somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোরিয়ার স্মৃতিচারণঃ সব কিছুই বদলে যায়

২২ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৭:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গত সপ্তাহে মেসেঞ্জারে আমার এক প্রাক্তন কোরিয়ান ল্যাব-মেটের মেসেজ দেখে মনটা বিষণ্ণতায় ভরে উঠল! না কেউ পটল তুলেনি, বা অক্কা পায়নি, এমনকি কেউ আহতও হয়নি। বিষণ্ণতার শানে-নযুল হল আমার কোরিয়ান প্রফেসরের রিটায়ারমেন্ট করছিল সেদিন, সেই হিসেবে প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের কল করা। কোরিয়ার সময়ের সাথে আমেরিকার সময়ের তারতম্যের জন্য সেদিন আর কল রিসিভ করা হয়নি। সকালে ঘুম থেকে উঠে আমার কোরিয়ান ল্যাব-মেটের মেসেজ আর মিসকলটিতে আমি চোখ বুলালাম, হারিয়ে গেলাম সেই দুরন্ত সময়গুলোতে। ২০০৮ সালে প্রথম প্রফেসরের সাথে মোলাকাত, সে বছরই প্রথম দেশের বাইরে গিয়েছি আন্ডার-গ্রাজুয়েট করতে। তার ল্যাবেই ছিলাম পাঁচটি বছর। আমার মস্তিষ্কে বিদেশী প্রফেসরদের যেমন একটি টিপি-কাল চিত্র ছিল, তিনি ছিলেন ঠিক তার বিপরীত। তার উচ্চতা মাঝারি গড়নের, দেখতে ধলা এবং বেশ পরিপাটি। কোরিয়াতে কোথাও কনফারেন্স হলে আমাদের সব ল্যাব-মেটদের নিয়ে যেতেন একসাথে বেশ কয়েকদিনের জন্য, রাতে বিশাল বারবিকিউ পার্টি হত, আড্ডা হত, এবং দিনের বেলায় আমাদের সাথে ফুটবল খেলায়ও যোগ দিতেন তিনি প্রায়!

প্রফেসর একদিকে যেমন বেশ মিশুক ছিলেন অন্যদিকে বেশ কঠিন ছিলেন। আমরা তাকে মোটামুটি বাঘের-মত ভয় পেতাম, তিনি যেদিন তার অফিসে থাকতেন আমাদের ল্যাব-মেটরা কেউ আর সেদিন ল্যাব থেকে নড়ত না, আবার দেখা যেত যখন তিনি কোরিয়ার বাইরে যেতেন কয়েকদিনের জন্য একা, ল্যাব-মেটদের যেন ঈদ চলে আসত তখন, সবাই নিজেদের-মত সময় কাটাত। সোমবার আমাদের মিটিং থাকত, মিটিং শেষে আমাদের কোন রেস্টুরেন্টে নিয়ে ভোজন করাতেন ফ্রি ল্যাব ফান্ড থেকে, আমি সত্যিই এই কালচারটা মিস করি অনেক, আমি ইউরোপ বা আমেরিকায় এই কালচার কখনো দেখিনি। তিনি ২০১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক কনফারেন্সে বাংলাদেশে আসেন আমার সাথে। আমাদের বাসায়ও এসেছিলেন তিনি। আমার মাস্টার্স তখন শেষের দিকে, আমার মাকে বললেন আপনার ছেলেকে আরও ৫ বছরের জন্য পিএইচডি করতে দেন আমার কাছে, আপনাদের সংসার খরচের জন্য মাসে আশি হাজার টাকা দেয়া হবে এবং আপনার ছেলে বিয়ে করে বউ নিয়ে গেলে সেভাবে সেখানকার খরচ দিব। যাইহোক আমি রাজি হইনি, দেশকে তখন প্রচন্ডভাবে মিস করছিলাম। প্রফেসরকে কক্সবাজারেও নিয়ে গিয়েছিলাম, আমাদের বাসায়ও বেশ সমাদর করেছিলাম। তিনি বাংলাদেশ ভ্রমণ নিয়ে এতই খুশী ছিলেন যে করিয়াতে ফিরে আমার বেতন ডাবল করে দেন, একই ল্যাবে তখন পিএইচডির ছাত্রছাত্রীরা আমার থেকে অনেক কম বেতন পেত! প্রফেসরের সাথে আমি জাপান, লাউস এবং থাইল্যান্ড এক সাথে ভ্রমণ করেছি। তিনি বেশ ভ্রমণ প্রিয় একজন মানুষ। কোথাও গেলে, কোন হোটেলে থাকবেন, কি খাবেন এবং কি-কি করবেন সব ঠিক করে রাখতেন, তার সাথে থাইল্যান্ডের ব্যাংককের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান, লাউসের রাজধানী এবং জাপান অনেক কিছু ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, আর কোরিয়ার বিভিন্ন শহরের কথা বাদই দিলাম।

