somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

" আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতা দখলের ৩ মাস " - কাবুলে কি ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে তালেবানদের জন্য বা আফগান জাতির ভবিষ্যত গন্তব্য কোথায় ? ( তালেবানদের কাবুল দখল পরবর্তী ফলোআপ পোস্ট - ৭ )।।

০৩ রা নভেম্বর, ২০২১ দুপুর ২:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ছবি - বিবিসি

গত আগস্টে তালেবানরা আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করার পর প্রথমবারের মত (১০ অক্টোবর ২০২১) তাদের সঙ্গে সামনাসামনি আলোচনায় বসেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কাতারের রাজধানী দোহায় অনুষ্ঠিত তালেবান ও মার্কিন সিনিয়র কর্মকর্তাদের মধ্যকার এই বৈঠককে প্রাণবন্ত এবং পেশাদার হয়েছে বলে আখ্যায়িত করেছে ওয়াশিংটন। পরবর্তীতে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তালেবানদের তাদের কথায় নয়, বরং কাজ দ্বারা বিচার করা হবে। বৈঠকে আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল - নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ উদ্বেগ এবং আফগানিস্তানে এখনো রয়ে যাওয়া মার্কিন নাগরিকদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন। এছাড়া অন্যান্য বিদেশি নাগরিক ও আফগান, যারা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় আছে। পাশাপাশি আফগান সমাজের সকল ক্ষেত্রে নারী ও মেয়েদের অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণসহ মানবাধিকার ইস্যু নিয়েও আলোচনা করেছেন মার্কিন প্রতিনিধিরা।উভয় পক্ষ যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি আফগান জনগণের জন্য শক্তিশালী মানবিক সহায়তার বিধান নিয়েও আলোচনা করেছে।

তাছাড়া,আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে এ নিয়ে গত ২৭/১০/২০২১ বৈঠকে বসেছিল প্রতিবেশী দেশগুলো। ইরানের রাজধানী তেহরানে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে যোগ দিয়েছিলেন আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান, ইরান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। একদিনের এ বৈঠকে তালেবানশাসিত আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ এড়ানোর লক্ষ্যে সবাইকে সহযোগিতা করারও আহ্বান জানান। জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেসও একটি ভিডিও লিংকের মাধ্যমে সেই বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। আবার আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে একটি জরুরি ভার্চুয়াল বৈঠকের আয়োজন করেছিল পাকিস্তান যাতে অংশগ্রহণ করেছিল ইরান ও পাকিস্তান ছাড়া অপর চার প্রতিবেশী দেশ হচ্ছে চীন, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও উজবেকিস্তান। দেশটিতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করা প্রতিবেশী দেশগুলোর দায়িত্ব এবং সে দায়িত্ব পালনের উপায় নিয়ে আলোচনা করাই ঐ ভার্চুয়াল বৈঠকের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল।

ইতিমধ্যে ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের সাথেও তালেবানদের বৈঠক হয়েছে। তারাও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তালেবানদের সাহায্যের কথা বলেছে । তবে আমেরিকা বা ইউরোপের কোন দেশ কেউই তালেবানদের স্বীকৃতি বা ব্যাপক পরিসরে তাদের সাহায্যের ব্যাপারে কিছু বলেনি । পাশাপাশি রাশিয়া-চীন-ইরান এবং তাদের প্রতিবেশী আরও অনেক দেশ তাদের সাথে নূন্যতম স্বাভাবিক সম্পর্ক রক্ষার ব্যাপারে ও জরুরী সাহায্য-সহযোগীতার ব্যাপারে একমত হলেও তাদের স্বীকৃতির ব্যাপারে ধীরে চলো নীতির ব্যাপারে একমত হয়েছে।মোটকথা, আফগানিস্তানে মানবিক দুর্যোগ প্রতিরোধে পশ্চিমা এবং আশেপাশের দেশগুলো সহায়তা অব্যাহত রাখার কথা জানালেও তারা দেশটিতে তালেবান সরকারকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি এবং দেয়নি ব্যাপক পরিসরে সাহায্য-সহযোগীতার আশ্বাস যাতে করে তালেবানরা ফেলতে পারে স্বস্তির নিঃশ্বাস । আর এসব কারনে তালেবান প্রসাশন ধুকছে এবং আফগান জনগন ভূগছে নানা সমস্যায়।


