১ ম পর্বের লিংক - Click This Link
১ ম পর্বের শেষে -
পুতিন আসলে কী চান
সোজা কথায় পুতিন চান ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হতে পারবে না। তিনি পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে এ নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন যে ন্যাটো আর এ অঞ্চল থেকে নতুন করে কোনো দেশকে সদস্য করবে না। কিন্তু পশ্চিমারা তাতে রাজি হয়নি। পুতিন মনে করছেন, পশ্চিমারা ন্যাটোর বাহিনী দিয়ে চারদিক থেকে রাশিয়াকে ঘিরে ফেলে ব্ল্যাকমেল করতে চাইছে। এ কারণে তিনিও পাল্টা ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
ইউক্রেন নিয়ে পুতিনের বক্তব্য -
যদিও পুতিন সবসময়ই বলে আসছেন ইউক্রেনে অভিযান চালানোর কোন ইচছা তার নেই তার পরও এ নিয়ে আমেরিকার প্রচারণা থেমে নেই। আমেরিকার এবং ন্যাটো সামরিক জোটের সদস্যরা বলছে রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক হামলার পরিকল্পনা করছে, যে অভিযোগ অবশ্য রাশিয়া বার বার অস্বীকার করেছে। ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে এই প্রথম তার খোলামেলা কিছু বক্তব্যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন অভিযোগ করেন তার দেশকে ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধে জড়াতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন আমেরিকার মূল লক্ষ্য হচ্ছে যুদ্ধের অজুহাতে রাশিয়ার ওপর আরো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। প্রেসিডেন্ট পুতিন আরো বলেন, পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো জোট নিয়ে রাশিয়ার যেসব উদ্বেগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সেগুলোকে পাত্তাই দিচ্ছেনা। তিনি বলেন পূর্ব ইউরোপে নেটোর সম্প্রসারণ বন্ধ সহ নিরাপত্তার যেসব গ্যারান্টি রাশিয়া চাইছিল, যুক্তরাষ্ট্র তা অগ্রাহ্য করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর কাছে রাশিয়ার দাবি কী?
ইউক্রেন এখনো ন্যাটোর সদস্য নয়। তবে তাদের সাথে ন্যাটোর সখ্যতা আছে। ভবিষ্যতে কোনো একদিন তারা ন্যাটো জোটের সদস্য হবে, এরকম একটা বোঝাপড়া আছে। তবে রাশিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে এরকম একটা নিশ্চয়তা চায়, যেন এটা কখনোই না ঘটে। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো এরকম নিশ্চয়তা দিতে রাজি নয়।
প্রেসিডেন্ট পুতিন মনে করেন, পশ্চিমা শক্তি আসলে ন্যাটো জোটকে ব্যবহার করে চারিদিক থেকে রাশিয়াকে ঘিরে ফেলছে। তিনি চান ন্যাটো যেন পূর্ব ইউরোপে তাদের সামরিক তৎপরতা কমিয়ে আনে। তিনি বহুদিন ধরে অভিযোগ করে যাচ্ছেন যে ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো জোটকে পূর্বদিকে সম্প্রসারণ করা হবে না বলে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেটি তারা রাখেনি। তবে ন্যাটো রাশিয়ার এই কথা প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলছে, ন্যাটো জোটের মাত্র অল্প কটি দেশের সাথে রাশিয়ার সীমান্ত রয়েছে, আর ন্যাটো হচ্ছে একটি আত্মরক্ষামূলক সামরিক জোট। অনেকের বিশ্বাস, ইউক্রেনকে ঘিরে রাশিয়ার যে বিরাট সৈন্য সমাবেশ, তার উদ্দেশ্য আসলে রাশিয়ার নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিষয়গুলো যাতে পশ্চিমারা গুরুত্বের সাথে নেয়, সেজন্য ন্যাটোকে বাধ্য করা।
তবে ইউক্রেনকে ন্যাটো সামরিক জোটে ঢুকতে না দেয়ার যে দাবি রাশিয়া জানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র তা নাকচ করে দিয়েছে। রাশিয়া যখন ইউক্রেনে হামলা চালাতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে, তখন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন রাশিয়ার কাছে পাঠানো এক আনুষ্ঠানিক জবাবে একথা জানিয়েছেন। ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল জেন্স স্টোলটেনবার্গ বলেছেন, তাদের সামরিক জোটের জবাবও মস্কোর কাছে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, রাশিয়ার উদ্বেগের বিষয়গুলো তিনি শুনতে রাজি আছেন, কিন্তু এটাও বুঝতে হবে প্রত্যেকটি দেশের তার মতো করে নিজের প্রতিরক্ষার পথ বেছে নেয়ার অধিকার আছে।
রাশিয়ার মতো সামরিক পরাশক্তির দেশ কেন নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন?