২০১৩ সালের পর প্রফেসরের সাথে আর আমার দেখা হয়নি, আর কবে দেখা হত সেটাও জানিনা। তারপরও তার রিটায়ারমেন্টের কথা শুনে সত্যিই কেন জানি মর্মাহত হলাম, আমি ঠিক জানিনা রিটায়ারমেন্ট মর্মাহত হবার মত কোন ব্যাপার কিনা। তারপরও আহারে সময় কিভাবে যেন চলে যায়, যার ল্যাবে এক সময় ১৫-২০ ছাত্রছাত্রী দিন-রাত কাজ করত, যিনি সুন্দর একটি ল্যাব দাড় করিয়েছিলেন, সেই ল্যাবটি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, নিশ্চয়ই তার মনেও এক ধরনের মিশ্রই অনুভূতিই হবার কথা! একটি জামা অনেক দিন পরলেও কেমন যেন একটি মায়া জমে যায়,একটি বাসায় অনেক দিন থাকলেও ছেড়ে যেতে মায়া হয়। যাইহোক আমার ইচ্ছে ছিল কোরিয়া গেলে প্রফেসরের সাথে মোলাকাত করব, পুরনো ল্যাবটা ঘুরে দেখব যেখানে জীবনের ৫টি বছর কাটিয়েছিলাম।

আমাদের হাইস্কুলে হামিদ স্যার নামক একজন জাঁদরেল শিক্ষক ছিলেন। কেউ পড়া না পারলে তাকে রাম ধোলাই দিতেন স্যার। স্যারের একটি দারুণ প্রতিভা ছিল, আমরা ক্লাসে বসে আছি, ক্লাসে কাউকে অমনোযোগী দেখলেই, হঠাৎ স্যার ডাস্টার ছুড়ে মারতেন। পঁচিশ থেকে ত্রিশ জন ছাত্র বসে আছে, ঠিক যাকে লক্ষ্য করে মারতেন ডাস্টার ঠিক তার শরীরের গিয়েই লাগত,বন্ধুকের গুলি মিস হত কিন্তু তার লক্ষ্য মিস হত না! বাংলাদেশ শুটার দলে তাকে জায়গা দিলে নিশ্চয়ই সোনার মেডেল মিস হত না আমাদের, আফসোস তার প্রতিভার কদর তিনি পেলেন না! যাইহোক শেষবার বাংলাদেশে গিয়েছিলাম, ইচ্ছে ছিল স্কুলের শিক্ষকদের সাথে মোলাকাত করে আসব। যাওয়া হয়নি তবে ছুটির দিনে স্কুলটাকে দেখতে গিয়েছিলাম, হামিদ স্যারকে দেখলাম অনেক পর, তবে কাছে গিয়ে আর কথা বলা হয়নি, স্যার তখন মসজিদের ঢুকছিলেন! তবে আমি জানিনা স্যার আমাকে চিনত কিনা! স্যারের আগের সেই জৌলুস নেই, বেশ বয়স হয়ে গেছে, মুখে গজিয়েছে সাধা দাড়ি। আমার সাথে সেই স্কুলের এক ছাত্র ছিল, বলল হামিদ স্যারকে কোন ছাত্রছাত্রী আর ভয় পায় না। উল্টো পোলাপান পিছন থেকে তাকে দাদু দাদু বলে খেপায়! আমার গুরু সম্প্রদায়গুলো আসতে আসতে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। স্যারের নিশ্চয়ই রিটায়ারমেন্টের সময় হয়ে গেছে!! দেশে গেলে আর দেখা হবে কিনা জানিনা!

আমাদের জেনারেশনের অনেক ছেলে মেয়েই সরকারী প্রাইমারি স্কুলে পড়েছে। আমি যখন প্রাইমারিতে পড়ি আমাদের এলাকায় বা আশেপাশে কোন কিন্ডারগার্ডেন ছিল না, সবাই প্রাইমারি স্কুলে পড়ত। প্রাইমারিতে স্কুলের এক ম্যাডামের কাছে প্রাইভেট পড়তাম, নাম মঞ্জু। আমরা ম্যাডামকে ডাকতাম মঞ্জু আপা বলে। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে এক সাথে পড়তাম সেসময় মঞ্জু আপার কাছে, আহা কোথায় হারিয়ে গেল আমার শৈশব! মঞ্জু আপা এখনো সেই স্কুলটিতে পড়ায়, প্রাইমারি স্কুলে বোধ হয় তেমন বদলী হয়না অন্যান্য সরকারি চাকরির মতন! অনেক বছর হল কিন্তু মঞ্জু আপাকে কয়েকবার দেখেছি দূর থেকে, কাছে গিয়ে আর কথা বলা হয়নি। শুনেছি পরিচিতিদের কাছে আপা আমার কথা জিজ্ঞেস করতেন। এরপর গেলে মঞ্জু আপার সাথে দেখা করব ভাবছি।

