গত ৩রা মার্চ প্রথম আলোর সম্পাদকীয় বিভাগে ল্যাব এইড গ্রুপের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক এ এম শামীম ‘আরেকটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কেন প্রয়োজন ’ শিরোনামে একটি কলাম লিখেছেন। তিনি সেখানে দেশের সরকারী মেডিকেল কলেজগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার পেছনে যুক্তি খুঁজেছেন এবং সকল বিতর্কের উর্ধে উঠে সেই দিকে সকলকে এগিয়ে যেতে আহবান করেছেন।
অত্যন্ত নিচুমানের যুক্তি সম্বলিত এই লেখাটি পড়লে সহজেই অনুমান করা যায় ১৭ই জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা মেডিকেল কে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ করার ঘোষণা আসলে সব সরকারী মেডিকেল কলেজগুলোকে বেসরকারিকরণ ও বানিজ্যিকীকরণের পাঁয়তারা যার পেছনে প্রধান লবিং হিসেবে কাজ করছে দেশের এলিট স্বাস্থ্য-ব্যাবসায়িরা।
একদম শুরুতেই তিনি বলেছেন –
"চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ব্যাপক বিচরণের এক অবাধ ক্ষেত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। পৃথিবীর অনেক দেশেই আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়ায় হয়ে থাকে, যেমন সুইজারল্যান্ডের লিউস্যান ইউনিভার্সিটি, সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, মালয়েশিয়ার আইএমইউসহ আরও অনেক খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়। কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নপরিক্রমা, অবকাঠামো, পারিপার্শ্বিকতা, সার্বিক কর্মকাণ্ড সবকিছুর মধ্যে রয়েছে ব্যাপক পার্থক্য।"
মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়?! পৃথিবীর কোথায় আছে? শুধুমাত্র মেডিকেল ফ্যাকাল্টি দিয়ে কোন বিশ্ববিদ্যালয় তো আমার নজরে পড়েনি। বড় বড় প্রতিষ্ঠান যেমন হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল, কিংস কলেজ, ইম্পেরিয়াল কলেজ এরা সবাই কোন না কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চালু আছে। লেখক পরের লাইনে নিজেও উদাহরণ দিয়ে সেই কথাই বলেছেন যে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে হয়। ঢাকা মেডিকেলও তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অফ মেডিসিনের অধীনে ১৯৪৬ থেকে এই ঢাবির ক্যাম্পাসেই চলছে, পৃথিবীর আর ৫টা বড় মেডিক্যাল স্কুলের মত। তাহলে সমস্যা কোথায়? একে বিশ্ববিদ্যালয় বানালে শিক্ষার মান বাড়বে এই নিশ্চয়তা কোথায়? বিশ্ববিদ্যালয়ে নাম নিয়ে কি বর্তমান বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল ঐসব প্রতিষ্ঠান থেকে ভালো শিক্ষা দিচ্ছে?
"এ ক্ষেত্রে দেশের শীর্ষস্থানীয় মেডিকেল কলেজগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করে বিশ্বমানের চিকিৎসা পেশাজীবী তৈরির উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাতে পারি।"
এখানেই ধরা পড়ে আসল উদ্দেশ্য। কলামের শিরোনামে একটা বিশ্ববিদ্যালয় বানানোর কথা আর ভেতরে এসে সবগুলো মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় বানানোর উদ্যোগ! বাংলাদেশ মেডিকেল এ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) দাবি তুলেছে দেশের ৮ টি পুরাতন মেডিকেল কলেজকে ইউনিভার্সিটি বানাতে। তার মানে ডি এম সি কে বিশ্ববিদ্যালয় বানানো খালি শুরু। সামনে বাকি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোকেও একই ভাগ্য বরণ করতে হবে।
"ডাক্তার, শিক্ষক এবং বিশেষজ্ঞ—যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবেন, তাঁদের জন্য ইতিবাচক দিক হলো, বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, তাই তাঁরা নির্দিষ্ট বয়সসীমার আবর্তে বন্দী না থেকে বেশি সময় একই স্থানে স্থায়ীভাবে যুক্ত থাকতে পারবেন। এর ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁদের আত্মিক সম্পর্ক বেড়ে যাবে, নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে তাঁরা দীর্ঘদিন কাজ করতে পারবেন।"