ছবি- বিবিসি

নগদ অর্থের অভাবে ধুকছে তালেবান আর ভূগছে আফগান জনগণ -

দেশ পরিচালনার জন্য নগদ অর্থের ব্যাপক সংকটে ভূগছে তালেবানরা। এজন্য বিদেশে থাকা আফগানিস্তানের অর্থ ফেরত দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কাছে বহুবার দাবি জানিয়েছে তালেবান সরকার ও তাদের শুভাকাংখীরা। শুক্রবার (২৯/১০/২১) ব্রিটেনভিত্তিক আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সে প্রকাশিত আফগানিস্তানের অর্থ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আহমদ ওয়ালি হাকমালের এক সাক্ষাতকারেও এই দাবি জানান তিনি। রয়টার্সকে আহমদ ওয়ালি হাকমাল বলেন, "এই অর্থ আফগান জনগণের। আমাদেরকে শুধু আমাদের অর্থই ফেরত দিন। এই অর্থ আটকে রাখা অনৈতিক এবং সকল আন্তর্জাতিক আইন ও মূল্যবোধের বিরোধী"।

যুক্তরাষ্ট্রে আফগানিস্তানের প্রায় নয় শ' কোটি ডলারের তহবিল গচ্ছিত রয়েছে। অপরদিকে জার্মানির কমার্স ব্যাংকে ৪৩ কোটি ১০ ডলার ও সেন্ট্রাল ব্যাংকে নয় কোটি ৪০ লাখ ডলার সঞ্চিত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ও ইউরোপের বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে থাকা আফগানিস্তানের অর্থ চলতি বছরের আগস্টে দেশটির প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ তালেবানের নেয়ার পর থেকেই আটকে দেয়া হয়েছে।আফগান সেন্ট্রাল ব্যাংকের এক বোর্ড সদস্য শাহ মেহরাবি রয়টার্সের কাছে সাক্ষাতকারে বলেন, " আফগানিস্তানে অর্থনৈতিক ধস এড়াতে ইউরোপীয় দেশ বিশেষ করে জার্মানিকে দেশটিতে থাকা আফগান অর্থ ছেড়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন"।তিনি বলেন," অবস্থা খুবই গুরুতর এবং অর্থের পরিমাণ কমে আসছে। এই বছরের শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তানকে চালিয়ে নেয়া যাবে"। মেহরাবি আরো বলেন," যদি আফগানিস্তান তার অর্থ না পায়, তাহলে ইউরোপও প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত হবে আফগান সমস্যায়"। তিনি বলেন, " আপনি রুটি না পাওয়া ও তার জন্য সামর্থ্যবান না হওয়ার দ্বিমুখী বিপদে পড়ছেন। জনগণ বেপরোয়া হয়ে উঠবে। তখন তারা ইউরোপে যাবে"।

তালেবানদের কাছে কাবুলের পতন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের হতবাক করেছে। মার্কিন সেনাধ্যক্ষ বলছেন, কাবুলে আমেরিকার হিসাবের অঙ্ক ভুল হয়ে গেছে। কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর মাত্র ৩ মাসেই তালেবানরা এখন নগদ অর্থের অভাবের সাথে সাথে আরো বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত যা থেকে বেরিয়ে আসতে তাদের দূরদর্শী সিদ্ধান্তের সাথে সাথে বাকী বিশ্বের সাহায্য সহযোগীতা জরুরী এসব চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে একটি স্থিতিশীল আফগানিস্তানের জন্য এবং জরূরী তালেবানদের সাথে সাথে বাকী বিশ্বের ভালোর জন্যও।


ছবি - বিবিসি

১। আফগানিস্তানের বেহাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি -

যে কোন দেশের জন্য স্থিতিশীল অর্থনৈতিক বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, যার জন্য দরকার অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক অর্থের সুষম প্রবাহ। দীর্ঘ যুদ্ধকালীন সময়ে আফগানিস্তানকে ব্যাপকভাবে বিদেশী অর্থের ওপর নির্ভরশীল করে রাখা হয়েছে। আফগানিস্তানের মোট আয়ের ২০ শতাংশ বিদেশী সহায়তা। সেগুলো এখন বন্ধ। উপরন্তু আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৯.৫ বিলিয়ন ডলার ফ্রিজ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল কর্মসূচি স্থগিত করায় পরিস্থিতি তীব্রতর হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে যখন নগদ অর্থ ও মানবিক সহায়তা দরকার সেখানে অর্থসম্পদ আটক করে রাখা হয়েছে, যা চরম ন্যক্কারজনক। আফিম বাণিজ্য তালেবানদের ৩০০ মিলিয়ন থেকে ১.৬ বিলিয়ন ডলার দিতে পারে। বার্ষিক বাজেটের জন্য ৫.৫ বিলিয়ন ডলার দরকার। বিশ্লেষকরা মনে করেন চীন, রাশিয়া, তুরস্ক, পাকিস্তান ও ইরান আর্থিক সহায়তা দিয়ে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ কাজে লাগাবে।

আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারকরা চলতি বছর ১৩ সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানের জন্য প্রায় এক বিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব গুতেরেস আফগান শিশু ও অন্যান্য দুর্বল জনগণকে অনাহার থেকে রক্ষার জরুরি আবেদন জানানোর পর এই প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। তবে গুতেরেস কমপক্ষে ৬০৬ মিলিয়ন ডলার চেয়েছিলেন।মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগ ও ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি) বলেছে, দেশটি আফগানিস্তানকে ৬৪ মিলিয়ন ডলার দেবে যাতে ‘নিরাপত্তাহীনতা, সংঘর্ষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও কোভিড-১৯ মহামারীর জটিল প্রভাবের মুখোমুখি আফগানদের সরাসরি জীবনরক্ষাকারী সহায়তা দেয়া হয়।’ ইউনিসেফের হেনরিয়েটা জানান, ১০ লাখ আফগান শিশু পুষ্টিহীনতার মুখে পড়বে।

তালেবানরা নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর তিন কোটি ৮০ লাখ লোকের আফগানিস্তান বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মার্কিন নিয়ন্ত্রিত সম্পদ পরিচালিত বিভিন্ন সহায়তা প্রকল্প থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) অনুমান করেছে, আফগানরা এ বছর ৪০ শতাংশ ফসল হারিয়েছে,তাই গমের দাম ২৫ শতাংশ বেড়েছে।যদিও পাকিস্তান খাদ্য ও ওষুধ পাঠিয়েছে, ইরান মানবিক সহায়তা পাঠিয়েছে। তুরস্ক পাকিস্তানের মাধ্যমে শুকনো খাবার পাঠিয়েছে। চীন ৩১ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে তবে এসব মানবিক সাহায্য প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল।

২। দক্ষ প্রশাসন -

বর্তমানে তালেবানদের মূল দ্বিতীয় যে সমস্যা মোকাবিলা করতে হচছে তা হলো দক্ষ প্রসাসকের অভাব বা দক্ষ প্রশাসন।দীর্ঘদিন দখলদারদের কবলে থাকার ফলে দেশে দক্ষ লোক সেভাবে গড়ে উঠেনি বা দখলদাররাও সেভাবে চেষ্টা করেনি । সঠিকভাবে দেশ পরিচালনার জন্য দরকার দক্ষ প্রশাসন তথা প্রশাসকের যার কোন বিকল্প নেই। তালেবানদের দেশ পরিচালনার টেকনোক্র্যাটিক অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে,অভাব রয়েছে দেশে দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোকের। সরকারি পরিষেবা ও অর্থনৈতিক বিষয় পরিচালনার জন্য দরকার সুদক্ষ ও পেশাদার লোকবল। অনেক পেশাদার তালেবানের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। দক্ষ প্রশাসনের জন্য দরকার আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ লোকজন যা দেশে তৈরী হতে সময় লাগবে এবং বর্তমানে জরুরীভাবে তাদের দরকার । আর তাই তালেবানদেরকে নিতে হবে উদারনৈতিক সিদ্ধান্ত যাতে করে বিদেশ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ লোকজন আসতে পারে তাদের সাহায্যের জন্য।

৩। বহুধাবিভক্ত (গোষ্ঠী) আফগান জাতি -

পুরো আফগানিস্তান নানা-জাতি গোষ্ঠীতে বিভক্ত এবং প্রত্যেকেই শক্তিশালী একক আফগান থেকে তার নিজস্ব জাতি গোষ্ঠীকে শক্তিশালী দেখতে চায়। আর এজন্য তালেবান গোষ্ঠীর ভেতরেও রয়েছে ভিন্নমত। এদের মাঝে কেউ কেউ চরমপন্থী মানসিকতার এবং কেউ মধ্যপন্থী। যেমন- সামরিক নেতা সিরাজউদ্দিন হাক্কানি চরমনীতির প্রবক্তা এবং সামরিক প্রধান মোহাম্মদ ইয়াকুব ও জুরিস্ট আবদুল হাকিম মধ্যপন্থী। তালেবান নেতা হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা সংঘর্ষ এড়াতে ইয়াকুব ও হাক্কানির মধ্যে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ বিভক্ত করেছেন। এটি তেমন ভালো কাজ হয়নি। অথচ দেশ গঠনের জন্য তাদের সবাইকে এখন একসাথে মিলেমিশে কাজ করা জরুরী।