বাংলাদেশে আমার অনেক প্রিয় শিক্ষক আছে, তার মাঝে এই মুহূর্তে ফয়েজ খান স্যারের কথা মনে পড়ছে। আমি জীবনে যদি কোন কিছু অর্জন করে থাকি তার জন্য স্যারের অবধান বলে শেষ করা যাবে না। স্যার আমার সিভিটা নিয়ে আমার হয়ে কোরিয়ান সরকারি স্কলারশিপে এপ্লাই করেছিলেন। স্যার না থাকলে আমার কোরিয়াতে যাওয়া হত না। স্যার বর্তমানে একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ভিসি হিসেবে আছেন। তার-মত এমন ভাল শিক্ষক এবং মানুষ আমি আমার জীবনে দেখিনি। কোরিয়াতে যাবার পর আমি চেষ্টা করতাম স্যারের সাথে যোগাযোগ করতে। এমনকি কোরিয়া থেকে ছুটিতে দেশে এসেও স্যারের সাথে তার কর্মক্ষেত্রে গিয়ে দেখা করেছি। তবে মাঝখানে অনেক বড় গ্যাপ হয়ে গেছে, স্যারের সাথে দেখা হয়না অনেক বছর! স্যারের সাথে দেখা করার ইচ্ছে আছে দেশে গেলে।

ডেনমার্কে আমার পিএইচডই সুপারভাইজারের নাম ছিল সোরেন। আমরা ল্যাবের সবাই তাকে তার ডাকনাম সোরেন বলেই ডাকতাম, এটাই সেখানকার কালচার। সোরেনের বয়স আনুমানিক ষাট হবে, আমার জীবনে যে কজন ভাল শিক্ষক পেয়েছি সোরেন তার অন্যতম, এমন শান্তশিষ্ট এবং নরম প্রফেসর খুব কম দেখেছি। এখনো কোন প্রয়োজনে তাকে ইমেইল করলে সাথে সাথে উত্তর দেয়, সাহায্য করার চেষ্টা করে। বছর দুয়েক আগে আমি নতুন চাকরি খুজছিলাম, তার একটি রিকোমেন্ডশন লেটারের জন্য যোগাযোগ করলাম, তিনি দিলেন, তবে চাকরিটা হবার পর আর তাকে জানাই-নি। আমাকে তার কিছুদিন পর ইমেইল দিয়ে বললেন ফ্রান্সে তার এক কোলাবোরেটর লোক খুঁজছেন, আমার এক্সপার্টাইজের। তিনি হয়ত ভাবছিলেন আমার চাকরিটি হয়নি, তাই চাচ্ছিলেন হয়ত সেখানে আমাকে ঢুকাতে। যাইহোক, ডেনমার্ক ছাড়লাম প্রায় চার বছর হয়ে গেল, ডেনমার্কে গেলে সোরেনের সাথে মোলাকাত করার ইচ্ছে আছে, জানিনা আবার কবে যাওয়া হবে! দেশ ছাড়লাম সেই ২০০৮ সালে, তারপর আর আগের মত করে দেশকে পাইনি, একবার পাখি নীড় ছাড়লে সেই নীড়ে আর ফেরা হয়না!

যাইহোক লেখাটা শুরু করেছিলাম আমার কোরিয়ান প্রফেসরকে দিয়ে, মাঝখানে কত কিছু লেখে ফেললাম! আমার গুরু সম্প্রদায় পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে, কেউ রিটায়ারমেন্টে চলে যাচ্ছে, কেউ পুরোপুরি পাল্টে যাচ্ছে! যাইহোক ভাল থাকুক আমার গুরু সম্প্রদায়।

কোরিয়ার স্মৃতিচারণসমূহ:
কোরিয়ার স্মৃতিচারণঃ আমার কোরিয়া যাওয়ার প্রারম্ভিক ইতিহাস
কোরিয়ার স্মৃতিচারণঃ ইউনিভার্সিটির হোস্টেলের নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে আমি পাকড়াও
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৭:২৮
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×