somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

" ট্রাম্প - চীন বাণিজ্য যুদ্ধ এবং চায়না ডি-কাপলিং প্রক্রিয়া" - কার লাভ কার ক্ষতি? নির্বাচনে ট্রাম্পের হার - এ সমস্যার গতিপ্রকৃতি কি হবে বা নতুন কিছু ঘটার সম্ভাবনা আছে কি ? (আমেরিকার নির্বাচন পরবর্তী ফলোআপ পোস্ট -৯ )।

২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২০ দুপুর ২:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





ট্রাম্প আমেরিকার ক্ষমতায় এসেছিলেন এক কল্পিত আমেরিকান জাতিবাদী অর্থনীতি গড়বেন বলে- "আমেরিকা ফার্স্ট" নামে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই প্রচার শুরু করেন - আগের সরকার চীনের কাছে বাজার খুলে দিয়ে আমেরিকার মারাত্মক ক্ষতি করেছে।
তিনি হিসাব দিয়েছিলেন এক ২০১৭ সালে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি ৮০০ বিলিয়ন (৮০,০০০ কোটি) ডলারে পৌঁছেছে। আর এই ঘাটতির প্রধান কারণ চীনের সাথে বাণিজ্যে ক্রমবর্ধমান ভারসাম্যহীনতা।তার কথা- চীনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে নানা কারসাজি করে শুধু জিনিস বিক্রি করা যার পরিণতিতে আমেরিকার শত শত শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে এবং লাখ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছে।তার পর একতরফা ভাবে এপ্রিল -২০১৮ তে ট্রাম্প অ্যালুমিনিয়াম এবং ইস্পাত সহ শত শত চীনা আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছিলেন। ঐ সব পণ্যের আমদানি মূল্য ৬,০০০ কোটি ডলার হতে পারে।



এর পর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে চীন ও মার্কিন মদ, শুয়োরের মাংস, ফল সহ ৩০০ কোটি ডলারের মার্কিন পণ্য আমদানির ওপর শুল্ক বসিয়েছিল।বিশ্বের এক নম্বর এবং দুই নম্বর অর্থনীতির মধ্যে এই বাণিজ্য যুদ্ধের পরিণতি নিয়ে গত দু বছর যাবত বিশ্ব জুড়ে উদ্বেগ গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে।

তবে, ট্রাম্প এই বিশ্ব উদ্বেগকে পাত্তাই দেননি না। তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন, - "বাণিজ্য যুদ্ধ ভালো এবং আমেরিকার তাতে কোনো ক্ষতি নেই, বরঞ্চ লাভ"।এই যুদ্ধে কি সত্যিই আমেরিকা জিতবে বা জিতেছেন ? তখন অধিকাংশ বিশ্লেষক বলেছিলেন, বাণিজ্যের লড়াই এমন এক লড়াই যেটাতে জেতা ভীষণ কঠিন।

কেন- তার কিছু কারণ দেখিয়েছিলেন নিউইয়র্কে বিবিসির বাণিজ্য বিষয়ক সংবাদদাতা নাটালি শারম্যান।

** চীনা অ্যালুমিনিয়াম এবং ইস্পাতে শুল্ক বসালেই আমেরিকায় স্টিল এবং অ্যালুমিনিয়াম শিল্পে চাকরির সুযোগ নাও বাড়তে পারে।যদিও ট্রাম্প মনে করছিলেন বাড়তি আমদানি শুল্ক বসালে দেশের ভেতর ইস্পাত এবং অ্যালুমিনিয়াম শিল্পে বিনিয়োগ বাড়বে এবং চাকরির সুযোগ তৈরি হবে।

** বাড়তি শুল্কের ফলে আমেরিকায় দাম বাড়বে।আমেরিকার ইস্পাত শিল্পে বর্তমানে শ্রমিক কর্মচারীর সংখ্যা ১৪০,০০০। কিন্তু অন্য যেসব শিল্প ইস্পাতের ওপর নির্ভর করে সেগুলোতে শ্রমিকের সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। ফলে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়েছে সেই সব ইস্পাত নির্ভর শিল্প।খুচরা বিক্রেতাদের সমিতি বলেছিল - " ট্রাম্প আসলে সাধারণ আমেরিকান পরিবারগুলোর ওপর কর বসাচ্ছেন চীনের উপর নয়"।