৪। তিন মাসেও নেই কোন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি -

তিন মাসের উপর হয়ে গেছে তালেবানদের ক্ষমতা দখল তবে এখন পর্যন্ত সারা দুনিয়া থেকে একটি দেশও তাদের স্বীকৃতি দেয়নি। যত দ্রুত তালেবানদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলবে তত তাড়াতাড়ি তারা দেশের সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পাশে পাবে। তবে এর জন্য তালেবানদের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ নীতির ওপর কাজ করতে হবে। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার এবং অপরটি নারী ও সংখ্যালঘুদের বিশেষ অধিকার দেয়া। তাদের আরো নিশ্চিত করতে হবে যে, আফগান মাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না সেটি যত তিক্তই হোক।

৫। তিন মাসেও নেই কোন স্থায়ী সরকার ও সংবিধান -

তালেবানদের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সরকার ও সংবিধান। তালেবানরা গণতন্ত্রের পশ্চিমা ধাঁচকে অনুসরণ করছে না এটা নিশ্চিত আর তাই দেশ পরিচালনার সিদ্ধান্ত ও নীতির জন্য সুপ্রিম স্টেট কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই কাউন্সিল একজন আমিরের অধীনে কাজ করবে, তবে সংবিধান সম্পর্কে অনেক কথা রয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছিল, ইরানি মডেল অনুসরণ করবে, এখন সেই অবস্থানেও নেই। বেশি প্রচারিত হয়েছিল, " আফগানিস্তান ইসলামিক আমিরাত" হবে। এখন দেখা যাচ্ছে, আফগানিস্তান কিংডম বা বাদশাহর শাসন হচ্ছে, এটি বেশ অবাক করা কথা। কিং জহির শাহের সময় যে সংবিধান ছিল, সেটি আবার চালু করা হবে।

আজ পর্যন্ত আফগানিস্তানে আটটি সংবিধান রচিত হয়েছে। সর্বশেষ সংবিধানটি ২০০৪ সালে বানানো হয়।

১। আফগানিস্তানের প্রথম সংবিধানটিকে " নিজামনামা " বলা হতো। এক হাজার ডেলিগেট ১৯২৪ সালে এটি অনুমোদন করেছিলেন। ২। এর সাত বছর পর নাদির শাহের প্রশাসন আসে। তিনি একটি সংবিধান তৈরি করেন সেটি দ্বিতীয় সংবিধান। ওখানে যে মৌলিক বিষয় ছিল তাতে ইসলামী সরকার বা ইসলামী হুকুমতের কথা ছিল, ওই সংবিধানে ১১০ আর্টিকেল ছিল, সংবিধানের সব কিছুই ইসলামী ও ইসলামী আইনকানুনকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল।
৩। এরপর ১৯৬৪ সালে আসে জহির শাহের সংবিধান। সেখানে ১১ চ্যাপ্টার ও ১২৮ আর্টিকেল স্থান পায়।
৪। এরপর আসেন প্রেসিডেন্ট দাউদ, ১৯৭৩ সালে তিনিও একটি সংবিধান রচনা করেন যেখানে ১৩ চ্যাপ্টার ও ১৩৬ আর্টিকেল সংযুক্ত করা হয়। মানে যিনি আসেন তিনি একটি সংবিধান রচনা করে দেশ পরিচালনা করেছেন। ১৯৭৮ সালে দাউদের পতন হয়েছিল।
৫। বারবাক কারমাল যখন আসেন তখনো নতুন সংবিধান বানানো হয়, সেখানে যে মূলনীতি ছিল সেখানে দেশকে ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব আফগানিস্তান বলা হয়েছে। ১৯৮০ সালে এই সংবিধানে কিছু সংশোধন করা হয়। তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বারা আক্রান্ত ছিল আফগানিস্তান।
৬। বারবাক কারমালের সাত বছর পর ডঃ নাজিবুল্লাহ আসেন ক্ষমতায়। তিনি আবারও একটি সংবিধান বানান, সেখানে ১৩ চ্যাপ্টার ও ১৩৯ আর্টিকেল ছিল। তিন বছরের মধ্যে এই সংবিধান তিনবার অ্যামেন্ডমেন্ট করা হয়।

সোভিয়েত বাহিনী যখন দেশ ছেড়ে চলে যায়, তারপর বহুদিন পর্যন্ত দেশে কোনো সংবিধান ছিল না। হামিদ কারজাইয়ের আমলে সংবিধান বানানো হয়। ২০০৪ সালে কিছু পরিবর্তন করা হয়। নাদির খান ও দাউদ খান যে সংবিধান বানিয়েছিলেন, সেগুলোকে দেশের সবচেয়ে " বাজে সংবিধান" হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সব শাসক নিজের সুবিধামতো সংবিধান বানিয়েছেন। অন্য দিকে ১৯৯৮ সালে তালেবানরা ক্ষমতায় থাকার সময় প্রথম সংবিধান সম্পাদনা করেন, যাকে " দস্তুর এমারাত ইসলামী " বলা হয় এবং দ্বিতীয়টি " মনশুর এমারাত ইসলামী আফগানিস্তান" যা ২০২০ সালে ফাঁস হয়েছিল কিন্তু তালেবানরা এটিকে সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করেনি।