অন্যভাবে বললে, একবার ঢুকতে পারলেই কেল্লা ফতে! কিছু লোকের ঢাকা থেকে আর বদলি হতে হবে না। দলীয় কর্মী পুনর্বাসনের একটা স্থায়ী জায়গা হবে। ‘নিয়োগ বাণিজ্য’ আর ‘বদলি বাণিজ্য’ ফুলে ফেপে উঠবে। কোটি কোটি টাকার লেনদেন হবে।
"বিদ্যমান মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্তে যেসব কর্মচারী চাকরি হারানোর আশঙ্কা করছেন, তাঁদের জন্য ইতিবাচক বিষয়টি হলো—কর্মচারী-কর্মকর্তাদের ২৫-৩০ শতাংশকে তাঁদের মতামত সাপেক্ষে নতুন নির্মিতব্য হাসপাতালে স্থানান্তর করা যেতে পারে।... ... মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি হারানোর আশঙ্কা অমূলক।"
তার মানে ৭০-৭৫ শতাংশ কর্মচারী সরকারী থেকে বেসরকারি চাকুরিজীবিতে পরিণত হবেন। তাদের বেতন-ভাতা আর সরকার থেকে আসবে না। আসবে প্রতিষ্ঠান থেকে। প্রতিষ্ঠানই হবে তাদের ভাগ্য নির্ধারক। বাকিদের বদলি হতে হবে অন্যত্র কোন নতুন জেলায়, যেখানে জীবনযাত্রার সুযোগসুবিধা কম। এসবকে লোকে চাকরি হারানো ছাড়া কি বলে তা এই অধমের মাথায় আসছে না।
সবশেষে তিনি বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণের ভয়টাকেই সত্য প্রমাণ করে দিলেন -
"সরকারের অনুদান, খরচ, বাজেট ইত্যাদির ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় একটি উচ্চাভিলাষী অবদান রাখতে পারে। উল্লেখ্য, বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজকে একটি বড় অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ দিতে হয় সরকারকে, যা এই মুহূর্তে সরকারের জন্য একটি অর্থনৈতিক চাপ। কর্তাব্যক্তিদের যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে রোগীদের থেকে স্বল্প আয়, সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তির অনুদান, বিভিন্ন গবেষণা কর্মসূচি থেকে আয় ইত্যাদি দিয়ে পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে আয়-ব্যয়ে সামঞ্জস্য আনাও সম্ভব। এতে বিশ্ববিদ্যালয় তার নিজের আয়ে হাসপাতালটি চালাতে পারলে নিজেদের ওপর দৃঢ়তা, স্বনির্ভরতা ও একাগ্রতা বেড়ে যাবে।"
হা উচ্চাভিলাষী অবদানই বটে! কিন্তু তার ফলে মানুষের পিঠে কি অবদান পড়বে তা তো কেউ বলে না। অবশ্য সেই লিস্ট এতো লম্বা যে শুরু করলে শেষ করা মুশকিল।
নিজের আয়ে দেশের সবগুলো মেডিকেল কলেজ চলবে, মানে সোজা কথায় সেগুলো প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। এই নিজের আয়ের উৎস হবে রোগী ও শিক্ষার্থী। অনুদান আর গবেষণা দিয়ে যে প্রতিষ্ঠান চলে না সেটা পাগলেও বোঝে। তো রোগী ভাইয়েরা, ভুলে যান কম খরচের সরকারী জেনারেল হাসপাতাল। জমিজমা বিক্রির জন্য তৈরি হন।
১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর থেকেই নানা বাহানায় সকল প্রকার ফি বাড়িয়ে চলা হচ্ছে। ঢাকা মেডিকেলের সাথে একটু তুলনা করলেই তা বোঝা যায়। ডিএমসি তে রোগী ভর্তি ফ্রি, সাধারণ বেড ফ্রি, পেয়িং বেড ২২৫ টাকা প্রতিদিন, কেবিন ৩৭৫ টাকা প্রতিদিন। বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে এগুলো যথাক্রমে ১০০, ১৮০, ১০২৫ ও ২০২৫ টাকা। তার ওপর ১০ দিনের অগ্রিম দিতে হয় ভর্তি করাতে। সাথে ১০০০ টাকা প্রোসেসিং ফি। সোজা কথা গরিব পক্ষে তো সেখানে যাওয়া সম্ভবই না, এমনকি মধ্যবিত্তের পক্ষেও পেয়িং বেড কিংবা কেবিন নিয়ে রোগী বেশিদিন রাখা সম্ভব না। যে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারেরা আগে ফ্রিতে রোগী দেখতেন তারা এখন সেখানে ২০০ টাকা ভিজিটে রোগী দেখতে বসেন উপরি ইনকামের জন্য।
এখন ঢাকা মেডিকেল কে বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়ে ফেললে সেখানেও এই রকম ফি গুনতে হবে। ঢাকায় প্রায় ৩৫ লক্ষ মানুষ বস্তিতে বাস করে। তাদের ভালো চিকিৎসার একমাত্র ভরসা এই সরকারী মেডিকেলগুলো। প্রতিদিন হাজার হাজার ছোটোখাটো দুর্ঘটনা ঘটে। যার একটা বিরাট অংশ সামলায় এই ডিএমসি। একে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করে স্বায়ত্তশাসন ও আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্যের নামে যদি আরেকটা ল্যাব এইড, শমরিতা, এমনকি বঙ্গবন্ধু মেডিকেলও বানিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে নগরের বিপুল নিম্নবিত্তের চিকিৎসার আশা দপ করে নিভে যাবে, আর মধ্যবিত্তের জন্য থাকবে তিল তিল করে জমানো সঞ্চয় এক অসুখে শেষ হয়ে যাওয়ার কষ্ট।
