নিরন্তর শব্দটি আমার প্রিয়। ভাবছিলাম শব্দটি খাঁটি বাংলা শব্দ কি না। নাকি শব্দটি সংস্কৃত শব্দভান্ডার থেকে এসেছে। সেই রকমের হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তা হলে কত পুরনো শব্দ নিরন্তর? কী ভাবে এমন কাব্যিক শব্দের সৃষ্টি হল?
তো, এই রকম ভাবতে ভাবতে চর্যার একটি পদে নিরন্তর শব্দটি পেয়ে অবাক হয়ে যাই।
চর্যার পদ আমরা জানি, সেই সপ্তম/অস্টম শতকের বাঙালি কবিদের দ্বারা রচিত কবিতা। সেই কবিদের অবশ্য একটি জীবনদর্শন ছিল। সহজিয়া বৌদ্ধমত। সহজিয়া বৌদ্ধমত হল বৌদ্ধদর্শনেরই একটি শাখা। জানেনই তো কালে কালে মূল বিশ্বাসটা কেমন বদলে যায়। তো সেই কবিরা কবিতা লিখে তাদের বিশ্বাসের কথা লোকসমাজে প্রচার করত।
আমি যে পদে নিরন্তর শব্দটি পাই সেই চর্যার পদটি এই রকম-
তো বিনু তরুণি নিরন্তর ণেহে
বোধি কি লব্ ভই প্রণ বি দেহেঁ।
বাংলা অর্থ: তোর নিরন্তর স্নেহ বিনা, হে তরুণি, এই দেহে কি বোধিলাভ হয়?
তার মানে বাঙালি যুবক তার প্রেমিকার কাছে নিরন্তর স্নেহ চাইছে। যে নিরন্তর স্নেহ
বিনা বোধি বা enlightenment সম্ভব না। কেবলি কাম চাইছে না পশুদের মত? কী আশ্চর্য! কী পবিত্র চিন্তা। আর নারীর কি মর্যাদা! স্নেহ, কাম নয়। আর কেবলি নিছক দৈহিক আনন্দ নয়, বোধি মানে enlightenment ...মানে আলো চাইছে আলো ... কী আশ্চর্য! কী সুন্দর ...
যদি আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করে -তোমাদের দেশের তরুণদের প্রেমদর্শন কি?
তা হলে আমি বলব, আমাদের দেশের তরুণেরা মেয়েদের আলোর উৎস ভাবে, স্নেহ চায় ...কেবলি নিছক কাম নয়... স্নেহ পেয়ে আলোকিত হয়ে উঠতে চায়।
এখন যেন মুক্তিযুদ্ধের মানে বুঝতে পারছি।
ভাবলে অবাক হতে হয়, সপ্তম/অস্টম শতকের বাঙালি কবির কবিতা।
অথচ আজও কী সত্য। আজও অধিকাংশ বাঙালি তরুণ (কতিপয় পাষন্ড বাদে) এই স্নেহই চায় তার প্রেমিকার কাছে ।
প্রায় দুহাজার বছর আগেও তাই চাইত।
এই আবহমান বাংলা
তথ্যসূত্র:
নীহাররঞ্জন রায়। বাঙালির ইতিহাস। পৃষ্ঠা: ৫২৮
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:১২