লক্ষণীয় বিষয়, সংবিধান সম্পর্কে তালেবান অ্যাক্টিং মিনিস্টার অব জাস্টিসের সাথে চীনা দূতের সাক্ষাৎ ঘটে ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ সালে। আলোচনায় আসে যে, বাদশাহ জহির শাহের আমলের সংবিধান অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য চালু রাখা হবে। ইসলামী শরিয়াহ বা আমিরাতের নিয়ম ধারাবিরোধী বিধি এবং আন্তর্জাতিক আইনের নিয়মকানুন যা শরিয়তবিরোধী নয় সেসবও মেনে চলবে। তা হলে অবস্থা দাঁড়াচ্ছে - খেলাফতের যিনি আমিরুল মুমিনিন তিনি আপাতত বাদশাহের মতোই কাজ করবেন। কেননা সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপ্রধান একজন বাদশাহ বা রাজা। এখানে ইসলামী আমিরাতে তালেবানদের সূক্ষ্মবুদ্ধি কাজ করছে। তবে পুরো বিষয়টি এখনো দেখার মতো অবস্থায়। কখন কোন দিকে মোড় নেয়, তা বলা দুষ্কর।


ছবি - গালফ নিউজ

৬। আইএস ইস্যু -

তালেবানদের সামনে সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জ বা প্রতিপক্ষ বাহিনী থেকে উদ্ভূত তা হলো আইএস ইস্যু। তালেবান ও আইএস উভয়ই সুন্নি চরমপন্থী গোষ্ঠী, কিন্তু তারা মিত্র নয়, প্রতিদ্বন্দ্বী । আইএসের উদ্দেশ্য আফগানিস্তানে আইএস খোরাসান প্রদেশ প্রতিষ্ঠা করা। আইএস ও তালেবান ২০১৫ সাল থেকে আফগানিস্তানে আইএস প্রবেশের সময় থেকে যুদ্ধে রয়েছে।বিশ্লেষকরা তালেবানকে আইএসের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ হিসেবে দেখছেন। আফগানিস্তানে আইএসের উপস্থিতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের জন্য একটি সাধারণ সম্পর্কের ভিত্তি রচনা করে ফেলেছে। ক’দিন আগে দোহা আলোচনায় আইএস দমনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র কমান্ডো পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিল যদিও তালেবানরা বাইরের শক্তির প্রয়োজন নেই বলে সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি।

৭। দেশের অভ্যন্তরে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব -

এতদিন দেশের সবাই দখলদারদের বিরুদ্ধে মিলেমিশে যুদ্ধ করেছে এখন ক্ষমতার লোভে আফগানিস্তানে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর অভ্যন্তরে দেখা দিয়েছে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। ফলে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি আরো অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ক’দিন আগে হামিদ কারজাই বিমানবন্দরের বাইরের গেটে আরেক দফা ভয়াবহ বোমা হামলাকে তারই অংশ মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। আফগানিস্তানে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করা একাধিক স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা দফতরের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তালেবানের সবগুলো ফ্রন্ট একাট্টা হয়ে লড়লেও যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা চলে আসায় সে লক্ষ্যের সমাপ্তি ঘটেছে। এখন নিজেরা সরকার গঠনের সময় গোষ্ঠীটির বিভিন্ন ফ্রন্টের নেতাদের মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। ফলে তারা রাজনৈতিক সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়েছে।