** বাড়তি শুল্কে আমেরিকার মিত্ররা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং তারা পাল্টা জবাব দেবে।আমেরিকা সবচেয়ে বেশি ইস্পাত আমদানি করে কানাডা থেকে। তারপর ইউরোপ, দক্ষিণ কোরিয়া এবং মেক্সিকো থেকে। এসব দেশ আমেরিকার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক এবং সামরিক মিত্র। ফলে ইস্পাতের ওপর শুল্ক বসালে এরা ক্ষেপে যাবে।আগামি দিনগুলোতে হয়তো দেখা যাবে, কানাডা বা ইউরোপ এই বাড়তি শুল্ক থেকে অব্যাহতি চাইবে। না পেলে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেবে।কিন্তু ট্রাম্প বলেছিলেন, মিত্র দেশগুলোর মাধ্যমে আসলে চীন আমেরিকার বাজারে সস্তা ইস্পাত ঢোকাচ্ছে, ফলে তাদের ওপরও শুল্ক না চাপিয়ে উপায় নেই।

** চীনের হাতে পাল্টা অস্ত্র - গাড়ী, কৃষি-শিল্পের মত যেসব আমেরিকান শিল্প চীনে বাজার পাচ্ছে বা চায়, তারা এই লড়াইকে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল।তারা ভয় পাচ্ছিল যে - চীন পাল্টা জবাব দেবে এবং চীন তা দিয়েছিল ও। চীন তখন মদ এবং শুয়োরের মাংস সহ ১৮০টির মত মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক বসিয়েছে ।

** অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপর প্রভাব - ট্রাম্প চেয়েছিলেন আমেরিকার রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পগুলোকে কিছুটা সুরক্ষা দিতে। কিন্তু এই পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ার ধারণা করা সে মুহূর্তে কঠিন ছিল।প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্তে হোয়াইট হাউজের নীতি নির্ধারকরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন আর সংসদে তাদের দলের সদস্যদের সিংহভাগই তীব্র সমালোচনা করছেন।

তীব্র বাক্যবাণে পরস্পরকে জর্জরিত করা, চরম উত্তেজনা কিংবা পিছু হটে "যুদ্ধবিরতি"র নরম সুর - এসব কিছুই দেখা গেছে দুই বছরের আমেরিকা-চীন বাণিজ্য বিরোধে।দীর্ঘবিরোধ ও নানা চড়াই -উতড়াই পেরিয়ে অবশেষে বাণিজ্য যুদ্ধের অবসানে একটি চুক্তি সই করেছে আমেরিকা ও চীন। কিন্তু এর আগে এই যুদ্ধ যে ক্ষতি করেছে তা দু'দেশের জন্যই ছিল অনভিপ্রেত।

অবশেষে জানু্য়ারী ২০২০ দুই দেশের নেতারা এই যুদ্ধ অবসানের লক্ষ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চীনা নেতারা এই চুক্তিকে বলছেন "উইন-উইন"। আর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলছেন, " এ চুক্তি মার্কিন অর্থনীতিতে পরিবর্তন ঘটাবে"।

কিন্তু এই দু'বছরের বাণিজ্য আলোচনা-যুদ্ধ, যা ছিলো দেশ দুটির জন্য রোলার কোস্টারের মতো, যা শেষ পর্যন্ত একটি জায়গায় এসে থামাতে পেরেছে।ফল যাই হোক, এই বাণিজ্য যুদ্ধ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক এমনকি বিশ্ব অর্থনীতির গতি প্রকৃতির নতুন রূপ দিয়েছে নিঃসন্দেহে।



এখন প্রশ্ন এই দীর্ঘ সময়ের বাণিজ্য যুদ্ধে কি কিছু পরিবর্তন এসেছে দু দেশের অর্থনীতিতে বা হলে কি পরিবর্তন হয়েছে ?

** আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে - বাণিজ্য যুদ্ধ শুরুর আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্কোর কার্ড হিসেবে দেখেছেন বাণিজ্য ঘাটতিকে এবং তিনি বিশ্বাস করেছিলেন শুল্ক যুদ্ধ চীনের সাথে তার দেশে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে পারে।হ্যাঁ বাস্তবে তাই হয়েছে।বাণিজ্য যুদ্ধ শুরুর পর দু'দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি অনেক কমেছে, যদিও এখনও তা অনেক বেশি আছে।গত বছর (২০১৯ ) নভেম্বর পর্যন্ত এক বছরে আগের বছরের চেয়ে ঘাটতি কমেছে প্রায় ছয় হাজার কোটি ডলার এবং এখন এ ঘাটতির পরিমাণ ছত্রিশ হাজার কোটি ডলার।তবে এ ঘাটতি কমানোর মূল্য স্বরূপ দু দেশের মধ্যে বাণিজ্য কমেছে প্রায় দশ হাজার কোটি ডলারের।

** চীনে মার্কিন কৃষিপণ্য রপ্তানি কমেছে - ট্রাম্পের শুল্ক ব্যবস্থায় প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে চীন আর তার সবচাইতে বড় আঘাত এসে পড়েছে মার্কিন কৃষকদের ওপরেই।কারণ চীনে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিজাত রপ্তানি আড়াই হাজার কোটি ডলার থেকে কমে এখন সাতশ কোটি ডলারের নীচে। এটাই সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে কম।কিন্তু চীনের কৃষি শুল্ক যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বড় সমস্যা তৈরি করেছে কিনা তা নিশ্চিত না।কারণ দেশটিতে কৃষকের সংখ্যা খুব বেশি নয় আবার সরকার ক্ষতি নিরসনে কৃষিখাতে প্রচুর ভর্তুকি দিয়ে থাকে।

** হ্রাস পেয়েছে চীনা বিনিয়োগ - যদিও চীনে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ অনেকটাই স্থিতিশীল ছিলো এই বাণিজ্য যুদ্ধের সময়েও, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে চীনা বিনিয়োগ কমেছে ব্যাপকভাবে।ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউটের হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্রে চীনা কোম্পানির বিনিয়োগ ২০১৬ সালে ছিলো পাঁচ হাজার চারশ কোটি ডলার আর ২০১৮ সালে এটি হয়েছে নয়শ সাত কোটি ডলার।আর ২০১৯ সালের প্রথম অর্ধেকে এটা ছিলো মাত্র আড়াইশ কোটি ডলার।
চীনা কোম্পানিগুলো বাণিজ্য নিয়ে উত্তেজনাকে নিয়ে তৈরি হওয়া উদ্বেগের কথা উল্লেখ করে বিনিয়োগে অনিচ্ছা প্রকাশ করে।এছাড়া ও বিনিয়োগকে কঠোর নিরীক্ষার আওতায় আনার যুক্তরাষ্ট্রর নীতি ও চীনের মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ শক্ত করাও ছিলো এর উল্লেখযোগ্য কারণ।

** অন্ধকারাচ্ছন্ন বাণিজ্য পরিবেশ - যদিও দুদেশে বিনিয়োগ এখনো হচ্ছে, কিন্তু আমেরিকান যেসব কোম্পানি চীনে কাজ করছে তারা বলছে, দু'দেশের মধ্যকার বাণিজ্য উত্তেজনা তাদের বেশি উদ্বেগের কারণ।ইউএস চায়না বিজনেস কাউন্সিলের হিসেবে চীনে যেসব আমেরিকান উদ্যোক্তা কাজ করছে তাদের মধ্যে ৮১% মনে করেন বাণিজ্য যুদ্ধ তাদের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।অথচ ২০১৭ সালে মাত্র ৪৫% আমেরিকান কোম্পানির এ ধরণের ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ ছিলো।

** চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বড় ধাক্কা - যুক্তরাষ্ট্রের আশংকা তাদের প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশার চেয়ে তিন শতাংশ কম হবে এবং এর একটি বড় কারণ বাণিজ্য যুদ্ধ।বিশ্লেষকরা বলছেন এর পুরো প্রভাব বুঝতে কয়েক বছর সময় লেগে যাবে।
এদিকে চীনের প্রবৃদ্ধিও নিম্নমুখী।২০২০ সালে দেশটির প্রবৃদ্ধি আগের বছরের তুলনায় ৬% কমতে পারে বলে বলছে বিশ্বব্যাংক। তিন দশকের মধ্যে এটাই হবে সবচেয়ে কম।
আবার দুটি বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যকার এ লড়াইয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশ্ব অর্থনীতিও।আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ক্রিস্টালিনা জিওরগিয়েভা বলেছেন, "এই যুদ্ধে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে"।
তবে চীন ছাড়াও অন্য বাণিজ্য অংশীদারদের সাথেও বাণিজ্য চুক্তিগুলো নিয়ে আলোচনা করছে যুক্তরাষ্ট্র।এসব বাণিজ্য দ্বন্দ্বের কারণে আইএমএফ বলছে ২০১৯ সালের প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশা ৩% কমিয়েছে।

** যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বিচ্ছিন্নতার লক্ষ্মণ - একটি বাণিজ্য চুক্তি সত্ত্বেও বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যকার প্রযুক্তিগত বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি বাড়ছে।চীনা টেলিকম কোম্পানি হুয়াওয়ে ও আরও কিছু কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র।ফলে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো তাদের সাথে ব্যবসা করতে পারছেনা।
আবার বেইজিংও একই ধরণের কালো তালিকা করেছে।মনে করা হচ্ছে আমেরিকায় থাকা চীনা কোম্পানিগুলোকে পর্যবেক্ষণের আওতাতেই রাখবে যুক্তরাষ্ট্র।জিও-টেকনোলজিক্যাল বিশেষজ্ঞ পল টিওলো বিবিসিকে বলেছেন," প্রথম দফার বাণিজ্য চুক্তি দু দেশের মধ্যকার উত্তেজনা প্রশমনে ভূমিকা রাখবে কিন্তু এটা দুদেশের প্রযুক্তিগত দ্বন্দ্ব ও অনাস্থা কতটুকু কমাবে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ"।



"নতুন চীন-মার্কিন বাণিজ্য চুক্তিতে যা আছে"

- চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়িয়ে ২০০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে নিয়ে যাবে, যা ২০১৭ সালের সমপরিমান হবে। কৃষিপন্য আমদানি বাড়াবে ৩২ বিলিয়ন ডলার, শিল্পপন্য আমদানি করবে ৭৮ বিলিয়ন ডলার, বিদ্যুৎ আমদানি ৫২ বিলিয়ন ডলার এবং সেবাখাতে চীন আমদানি করবে ৩৮ বিলিয়ন ডলার।
- নকল ঠেকাতে যথেষ্ট ব্যবস্থা নিতে একমত হয়েছে চীন। আর ট্রেড সিক্রেট চুরির ব্যাপারে কোম্পানিগুলোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া সহজতর করবে।
- ৩৬০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত চীনা পণ্য আমদানিতে ২৫% পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করবে যুক্তরাষ্ট্র। অপরপক্ষে চীন, ১০০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত মার্কিন পণ্য আমদানিতে শুল্ক কাঠামো পুনঃবিন্যাস করবে।



ট্রাম্প চীনের সাথে বাণিজ্যযুদ্ধের পাশাপাশি আরো শুরু করেছিলেন "চায়না ডি-কাপলিং"প্রোগ্রাম। এই প্রোগ্রামের আসল মানে কী?

