বছর দশেক আগের কথা।
কেউ কি তখন জানতো জীবন আসলে কোনদিকে মোড় নিচ্ছে ? তবুও মানুষ আশায় বুক বাঁধে। স্বপ্ন দেখে।
এমনিভাবে শাহানাও স্বপ্ন দেখেছিলো। সব অশান্তির অবসান হবে।
জীবনের ফেলে আসা কষ্টময় দিনগুলো, সমস্ত ভুল বোঝাবুঝিগুলোর ইতি হয়তো হবে।
আট বছরের সম্পর্কের পর ওদের বিয়ে হলো। চোখে নতুন নতুন স্বপ্ন।
শুরু হলো জীবন যুদ্ধ। বেঁচে থাকবার লড়াই। বাস্তবতা ওদের দুজনের ভেতরের সমস্ত সংশয়কে যেন আরো বাড়িয়ে দিতে লাগলো।
শাহানা বুঝতে পারছিলো, ওর কাছ থেকে সুজন ক্রমশই সরে যাচ্ছে। ঠিক বিয়ের আগে যেভবে সরে যাচ্ছিলো।
কেনো জেনো সরে আসতে পারেনি তখন। যখন্ই দেখা হবে, জানে সুজন বিরক্ত হয়ে যাবে, একটা সীন ক্রিয়েট হবে ,তবুও কেনো যেনো আটকে রাখতে পারেনি নিজেকে। মানুষ বড়ই অসহায়, যখন সে নিজের উপর কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলে।
সুজন প্রায়ই বলতো, "বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখবে এই ব্যাপার গুলো বছর দুয়েক পর হাস্যকর মনে হবে। ওসব নিছক ফেসিনেশন, আর কিছুই নয়।"
দিন গড়িয়ে বছর আসে, আসে নতুন নতুন ফেসিনেশন। আর প্রত্যেকবার ঐ একই সমস্যা। মানুষের চেয়ে ঐ ফেসিনেশনগুলো বেশি আকর্ষণ করে ওকে।
সুজন ভুলে যায়, শাহানা একটা মানুষ। ওর ও কষ্ট হয়। এতো অবহেলা ?
সারাদিন ঐ যানত্রিকতা নিয়েই কাটিয়ে দেয়। ওর ভালো লাগে ওয়েব সাইট ভিজিট করতে, নতুন নতুন মানুষের সাথে কথা বলতে, ওদের কালচার জানতে।
এইসবের মাঝে শাহানা কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে। আগে প্রায়ই অভিযোগ করতো শাহানা, " আমি কি তোমার কেউ না। আমার কাছে ভালো লাগার মতো কি কিছুই অবশিষ্ট নেই? আমার সাথে কি একটু সময় বসা যায়না? আমার প্রয়োজন কি ফুরিয়ে গেছে ?"
"এতো অভিযোগ কেনো করো? এইসব বলবার জন্যই কি ডেকে নিয়ে আসো? আমার ভালোলাগা গুলো কেনো আমি তোমার জন্য ছাড়বো? হ্যাঁ, আমার ওখানেই থাকতে ভালো লাগে, কারণ ভারচুয়াল লাইফে কেউ কারো কাছে কিছু এক্সপেক্ট করেনা। কোনো অভিযোগ করেনা তোমার মতো।" -এরকম অনেক তীর ছুড়ে দিয়েছে সুজন, কিন্তু কোনোদিন উপলবদ্ধি করবার চেষ্টাটও করেনি ,যে মানুষটা এতোদিন তার সাথে সংসার করছে, তার কি এভাবে অবহেলিত হবার কথা ?
কত জন্মদিন, কত ম্যারেজ ডে চলে গেছে। উইশ করতে ভুলে গেছে সুজন।
বিয়ের পর পর বলতো, "আমরা মিডিল ক্লাস ফেমিলি থেকে এসেছি, এসব আমরা জানিনা। আমাদের কেউ কখনো উইশ করেনি।"
কিন্তু আজ যখন ঐ একই ব্যাক্তি ব্লগে বসে, সবাইকে ঈদ শুভেচ্ছা জানায়, অন্যদের দেয়া ঈদ কার্ডের প্রশংসা করে, নিউ ইয়ার এর উইশ করে, অন্যদের ভ্রমণ কাহিনী শুনে তাদের আরো গল্প লিখবার জন্য অনুরোধ করে, অন্যরা তাকে জন্মদিনের উইশ করলে আনন্দিত হয়, ধন্যবাদ জানায়, সবার কাছ থেকে উৎসাহ পেতে ভালোবাসে, চায় সবাই তার লেখা পড়ুক, মন্তব্য করুক, তখন শাহানা সত্যি চিনতে পারেনা তাকে।
যে মানুষটা সুখে দুখে সুজনের পাশে থাকে, আজ সেই হারিয়ে যেতে বসেছে। ভালোবাসা কি কোনো অপরাধ ?
আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেবেন আপনারা ?
লেখা, কাজ আর মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাগুলো সবই কি পাশাপাশি সমান তালে চলতে পারেনা? একটার জন্য অন্যটাকে ভুলেই যেতে হবে?
আজ যা আমার অক্ষমতা, সেটাই যখন আমার ভালো লাগায় পরিণত হয়, তখন দোষ শাহানাদের কেন হয় ?
স্ত্রীর এই ছোট ছোট চিহিদাগুলো পুরোন করার ইচ্ছে থাকলে, তখনই করা কি যেতো না? আজ যে ভাবে অন্যদের জন্য অকাতরে মনের অভিব্যাক্তিগুলো লিখে চলছে, এই একই বিষয়গুলো কি স্ত্রীর জানার অধিকার ছিলোনা ?
