাণ খুইলা উচ্চস্বরে হাসছিলাম।
সেই রাইতের কথা অনেকেই ভুলে নাই। সেই রাইতে হাজার মানুষের ভিড়ে চানখার পুল থেইকা ফুলবাড়িয়ার দিকে পাশাপাশি শিস বাজায়া হাঁইটা গেছিলো একজন বামন মানুষ আর একটা বামন তারা। আজও নাজিমুদ্দিন রোডে কান পাতলে শিসের শব্দ শোনা যায়। আজও ভরা পুর্ণিমায় চানখারপুল ফুলবাড়িয়ার প্রাচীন মানুষেরা আমাদের কথা বলে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