৮। আফগানিস্তানের জটিল ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি -

আমরিকার আফগান যুদ্ধ একেবারে শেষ হয়নি শুধু ফর্ম পরিবর্তন হয়েছে। মূলত নিকট ভবিষ্যতেও আফগানিস্তান থেকে মার্কিনিরা কখনো পুরোপুরী বের হতে পারবে না। ডেনিয়েল মার্ক তার বইতে এরকম কথা বলেছিলেন, " নো এক্সিট ফর্ম আফগানিস্তান "। কাবুল ও এ অঞ্চল থেকে আমেরিকানরা একেবারে যেতে পারবে না, কেন ? সোজা উত্তর - চীন ও অংশত রাশিয়া। মার্কিন সমর বিশারদরা মনে করেন, চীনের সাথে সমুদ্রে যুদ্ধের চেয়ে ভূস্থলের যুদ্ধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে। সেই ভূভাগ মার্কিনিদের প্রয়োজন। এখন যত প্রিয় বা অপ্রিয় হোক, ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়তে পারে না একই কারণে। একই সাথে আরেক বিরাট আফগানিস্তান তৈরি হচ্ছে মধ্য এশিয়াজুড়ে। রাশিয়া অনেকটা কব্জা করে রেখেছে মধ্যএশিয়ার প্রায় সব ক’টি দেশ। চীন ও আমেরিকাও সেখানে নিজের স্বার্থ রক্ষায় বিবিধ কর্মসূচি রেখেছে বহুদিন ধরে। এখন চীন মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তানে ঢুকছে। মার্কিনিদের মাথাব্যথার কারণ পাকিস্তানও কম নয় - দেশটি পরমাণু শক্তিধর । এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্র বিশাল এই মাঠ ছেড়ে দিতে পারবে না। তাই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানকে লক্ষ্য করে আশপাশেই থাকবে। আফগান সীমান্ত থেকে মাত্র ২০০ মাইল দূরে তাজিকিস্তানে ভারতের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। সেটি ড্রোন ঘাঁটি। এই ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজনে ব্যবহার করবে। রাশিয়াও এ বিষয়ে সবুজ সঙ্কেত দেখিয়েছে। আবার তাজিকিস্তানের সাথে তালেবানদের ভালো সম্পর্ক নেই।

তাজিক-আফগান সীমান্তে যুদ্ধাবস্থাও একটি জটিল সমস্যা তালেবানদের জন্য। আফগানিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে এই বিবাদ শুরু হয়েছে। তালেবানরা আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য তাজিকের নিন্দা জানিয়েছে। আহমেদ মাসউদ ও সাবেক আফগান ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ উভয়ই জাতিগতভাবে তাজিক। দুই নেতাই বর্তমানে তাজিকিস্তানের আশ্রয়ে রয়েছেন। সাবেক আফগান সরকারি কর্মকর্তাদের নিরাপদ আশ্রয় ও সহায়তা দিয়েছে তাজিকিস্তান। পাঞ্জশির উপত্যকায় তালেবানবিরোধী প্রতিরোধ বাহিনীকে তাজিক সরকার সহায়তা করছে বলেও জানা গেছে। পাকিস্তান হস্তক্ষেপ না করলে পাঞ্জশির জয় এত সহজ হতো না তালেবানদের জন্য।এদিকে তাজিকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এমোমালি রাহমন কাবুলে তালেবান নিযুক্ত মন্ত্রিসভাকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেছেন। পাঞ্জশির প্রদেশে তালেবানদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও করেছেন তিনি। এক ভাষণে তিনি আফগানিস্তানের পরিস্থিতিকে ‘অস্থিতিশীল’ বলেছেন।

জাতিগত তাজিকরা আফগানিস্তানের জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশেরও বেশি। তালেবান সদস্যরা প্রধানত সবচেয়ে বড় জাতিগত গোষ্ঠী পশতুনদের অন্তর্ভুক্ত। রেষারেষি ও উত্তেজনার মধ্যে তালেবান-তাজিকরা যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হলে কেউ সমর্থন পাবে না। তাজিকিস্তানের রাষ্ট্রপতি এমোমালি রাহমন অভিযোগ করেছেন, বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আফগানিস্তানে সক্রিয় থাকায় আবারো দেশটি সন্ত্রাসবাদের প্লাটফর্ম হতে পারে।উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তানের তাখার প্রদেশ তাজিকিস্তানের সাথে আফগান সীমান্ত। তাজিকিস্তানের গোর্নো-বাদাখশান স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে রাশিয়ান সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। ভারতেরও শক্তিশালী বিমান ঘাঁটি রয়েছে ওই অঞ্চলে। ভারতের তীর পাকিস্তানের দিকে হলেও এখন পুরো এলাকা তাদের লক্ষ্যবস্তু। উল্লেখ্য, ভারত, রাশিয়া ও তাজিকিস্তান তালেবান সরকারের সমালোচনা করে চলেছে এবং কেউ স্বীকৃতি দেয়নি। কাবুলকে চাপে রাখতে তালেবান-সীমান্তে উসকানি তাজিকিস্তানের একটি কৌশল।

৯। আত্মঘাতি হামলা / বোমা হামলা -

আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে মঙ্গলবার (০২/১১/২০২১) দুইটি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। কাবুলের ১০ম ডিস্ট্রিক্টে সরদার মোহাম্মদ দাউদ খান সামরিক হাসপাতালের কাছে এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণে অন্তত ১৯ জন ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।বিস্ফোরণের ঘটনায় আরো ৪৩ ব্যক্তি আহত হয়েছেন।সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাকে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, গাড়ি বোমা হামলার মাধ্যমে এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।তাৎক্ষণিকভাবে হামলার দায়িত্ব কেউ স্বীকার করেনি।