আর ডাক্তার হবার স্বপ্ন দেখা নতুন প্রজন্ম, ভুলে যাও কম খরচের মেডিক্যাল পড়া। বাপকে বল টাকা গোছাতে, নইলে রাস্তা মাপো। খুব বেশি কল্পনাশক্তি খরচ না করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। জগন্নাথ কলেজকে ঢাকঢোল পিটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বানানোর পর এখন সেখানে বাৎসরিক ফি ২৫০০ থেকে ২৮৮০০ করে দেওয়া হয়েছে।
চিকিৎসাবিজ্ঞান এমনিতেই এমনিতেই পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যায়বহুল পাঠ্যক্রমগুলোর একটা। এখানে কোনোপ্রকার ভর্তুকি না থাকলে ডাক্তারি পড়া কিরকম ব্যায়বহুল তা আমরা বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর দিকে তাকালেই দেখাতে পারি। ১০ থেকে ২০ লক্ষ টাকা গুনতে হয় এমবিবিএস এর জন্য। এখানে খেয়াল করতে হবে এইসব সরকারী মেডিকেল কলেজগুলোকে ইউনিভার্সিটি বানানোর পিছনে যারা লবিং করছে তারা অনেকেই এইসব বেসরকারি মেডিকেলের মালিক। তাদের স্বার্থটা এখানে খুবই পরিষ্কার। যদি সরকারী মেডিকেল কলেজগুলোর খরচ তাদের সমান হয়ে যায় তাহলে তারা সমানতালে শিক্ষার্থী ভর্তির প্রতিযোগিতায় নামতে পারবে। তাছাড়া ডিএমসি’র ডিগ্রি যদি ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের না হয়ে ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠা পাওয়া একটা বেসরকারি ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেটের মানও কমে তাদের মতোই হবে। সব মিলিয়ে এমবিবিএস হবে প্রচুর লাভজনক এক ব্যবসার নাম। মাঝখান দিয়ে শেষ হয়ে যাবে অসংখ্য সাধারণ ঘরের মেধাবী ছেলেমেয়ের ডাক্তার হবার স্বপ্ন।
আর এইসব অর্থনৈতিক চাপ এর গীত শুনলে তো মাথায় চাপ দিয়ে রক্ত ওঠে। সরকারের কাজটা কি? মানুষের কাছ থেকে কর নিয়ে নির্বাচিতদের বিলাসিতার ব্যাবস্থা করা আর সেনাবাহিনীর অস্ত্র কেনা? নাকি জনকল্যাণে টাকা ব্যায় করা? দেশের ৪০% মানুষ আধুনিক চিকিৎসা বঞ্চিত। ২৫% রোগী এমবিবিএস ডাক্তারের চেহারা না দেখে মারা যায়। দেশে ৪৭১৯ জনে একজন ডাক্তার, ৮২২৬ জনে একজন নার্স, ৪০৭৭৩ রোগীর জন্য একটা হাসপাতাল বেড। ১৬ কোটি জনগনের জন্য মাত্র ৫৪ হাজার রেজিস্টার্ড চিকিৎসক। সারা দেশে মা ও শিশু কেন্দ্র মাত্র ৯৭ টা।
অথচ, এবছর স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল ৮ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা। আর এক রাশিয়ার কাছ থেকেই অস্ত্র কেনা হয়েছে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। সীমান্তে তো দেখি বিএসএফ টার্গেট প্র্যাকটিস করে, কোন শক্ত পদক্ষেপ তো দেখিই না বরং ভারতের হয়ে মিউ মিউ করতে শুনি। তাইলে এতো সব অস্ত্র কিনে কি হবে? আসলে সবাই জানে কিসের জন্য। প্রতি চালানে তো কোটি কোটি টাকা পকেটে আসে! টাইম আসে নাকি গরিব মানুষের অসুখ বিশুখ দেখার!!!
আর রাষ্ট্রের এইসব মামদোবাজিকে আরও উৎসাহ দেয় মুনাফালোভী হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার আর ওষুধ কোম্পানির মালিক শ্রেণী। কারণ তারা সরকারী চিকিৎসাসেবার এই বেহাল দশার সুযোগ নিয়ে ইচ্ছামত মুনাফা করে নিতে পারে। আর এদের পিছনে মদদ দেয় পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো যাদের কর্পোরেটরা তক্কে তক্কে থাকে কোথায় একটা নতুন ব্যাবসার বাজার পাওয়া যায়।
এই ‘বিত্ত’ নামক মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত এইসব স্বাস্থ্য-ব্যাবসায়িদের হাতে আমরা আমাদের স্বাস্থ্য আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষার ভার ছেড়ে দিতে পারি না। এদেরকে ঝাঁটা মেরে উৎখাত করতে হবে। সেই সাথে ঠেকাতে হবে সারা পৃথিবীতে শুরু হওয়া পুঁজিবাদের মহামারি। যা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে ব্যাবসা বানিয়ে মুনাফা করে। চেতনাকে কর্পোরেট ঝলকানিতে অন্ধ করে শুষতে থাকে আমাদের রক্ত।
"জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদ"
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মার্চ, ২০১২ দুপুর ১:৩৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