সাধারনত ডি-কাপলিং মানে হল কাউকে একঘরে করা, বাকী সবার থেকে সমাজ থেকে ।তার সাথে সমাজের কেউ চলাফেরা,উঠাবসা এবং কোন রকম সামাজিক সম্পর্ক না রাখা।
চায়না "ডি-কাপলিং"প্রোগ্রাম এর মানে হলো,বাকী বিশ্ব থেকে চীনকে একঘরে করা। কিন্তু কি এই "একঘরে" মানে? আমাদের গ্রামের একঘরে মানে ওর নুন,পানি বন্ধ করে দেয়া।আর ওর সাথে কেউ কোনো পণ্য বিনিময় করবে না যার ব্যবহারিক মানে "নো এক্সচেঞ্জ"-মানে ওকে সমাজ থেকে বের করে দেয়া।যদিও সে আগের বাড়িতেই বসবাস করবে, তার পরেও। কেমন করে এটা ঘটানো সম্ভব হবে? কারণ, ওর সাথে পণ্য বিনিময় না করা মানে, ও যে লবণটা খাবে সেটাও তাকে নিজেই সমুদ্রের পানি জোগাড় করে শুকাতে হবে, না হয় লবণের খনি জোগাড় করতে হবে নিজেই। মূল কথায়, যা কিছু সে ভোগ করবে তার সবটার ‘উৎপাদক’ তাকে নিজেই হতে হবে। ‘নো এক্সচেঞ্জ’ কথার মানে তাই। এখান থেকেই ‘সমাজ’ কথাটার মানে কত বিশাল সে ধারনা আসতে পারে আমাদের। আমরা যারা পণ্য বিনিময় করি তারা এই কাজের মাধ্যমে আসলে একটা সমাজ গড়ে তোলে, অজান্তেই। সমাজ মানে তাই এক অর্থে পণ্য বিনিময়কারীদের সমাজ, পরস্পরকে স্বীকৃতি দেয়ার সমাজ ,এমনকি এভাবে "আন্তর্জাতিক সমাজ"ও।



আর তাই ট্রাম্প বলতে চেয়েছিলেন, চীন চাক বা না চাক তিনি চীনকে বাকী বিশ্ব থেকে একঘরে করবেন বা এক জাতিবাদী রাষ্ট্র বানাবেন। তবে এটা হলো তার পাগলা ট্রাম্পের পাগলামীপূর্ণ কথা। বর্তমান দুনিয়ায় বাস্তবে সেটি আসলে কখনো সম্ভব না। তিনি চীনবিরোধী হতে চান এবং চীন বিরোধী মনোভাব যাদের আছে এ ধরনের দেশগুলোর একটা আমেরিকান প্রভাবাধীন জোট বানিয়ে চীনকে বাকী বিশ্ব থেকে আলাদা করে দিতে চেয়েছিলেন। আর ট্রাম্পের কল্পরূপের বাস্তবায়নের এমনই কিছু নমুনা হলো, ‘কোয়াড’ রাষ্ট্র গ্রুপ বা হবু ইন্দো-প্যাসিফিক উদ্যোগ ইত্যাদি।

আপাতত ট্রাম্পের হাত থেকে দুনিয়া বেঁচে গেছে বেঁচে গেছে চায়না।চায়না অথবা কোনো দেশকে ডি-কাপলিং করা দুনিয়াকে আর দেখতে হচ্ছে না। কারণ ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে গেছেন। আর ব্লিঙ্কেনও দাবি করছেন, "তিনি বুঝেছেন ডি-কাপলিং অবাস্তব"। কিন্তু ধরা যাক, ট্রাম্প যদি নির্বাচনে জিততেন,তাহলে কী হতো?