ব্রিটিশ সাংবাদিক টিম মার্শাল তার লেখা বেস্টসেলার ‘প্রিজনার্স অব জিওগ্রাফি’ বইতে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, অনেক ভাবতে পারেন রাশিয়ার মতো এত বড় একটি সামরিক ক্ষমতাধর দেশকে কে আক্রমণ করতে চাইবে। কিন্তু রাশিয়া নিজে বিষয়টি সেভাবে দেখে না। এর যথেষ্ট ভিত্তিও আছে। গত ৫০০ বছরে রাশিয়া বহু বিদেশী শক্তির আক্রমণের মুখে পড়েছে, আর এই সবগুলো আক্রমণই এসেছে উত্তর ইউরোপের সমতল ভূমি দিয়ে।
১৬০৫ সালে পোলিশরা আক্রমণ চালিয়েছিল এই পথ ধরে। এর পরে আসে সুইডিশরা। ১৮১২ সালে নেপোলিয়নের নেতৃত্বে হামলা চালায় ফরাসীরা। জার্মানরা রাশিয়ায় অভিযান চালিয়েছে দুবার - ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, আবার ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। ১৮১২ সালে নেপোলিয়নের সময় থেকে হিসাব করলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত গড়ে প্রতি ৩৩ বছরে রাশিয়াকে উত্তর ইউরোপের সমতলভূমিতে একবার করে যুদ্ধ করতে হয়েছে। কাজেই রাশিয়ার ধারণা, তাদের দেশের জন্য কোনো নিরাপত্তা হুমকি যদি থেকে থাকে, সেটি এই পথেই আসবে।
১৯৯০ এর দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন যে ভেঙ্গে গিয়েছিল, সেটিকে প্রেসিডেন্ট পুতিন রাশিয়ার জন্য এক ভূরাজনৈতিক বিপর্যয় বলে মনে করেন। এরপর থেকে রাশিয়া কেবল উদ্বেগের সাথে দেখছে, কীভাবে ধীরে ধীরে সামরিক জোট ন্যাটো চারদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলছে। ১৯৯৯ সালে চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ড যোগ দিল ন্যাটোতে। ২০০৪ সালে তাদের পথ অনুসরণ করলো বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, রোমানিয়া ও স্লোভাকিয়া। ২০০৯ সালে যোগ দিল আলবেনিয়া।এই দেশগুলো এক সময় হয় ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ অথবা ওয়ারশ সামরিক জোটের সদস্য।
জর্জিয়া, মলদোভা বা ইউক্রেনও পারলে এখনই ন্যাটো বা ইউরোপীয়ান ইউনিয়নে যোগ দেয়, কিন্তু এখন পর্যন্ত রাশিয়ার কারণেই তাদের যোগ দেয়া হয়নি। কারণ এই তিনটি দেশেই রুশপন্থী মিলিশিয়াদের শক্ত অবস্থান আছে। এই দেশগুলোর যেকোনো একটি যদি ন্যাটোতে যোগ দেয়, তা রাশিয়ার সাথে যুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ হিসেবে কাজ করতে পারে।
টিম মার্শাল লিখেছেন, "গত শতকে স্নায়ুযুদ্ধের দিনগুলোতে কে ভাবতে পেরেছিল মস্কো থেকে মাত্র কয়েক শ’ মাইল দূরে পোল্যান্ডের মাটিতে বা বাল্টিক দেশগুলোতে মার্কিন সেনা মোতায়েন করা থাকবে"? তার মতে, "ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেয়া মানে যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটোর সামরিক বাহিনী একেবারে রাশিয়ার পেটের ভেতরে এসে অবস্থান নেয়া। নিজের দোরগোড়ায় প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক উপস্থিতিকে রাশিয়া সঙ্গত কারণেই এক বিরাট নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে"।
পুতিনের খুঁটির জোর কোথায় বা ইউক্রেন সংকটে রাশিয়ার গ্যাস কেন বড় ইস্যু?