আগস্টে আফগান প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ তালেবানের নেয়ার পর থেকে দেশটিতে উগ্রবাদী সংগঠন আইএসের তৎপরতা বেড়েছে। আফগানিস্তানের ওপর তালেবানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর মোট মোট চারটি হামলায় আইএস দায়িত্ব স্বীকার করে। এর মধ্যে ২৬ আগস্ট আফগানিস্তান থেকে বহুজাতিক বাহিনীর প্রত্যাহারের মধ্যেই কাবুল বিমানবন্দরে এক বোমা হামলায় ১৩ মার্কিন সৈন্যসহ ১৮০ জনের বেশি লোক নিহত হয়। এছাড়াও,আফগানিস্তানের কুন্দুজ প্রদেশের শিয়া মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলার দায় স্বীকারে করেছে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস। গত শনিবার (৯ অক্টোবর) প্রতিবেদনে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়র্টাস।দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম বখতার নিউজ এজেন্সির বরাতে রয়টার্স জানিয়েছিল, শুক্রবার জুমার নামাজে হামলায় ৪৬ জন নিহত এবং ১৪৩ জন আহত হয়েছেন। তবে স্থানীয় হাসপাতালের দুই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলছিলেন, নিহতের সংখ্যা ৭০ থেকে ৮০ হতে পারে।


তালেবানদের সামনে রয়েছে আরও অসংখ্য সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ। যেমন - হাজরা নিয়ে ইরানের সাথে বিরোধ, পাকিস্তানের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে নতুন বিরোধের সূত্রপাত, পাকিস্তানের তেহরিকে তালেবান ইস্যু,নারীদের সমতা-ক্ষমতা-শিক্ষার আন্দোলন, মানবিক সহায়তার দ্বার উন্মুক্তকরণ, খাদ্যাভাব দূর করা, দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরা, বিদেশে আফগানিস্তান থেকে পলানো বিভিন্ন পেশাজীবীদের তালেবানবিরোধী প্রচারণা বন্ধ করা, শীতকালীন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা, নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসন।

আফগানিস্তানে ক্ষমতার দৌড়ে এগিয়ে থাকতে যে দু’টি ফ্রন্ট বেশি তৎপর, তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে তালেবানের হেলমান্দভিত্তিক ফ্রন্ট, অন্যটি হাক্কানি নেটওয়ার্ক। হেলমান্দভিত্তিক ফ্রন্টের দাবি, " মার্কিন ড্রোন হামলায় তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যাপক প্রাণহানি সত্ত্বেও তারা লড়াই চালিয়ে গেছে। ফলে তাদের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে"। ন্যাটো সেনাদের ফেলে যাওয়া সামরিক সরঞ্জাম প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্রন্টগুলো গোপনে সরিয়ে নেয়া নিয়ে তালেবান নেতৃত্বের অস্বস্তি দূর করে শান্তি সমঝোতা স্থাপন, পদবঞ্চিত তালেবান নেতাদের সমঝোতাকরণ, অতি-রক্ষণশীল কট্টরপন্থীদের শরিয়াহ আইনের কঠোর সংস্করণ প্রয়োগ ও মধ্যপন্থীদের কিছুটা ছাড় দেয়ার মনোভাব নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই তালেবানদের বিভাজনের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। যারা দালালি করেছে, সেসব নাগরিককে তালেবানের জ্যেষ্ঠ নেতারা ক্ষমা করলেও তালেবানের অন্য ফ্রন্টগুলো ও যোদ্ধারা তা মানতে চান না। ফলে যেকোনো সময় সায়গনের মতো "ঠাণ্ডা হওয়ার পর আবার রক্ত প্রবাহের" আশঙ্কা করা হচ্ছে। এসব নিয়ে তালেবানের নাভিশ্বাস উঠছে। যেকোনো ইস্যুই আফগানিস্তানে দীর্ঘমেয়াদে অশান্তির কালো আবরণ উন্মুক্ত করতে পারে।

৩০ বছর যুদ্ধ, সঙ্ঘাত, অস্থিরতা ও দুর্নীতির ফলে আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে পড়েছে যা কোন রকম জোড়াতালি দিয়ে এতদিন আমেরিকানরা চালিয়েছিল।এখন তালেবানরা যদি ১৪টি জাতিগোষ্ঠী সমন্বয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠন ও পরিচালনায় সফলতা দেখাতে পারে, রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান ঘটিয়ে এবং সামাজিক শৃঙ্খলা, সুশাসন ও জননিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে পারে, তবে তিন ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের উত্তোলনযোগ্য যে পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে এগুলোর প্রযুক্তিভিত্তিক সদ্ব্যবহার করার পথ খুলে যাবে। তখন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসতে আগ্রহী হবে। আর তালেবান শাসিত আফগানিস্তানও অর্থনৈতিকভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।