এক কথায় বললে, সেটিই হতো সত্যিকার অর্থে - "কোল্ড-ওয়ার ২", যা নিয়ে অনেকে এর আগে কথা বলেছেন। চীন ও আমেরিকার ঝগড়া-সঙ্ঘাত মারাত্মক হলেই লিখে দিয়েছেন "কোল্ড-ওয়্যার ২" আসছে। গত ১৯৫৩-৯১ সাল, এই সময়কালে দুনিয়াটাকে সোভিয়েত-আমেরিকা এ দুই ব্লকে ভাগ করে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু শুধু দুই ব্লক-জোট রাষ্ট্রে দুনিয়া ভাগ করলেই সেটা কোল্ড-ওয়্যার বলে চালানোটা আনাড়িপনা হবে। তাহলে আর কী শর্ত লাগবে? সেটি হলো, যদি একটি ব্লক-জোট "গ্লোবাল বাণিজ্যে" অংশ না নেয়। এটা বোঝা খুবই সহজ। যদি দেখা যায়, যাদের কোল্ড-ওয়ারে জড়িয়ে যাওয়াকে দুই দেশ বা ব্লক বুঝাতে চাচ্ছি তাদের একটা ব্লক-জোট যদি শুরু থেকেই আইএমএফের সদস্যই না হয় অথবা আগে হয়ে থাকলে এখন সদস্যপদ ত্যাগ করে,। এই ত্যাগ করা মানে, ওসব রাষ্ট্র আর "গ্লোবাল বাণিজ্যে" অংশ নিতে পারবে না। ঠিক এমনটা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সোভিয়েত ব্লকের অনেক রাষ্ট্রের।

আইএমএফের জন্মের সময় ১৯৪৪ সালে আমেরিকার এক ব্রেটনউড হোটেলের ২২ দিনের সম্মেলনে সোভিয়েত ইউনিয়নের মানে, জোসেফ স্টালিনের প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলেন; কিন্তু এর জন্ম দলিল তৈরি করা সম্পন্ন হওয়ার পরে ফাইনাল সদস্যপদ নিয়ে যখন চাঁদা দিয়ে স্বাক্ষর করতে হয় তখন থেকে কোনো সোভিয়েত প্রতিনিধি আর উপস্থিত হননি। তাই সোভিয়েত ইউনিয়ন আইএমএফের সদস্য ছিল না। তবে পঞ্চাশের দশকে আইএমএফ ফাংশনাল হলে সোভিয়েত ব্লকের অনেক সদস্যই যেমন- পোল্যান্ড এর সদস্যপদ পেতে আবেদন করেছিল। তাতে আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক উভয়েই অনুমোদন করলেও আমেরিকান প্রশাসনের আপত্তিতে তা বাতিল হয়ে যায়। অতএব সোভিয়েত ব্লক-জোটের সাথে আমেরিকার নেতৃত্বে বাকিদের কোনো গ্লোবাল বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল না। তাই পণ্য বিনিময় বাণিজ্য সম্ভব ছিল না। কাজেই ট্রাম্পের স্বপ্ন অধরা হয়ে থাকার সম্ভাবনাই ছিল প্রচুর।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার আগ্রাসী চীনবিরোধী নীতি, বিশেষত বাণিজ্যযুদ্ধ, বেইজিংয়ের ওপর একধরনের বিনিয়োগ ও বাজার অবরোধ, গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ভেঙে দেয়ার নামে চীনা নাগরিকের ওপর অভিযান ও ভ্রমণ বিধিনিষেধ, সর্বোপরি করোনাভাইরাসের জন্য চীনকে দায়ী করে এক তীব্র উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি করেন। একই সাথে স্নায়ু দ্বন্দ্বের ফলে দক্ষিণ চীন সাগর, তাইওয়ান ও ভারত সীমান্ত নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। চীনের শি জিন পিং এসব ইস্যুতে নমনীয়তার পরিবর্তে প্রতি জবাব দেয়ার মতো নীতি গ্রহণ করেন। এতে করে, সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও শীর্ষ নিরাপত্তা বিশ্লেষক হেনরি কিসিঞ্জারের মতে, "চীন ও আমেরিকার মধ্যে একটি বিপর্যয়কর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হতে পারে"। কিসিঞ্জার মনে করেন, "চীনের ব্যাপারে ট্রাম্পের মতো আগ্রাসী মনোভাব নেই বাইডেনের। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প তার শেষ সময়ে এমন কিছু চীন বিরোধী পদক্ষেপ নিয়েছেন ও নিচ্ছেন যেখান থেকে ইউ টার্ন করা পরবর্তী প্রশাসনের জন্য বিপর্যয় হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ ছাড়া জো বাইডেনের মনোভাবও চীনের প্রতি পুরোপুরি ইতিবাচক এমন নয়। এই অবস্থায় কিসিঞ্জারের আশঙ্কা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ের মতো একধরনের ধোঁয়াশা ও জ্ঞাত গন্তব্যহীন অবস্থায় দুই পক্ষ বিপর্যয়কর যুদ্ধে জড়াতে পারে"।