পরমাণু অস্ত্রের কথা বাদ দিলে, রাশিয়ার হাতে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র কিন্তু তার সেনাবাহিনী বা বিমান বাহিনী নয়। রাশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র তার জ্বালানি।ইউরোপের মোট তেল ও গ্যাস সরবরাহের ২৫ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। লাটভিয়া, স্লোভাকিয়া, ফিনল্যান্ড ও এস্তোনিয়ার মতো দেশগুলো রাশিয়ার জ্বালানির ওপর শতভাগ নির্ভরশীল। জার্মানির প্রায় অর্ধেক গ্যাস সরবরাহ আসে রাশিয়া থেকে। জার্মানির রাজনীতিকরা কেন রাশিয়ার সমালোচনায় অতটা সরব নয়, এ তথ্য থেকেই তা বোঝা যায়।
রাশিয়ার সবচেয়ে বড় জোর হলো তার জ্বালানি। ইউক্রেনের মধ্য দিয়েই পাইপলাইনে করে রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস যায়। এ গ্যাস সরবরাহ যদি রাশিয়া বন্ধ করে দেয়, তাহলে ইউরোপের বহু বাড়িতে রান্নার চুলা পর্যন্ত জ্বলবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো যে চারটি দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করে, সেগুলো হলো রাশিয়া, নরওয়ে, আলজেরিয়া ও কাতার। এর মধ্যে রাশিয়ার কাছ থেকে আসে ৪১ দশমিক ১ শতাংশ। মানে, প্রায় অর্ধেক। রাশিয়ার কাছ থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি করা হয় ২৬ দশমিক ৯ শতাংশ। এ ছাড়া ৪৬ দশমিক ৭ শতাংশ কাঠ ও কয়লা আমদানি করা হয় রাশিয়া থেকে।
লাটভিয়া, স্লোভাকিয়া, ফিনল্যান্ড এবং এস্তোনিয়া রাশিয়ার জ্বালানির ওপর শতভাগ নির্ভরশীল। জার্মানির প্রায় অর্ধেক গ্যাস সরবরাহ আসে রাশিয়া থেকে। রাশিয়া থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রধান গ্যাস পাইপলাইনগুলো গেছে ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে। রাশিয়ার প্রায় ৪০ শতাংশ গ্যাসের সরবরাহ যায় এ পাইপলাইন দিয়ে। ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটো যদি ‘বৈরী আচরণ’ করে, তাহলে রাশিয়া এসব সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে। এতে গোটা ইউরোপ মহাদেশ বেকায়দায় পড়ে যাবে।
ইউক্রেন প্রশ্নে ন্যাটো কি ঐক্যবদ্ধ?
প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, ইউক্রেন প্রশ্ন ইউরোপীয় নেতারা সবাই একমত। তবে বিভিন্ন দেশ যে ধরনের সমর্থন দেবে বলে কথা দিচ্ছে, তার মধ্যে পার্থক্য আছে। যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, তারা ইউক্রেনে ৭০ টনের মতো ‘মারণঘাতী সামরিক সরঞ্জাম’ পাঠিয়েছে, যাতে রণাঙ্গনের সামনের কাতারে প্রতিরোধ তৈরি করা যায়। যুক্তরাজ্য স্বল্পমাত্রার ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র দিচ্ছে ইউক্রেনকে। কিছু ন্যাটো দেশ, যেমন ডেনমার্ক, স্পেন, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডস তাদের যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধজাহাজ পূর্ব ইউরোপে পাঠাচ্ছে সেখানকার প্রতিরক্ষাকে জোরালো করতে।
তবে জার্মানি ইউক্রেনের অনুরোধ সত্ত্বেও কোনো অস্ত্রশস্ত্র দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, কারণ দেশটির নীতিই হচ্ছে কোনো সংঘাতপূর্ণ এলাকায় কোনো প্রাণঘাতী অস্ত্র না পাঠানো। পরিবর্তে জার্মানি মেডিক্যাল ত্রাণ সাহায্য পাঠাবে।তাছাড়া, ইউক্রেন সঙ্কট আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস। এর আগে ফরাসি প্রেসিডেন্টও একথা বলেছিলেন।
সম্প্রতি ওয়াশিংটন থেকে ঘুরে এসেছেন জার্মান চ্যান্সেলর। ইউক্রেন সঙ্কট নিয়ে বাইডেনের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেছেন। দেশে ফিরে আলোচনা করেছেন ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। তারপরেই তিনি জানিয়েছেন, যুদ্ধের যে আবহ তৈরি হয়েছিল, তা খানিকটা কেটেছে বলেই তিনি মনে করছেন। আলোচনার মাধ্যমেই ইউক্রেন সঙ্কটের সমাধানসূত্রে পৌঁছানো যাবে বলে তিনি আশাবাদী।
যদিও একইসঙ্গে শলৎস জানিয়েছেন, এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সময় এখনো আসেনি। পরিস্থিতি এখনো যথেষ্ট উত্তপ্ত হয়ে আছে। প্রশমনে আরো অনেক সময় লাগবে। তবে শান্তিপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে আশাবাদী তিনি।
এদিকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ অবশ্য উত্তেজনা প্রশমনের জন্য রাশিয়ার সাথে আলোচনা চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন --
চলবে -
==========================================================
তথ্যসূত্র - এএফপি,বিবিসি, রয়টার্স ও প্রথম আলো ( ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২),নয়া দিগন্ত (২৮/০১/২০২২)