(স্বপ্নের কথা গল্পে বলি)
২০১২, জুন মাস।
মেঘলা ভোর।
লালননগর স্টেশনে ট্রেন থামল।
আমরা সতর্ক হয়ে নামি। হুটোপুটি করি না। আমরা জানি আমরা কোথায় এসেছি। এখানে প্রতি পদক্ষেপে সমীহ প্রয়োজন। স্টেশনে অন্ধকার। ঝিরঝির বৃষ্টি।
স্টেশনের কাছেই হোটেল। নিরবধি। আমরা ঢাকা থেকে রিজারভেশন করেই এসেছি।
কণা ফিসফিস করে বলল, কী সুন্দর। ছিমছাম । সর্বত্র বাঙালিয়ানার ছাপ।
হু।
রিসিপসনে আব্দুল আলীমের একটা বড় পোট্রেট।
সহসা সেই গানটার কথা মনে পড়ে গেল।
চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি।
আশ্চর্য! এই গানটা আব্দুল আলীম ছাড়া অন্য কারও মুখে কখনও শোনা যায়নি। কেন?
এও এক রহস্য।
চারতলায় আমাদের ঘর। হাতমুখ ধুয়ে পরিস্কার হয়ে নিচে নেমে এলাম।
রেঁস্তোরায় ভিড়। বেশির ভাগই বিদেশি। ট্রেনেও প্রচুর বিদেশি দেখেছি। লালন এখন বিশ্বময় সেক্সপীয়রের মতোই বিখ্যাত। এরা সবাই বাঙালি গুরুর টানে লালননগর এসেছে।
আমি মাত্র বসেছি। আমার পাশে রেজা। ও আমাকে কনুই দিয়ে গুঁতাল। কি?
ওই দেখ।
কে?
জ্যঁ-মারি গুস্তাভ ল্য ক্লেজিও।
ওমা তাই তো!
২০০৮ সালে নোবেল পেয়েছেন ক্লেজিও । তিনি এক বিরল আত্মার মানুষ। একেবারেই ভিন্ন মানুষ। পশ্চিমের মানুষ হলেও তাঁর আত্মাটি প্রাচ্যের মরমী ধাচের। তিনিও লালননগরে এসেছেন।
ক্লেজিওর পাশে মহিল কে?
অরুন্ধুতী রায়। কণা বলল।
এতক্ষণে মহিলাকে চিনতে পারলাম। ছবি আগেই দেখেছি। সম্প্রতি চুলের স্টাইল বদলেছেন।
কণা বলল, দুপুরে অরুন্ধুতী রায়ের পেপার পড়ার কথা। লালন: অ্যান ইটারনাল এক্সপিডিশন।
রেজা বলল, বাউল-সেন্টারে?
কণা মাথা ঝাঁকাল, হ্যাঁ।
দুপুরের আগেই রোদ উঠল।
আমরা তিনজন রাস্তায় হাঁটছি। রাস্তাটা ছেঁউরিয়ার দিকে চলে গেছে। দু’পাশে মলিন দোকানপাট। গম্ভীর ব্যাঙ্ক। একঘেয়ে রেস্টুরেন্ট। সকালে মেঘলা থাকায় রোদ এখন ঝকঝকে। মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাই। জুন মাসের নীলাভ-ধূসর আকাশ। সাদা মেঘের ভেলা। লালন কি এই আকাশই দেখতেন। রবীন্দ্রনাথ? গড়াই নদীর জলো হাওয়া টের পাই।
নদীর ওপারে একটা কুঠিবাড়ি আছে।
কাল ওদিকটায় যাব।
আমরা লালনের মাজারে কাছাকাছি চলে আসি। জায়গাটা মেলার মতন হয়ে আছে। চিরকালের মেলা। মেলায় দেশের মানুষের ভিড়। বিদেশের মানুষের ভিড়। কী যে ভালো লাগছে। সরকারের পররাস্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক বিখ্যাত সচিবকে দেখলাম একা একা ঘুরে বেড়াতে। দেখে ভালো লাগল। এখানে কেউই স্বতন্ত্র নয়। ভিড়ের মধ্যে সুবর্ণা মোস্তফা।একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ওপারের অঞ্জন দত্তকেও দেখলাম।
দুপুরে কণা বাউল সেন্টারের দিকে চলে গেল। ও নিউ ডেজ-এ চাকরি করে। অরুন্ধুতী রায়ের ওপর একটা রিপোর্ট লিখতে হবে।
আমি আর রেজা ভিড়ের মধ্যে ঘুরছি।
বিকেলে চালাঘরের নিচে দাঁড়িয়ে গান শুনছি।
হাতের কাছে হয় না খবর
কি দেখতে যাও দিল্লী লাহোর?
লালনের এই প্রজ্ঞা।
আমরা কেই দিল্লীপন্থি বা লালনপন্থি; বাংলাপন্থি কেউই নই। কণা বলল।
হু।
কণা বিকেলের আগেই ফিরেছে।
তারপর ভিড়ের মধ্যে কথা বলতে বলতে কণা রেজাকে কখন হারিয়ে ফেলেছি। থাক। ওদের আর খুঁজতে চাই না। এই ভিড় হারিয়ে যাওয়ার জন্যই তো।
সন্ধ্যায় বৃষ্টি নামল ঝাঁপিয়ে। আর উথালপাথাল হাওয়া।
আশ্চর্য! কেউই আড়াল নিল না। সবাই অন্ধকার বৃষ্টিতে নেমে এল। রাস্তায়। যেন সবাই বৃষ্টির জন্যই অক্ষা করছিল।
কে যেন আমার পাশে চিৎকার করে কি বলল। একজন মাঝবয়েসী মহিলা।
কি বললেন!
লালননগর। কী সুন্দর নাম।
ও।
আমার মনে পড়ল-২০০৮ সালের অক্টোবরে ঢাকায় বিমানবন্দরের কাছে বাউলদের ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল। তার পরপরই এক তীব্র আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল।
যার ফলে কুষ্টিয়ার নাম হয়েছিল লালননগর।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:১৬