আর এসবের জন্য তালেবান সরকারকে মুসলিম বিশ্বসহ গোটা দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। আধুনিক বিশ্বে একলা চলো নীতি অচল। ইসলামের বিধিবিধানের আওতায় অবস্থান করলেও তালেবানদেরকে উদারতা দেখাতে হবে এবং আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন বিবেচনায় রাখতে হবে। ন্যায়বিচার, সামাজিক নিরাপত্তা, সুশাসন, নারীশিক্ষা, সংখ্যালঘুর অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারকে সমুন্নত রাখতে হবে অগ্রাধিকারভিত্তিতে। সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে হবে ভারতের সাথেও ।এক কথায় , সারা দুনিয়ার সবার সাথে সুসম্পর্ক এবং বাস্তবমুখী সিদ্ধান্তই তালেবানদের সফল হতে সাহায্য করতে পারে। মোটকথা হলো,বৈদেশিক সাহায্যনির্ভরতা কমিয়ে অর্থনৈতিকভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাইলে তালেবানদেরকে আরো দায়িত্বশীল, চৌকস ও কুশলী ভূমিকা পালন করতে হবে। নিজেদের বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠির মধ্যে মধ্যে ঐক্যের বন্ধন তৈরি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্টকারী শক্তিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে তালেবানদেরকে দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। দেশ পরিচায়নায় ইতিপূর্বে তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বকেও এগিয়ে আসতে হবে তালেবানদের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য যাতে করে তারা এসব সমস্যার সমাধান করে কাংখিত লক্ষ্যে পৌছতে পারে এবং উপহার দিতে পারে আফগান জনগন ও বিশ্বকে একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ আফগানিস্তান ।

তথ্যসূত্র ও সহযোগীতায় - রয়টার্স, বিবিসি,আল জাজিরা,এপি, এএফপি,এবং নয়া দিগন্ত ।

===============================================================

পূববতী পোস্ট -


তালেবানদের কাবুল দখল পরবর্তী ফলোআপ পোস্ট - ৬ Click This Link
" বৈদেশিক সাহায্য বন্ধ ও বৈদেশিক রির্জাভ আটক এবং আফিম চাষ বন্ধ " কিভাবে বের হবে তালেবানরা এ অর্থনৈতিক সংকট থেকে ? বিকল্প কোন জিনিষ টেকসই হতে পারে আফগান অর্থনীতির জন্য ?

তালেবানদের কাবুল দখল পরবর্তী ফলোআপ পোস্ট - ৫ Click This Link
"ঝড়ের গতিতে আফগানিস্তান দখল করা তালেবানদের এক মাসেই ঘরে-বাইরে'র নানা সমস্যায় বেহাল অবস্থা । টিকে থাকতে পারবে কি তালেবানরা বা তাদের টিকে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু" ?

তালেবানদের কাবুল দখল পরবর্তী ফলোআপ পোস্ট - ৪ Click This Link
" আমেরিকার আফগানিস্তান থেকে বিদায় " - এর ফলে বিশ্ব ব্যবস্থা ও পরিস্থিতিতে পরিবর্তনের কোন সম্ভাবনা আছে কি বা বিশ্বে পশ্চিমা আধিপত্যের প্রভাবের পরিবর্তনের সম্ভাবনা কতটুকু?

তালেবানদের কাবুল দখল পরবর্তী ফলোআপ পোস্ট - ৩ Click This Link
"তালেবানদের আফগান শাসনের রোডম্যাপ (ইশতেহার) প্রকাশ । কোন পথে এবং কতদূর নিয়ে যেতে চাচ্ছে তালেবানরা আফগানিস্তানকে"?

তালেবানদের কাবুল দখল পরবর্তী ফলোআপ পোস্ট - ২ Click This Link
" তালেবানদের আফগানিস্তান দখল " - কেন এবং কি কারণে আফগান সেনাদের এত দ্রুত পরাজয়?

তালেবানদের কাবুল দখল পরবর্তী ফলোআপ পোস্ট - ১ Click This Link
" আফগানিস্তানে আমেরিকার ২০ বছর " - আমেরিকা কি নিয়ে এবং আফগানিস্তানকে কোথায় রেখে যাচছে ? এ ব্যাপারে বিশ্ব নেতৃবৃন্দদের প্রতিক্রিয়া কি ?
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০২১ দুপুর ১:০৪
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×