কিসিঞ্জারের আশঙ্কা সত্যি হবে কি না নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল। তবে চীনের এক ধরনের প্রস্তুতি ভেতর থেকে লক্ষ করা যাচ্ছে। ট্রাম্পের পরাজয় নিশ্চিত হওয়ার সময়টিতে আসিয়ান ও আশপাশের ১৫টি দেশের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে চীন। যার মধ্যে জাপান অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ কোরিয়া ও ভিয়েতনামের মতো আমেরিকান মিত্র দেশও রয়েছে। এ চুক্তিতে ভারতকেও অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চলছে। এ লক্ষ্যে আবার ব্রিকসকে চাঙ্গা করার চেষ্টা হচ্ছে।



মার্কিন বলয়কে সর্বাত্মকভাবে মোকাবেলার প্রচেষ্টা সব সময় নিয়ে রেখেছে চীন। এর অংশ হিসেবে রাশিয়ার সাথে একটি কৌশলগত সমঝোতা গড়ে তুলেছে। ইরানের সাথে একটি দীর্ঘ মেয়াদি কৌশলগত সমঝোতায় উপনীত হয়েছে। এই সমঝোতার অংশ হিসেবে চীন জ্বালানির বড় অংশ নেবে ইরান থেকে। সেই সাথে ইরানে অবকাঠামো খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করবে আর সেখানে একটি সামরিক ঘাঁটি রাখবে। এই সমঝোতার অনুল্লিখিত দিকটি হলো মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব কাজে লাগিয়ে বেইজিং তার আধিপত্য বিস্তার ও সংহত করার প্রচেষ্টা নেবে।

এখন বাইডেনের হবু প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, ডি-কাপলিং "অবাস্তব ধারনা ও কাউন্টার-প্রডাকটিভ"। কথাটা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। যদিও এর মানে এই নয় যে, বাইডেনের আমলে চীন ও আমেরিকার মধ্যে আর কোনো দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাত থাকবে না তা এমন নয় এবং তা একেবারেই সত্যি নয় যে তাদের উভয়ের মাঝে সববিষয়ের মীমাংসা হয়ে যাবে। মূল বিষয়, একই গ্লোবাল বাণিজ্য সমাজে চীন থাকছে কি না। যদি থাকে, তবেই দুনিয়া ফান্ডামেন্টালি ঠাণ্ডা থাকবে।আর যদি চীন না থাকে তাহলে কি হবে? আর এসব প্রশ্নের জবাব কি হবে, চীনের সাথে আমেরিকার ভবিষ্যত বানিজ্য সম্পর্ক এবং অন্যসব সম্পর্ক কি হবে বা কিভাবে পরিচালিত হবে বিশ্বের দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তির সম্পর্ক তা জানার জন্য আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।



পূর্ববর্তী পোস্ট -"ফিলিস্তিন সমস্যা" - সমাধান কোন পথে কত দূর? আমেরিকায় জো-বাইডেনের বিজয় এবং ট্রাম্পের হার ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান বা নতুন মেরুকরণের সম্ভাবনা আছে কি? - Click This Link


তথ্যসূত্র - উইকিপিডিয়া,সিএনএন, সংবাদপত্র, নিবন্ধ ,সম্পাদকীয়।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১২:৩৪
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×