আসলে স্ত্রীরা কি বুঝে, ওসব লেখালেখি। এদের সাথে মনের আদান প্রদান কিসের?
হয়তো এভাবেই ছোট করে দেখছে যে মানুষ, সেই একই মানুষ কোন বড় লেখক।
ওনার লেখা দিয়ে উনি যেভাবে অন্যদের আকৃষ্ট করেন, মনোমুগ্ধ করেন, তার কি কিছুটা ওনার স্ত্রী প্রাপ্য না।
মাঝে মাঝে শাহানা, বিষয়গুলো তুললেই, বিশিষ্ট লেখক সুজন, মহা ক্ষেপে যান। মাঝে মাঝে শাহানাকে ছেড়ে ও চলে যেতে চায় , এই লেখালেখির জন্য।
আপনাদের কাছে প্রশ্ন, আপনারা লেখালেখি করেন কেন? আপনাদের ভালো লাগে বলে তাই না? কিন্তু সেটা কি স্বামী বা স্ত্রীকে অবহেলা করে?
আপনারা কি আপনাদের ছোট ছোট ভালো লাগা গুলো আপনাদের কাছের মানুষগুলোর সাথেই আগে শেয়ার করবেন না?
আপনাদের অনেক অজানা কথা, যখন আপনাদের কাছের মানুষগুলো অন্যের মুখে শুনবে, তখন কি তাদের খারাপ লাগবে না?
এ খারাপ লাগবার জন্য আপনারা কাকে দাই করবেন ? যে আড়াল করলো তাকে নাকি যার খারাপ লাগলো তাকে।
আপনাদের কাছের মানুষগুলো অনেক ঘটনার পরও আপনাদের সাথেই থাকছে বছরের পর বছর। তাদের সহযোগিতা ছাড়া আপনারা কি এতদুর আসতে পারতেন?
যারা নতুন নতুন সংসার শুরু করেছেন বা করবেন, তাদের একটা অনুরোধ, লেখালেখিকে প্রতিভা প্রকাশের একটা মাধ্যম ভাবুন।
আপনজনদের ছোট ছোট ভালোলাগাগুলোকে মূল্য দিন। যারা লেখা আর সংসারের মধ্যে সমন্বয় রাখতে পারবেন তারা অবশ্যই জীবনের প্রতিটি অধ্যায় সফলতার সাথে পার হবেন।
আপনার সংসার , স্বামী বা স্ত্রী -কেউ আপনার প্রতিভা প্রকাশের অন্তরায় নয়। ওদের নিয়েই আপনি, আর আপনার সব কাজের পিছনে ওদেরই সমর্থন আপনার জন্য শক্তি হয়ে কাজ করবে।
ওদের কে আপনার বড় ফ্যান ভাবুন। ওদের কে বুঝতে দিন, ওরাও আপনার বিশিষ্ট পাঠকদের একজন। অন্য পাঠক পাঠিকারা তো থাকবেনই। দেখবেন ওরা কিভাবে আপনার সমর্থন করে।
যাকে যার যতটুকু অধিকার পাবার কথা, তাকে ততটুকু অধিকার দিন। আপনাদের মতো বড় লেখক না হলেও, ওরা আপনাদেরই একজন। তাদের লেখার অক্ষমতাকে আপনার অবহেলার কারণ বানাবেন না। পদ্দলিত করবেন না ওদের।
ভালোবাসা দিয়ে ওদের কে আপনিই তো আগলে ধরবেন।
সংসারের প্রতি কর্তব্য, সন্তানের প্রতি কর্তব্যগুলোকে বিরক্তের কারণ না ভেবে সব কিছুকে যার যার জায়গায় রেখে, অবশ্যই নিজের সীমানাকে লংঘন না করে দেখুন। সব তিক্ততা চলে যাবে।
ঠিক যেমনটি হয়েছে, শাহানা আর সুজনের। শাহানার কষ্টগুলো একটু কষ্ট করে উপলব্দ্ধি করবার চেষ্টা করেছিলো সুজন।
অন্যদের লেখা পড়ে ভালো লাগলে, তাদের কে মু্গ্ধ এবং একই সংগে অনুপ্রাণিত করার জন্য সুন্দর সুন্দর কমেন্ট দিয়ে- খেয়াল না করা যে, সে হয়তো কিছু বেশিই লিখে ফেলেছে। হয়তো তার মনে রাখা উচিৎ ছিলো, পাঠক আর লেখকের মাঝে একটা মার্জিত সম্পর্ক এবং দূরত্ব থাকা উচিৎ।
লেখা লেখি চলতে থাকলো সুজনের, আর সব সময়ের শক্তি বলেন, বড় ফ্যানই বলেন, শাহানা । ওর পাশাপাশি থাকলো ছায়া হয়ে।
আজ ওরা দুজন দুজনকে বুঝতে পারে, কারণ সে সুযোগটা সুজন অন্যদের কাছ থেকে নিয়ে শাহানা কে দিয়েছে। এখন শাহানা আর নিজেকে সুজনের কাছ থেকে দুরের কেউ ভাবে না। ও জানে সব কিছুর আগে সুজন, এখন ওকেই চেনে।
কাহিনীতে শাহানা আর সুজন রূপক মাত্র। কিন্তু ঘটনাগুলো সত্য। কাল্পনিক নয়।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:১৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



