somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইলিয়াস আলী : জেগে আছে বিপ্লবে, বিদ্রোহে এবং স্মৃতির উজ্জল পর্দায়

১৮ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১২:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.
আজ ১৭ই এপ্রিল। এই দিনটি ঐতিহাসিক। কিছু ঐতিহাসিক দিন আমাদের জন্য খুবই বেদনার, খুবই পীড়াদায়ক। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায় সেরকম একটি ঐতিহাসিক দিন হচ্ছে ১৭ই এপ্রিল। বছরের এই দিনটিতে আমি চরম মর্মবেদনা নিয়ে একজন মানুষকে স্মরন করি। যতই ব্যাস্ততা থাক না কেন? এই দিনটিতে আমি পরম করুনাময়ের কাছে কায়মানোবাক্যে প্রার্থনা করি একজন মানুষের জন্য। একজন মানুষের ফিরে আসার জন্য।

আজ থেকে তিন বছর পূর্বে একজন মানুষ তার ব্যাক্তিগত ড্রাইভার সহ নিখোঁজ হয়ে যান। ধারনা করা হয় তাকে সরকারী আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ধরে নিয়ে গেছে। তার পরিবার, তার দল ও তার অনুসারীদের দৃঢ় বিশ্বাস সরকারের ইশারায় তাকে গুম করা হয়েছে। কিন্তু তার সন্তানেরা এখনো বিশ্বাস করে একদিন তাদের বাবা ফিরে আসবে। কোলে তুলে নেবে তার আদরের মেয়ে সাইয়ারাকে। তাদের বিশ্বাস সরকার এখনো তাকে জীবিত রেখেছে। সেই বিশ্বাস থেকে তারা একদিন দেখা করেছিলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে। প্রধানমন্ত্রী ছোট্ট নিস্পাপ শিশু সাইয়ারার মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বাস দিয়েছিলেন ইলিয়াস শীঘ্রই ফিরে আসবে। তিনি সর্বোচ্চ চেস্টা করবেন ইলিয়াসকে যথা শীঘ্র ফিরিয়ে আনার জন্য।

জানিনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কতটুকু সর্বোচ্চ চেস্টা করেছেন। জানিনা তার এই সর্বোচ্চ চেস্টার আশ্বাসের পিছনে কতটুকু আন্তরিকতা ছিলো। নাকি ছিলো শুধুই আমাদের তথাকথিত নীতি আদর্শ বিবর্জিত রাজনৈতিক লুকোচুরি। তাই হয়তো আজো আমরা ইলিয়াসের কোন সন্ধান পাইনি। জানিনা ইলিয়াস আলী বেঁচে আছেন কিনা?

ইলিয়াস আলী একজন রাজনীতিবিদ। তিনি সারা বাংলাদেশে পরিচিত তার রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য। কিন্তু আমার কাছে তিনি কোন রাজনৈতিক ব্যাক্তি ছিলেন না। আমার কাছে তার পরিচয় শ্রদ্ধেয় অগ্রজ। আমার কাছে তার পরিচয় খুব কাছের প্রতিবেশী। আমরা যখন একই পাড়ায় থাকতাম তখন শুধু আমি নয় আমাদের বন্ধু বান্ধবদের কাছে তার পরিচয় একরকম আত্মীয়র মতোই ছিলো। আমরা একই মসজিদে নামাজ পড়তাম। একই রাস্তায় হাঁটতাম। সালাম ও কুশল বিনিময় করতাম। মাঝে মাঝে তার বাসায় চা খেতাম (দেখা করতে আসা মানুষদের জন্য গণ চা, আমার কাছে যা অতি সুস্বাদু ছিলো)। তো সেই মানুষটি হঠাৎ করে আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেলেন অস্বাভাবিক ভাবে।

এই হারিয়ে যাওয়াটা বাংলাদেশের মানুষ মেনে নিতে পারেনি, এখনো পারছেনা। বাংলাদেশের একজন সাবেক সংসদ সদস্য, বিএনপি'র মতো একটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যেতে পারেন না। এমনকি যদি নিখোঁজ হয়েও যান, একটি গনতান্ত্রিক, সভ্য ও দ্বায়িত্বশীল সরকারের উচিত হচ্ছে ঘটনা তদন্ত করে জাতির সামনে উপস্থাপন করা ইলিয়াস আলীর আসলে কি হয়েছে। যেহেতু ইলিয়াস আলী নিখোঁজের ব্যাপারে আমরা এখনো কোন তথ্য জানিনা সেহেতু বিশ্বাস করি তিনি বেঁচে আছেন। এবং এও বিশ্বাস করি সরকারের হেফাজতেই আছেন। কারন দ্বায়িত্বটা আসলেই সরকারের।

ইলিয়াস হারিয়ে যাওয়ায় সারাদেশে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছে। ইলিয়াসকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে হরতাল হয়েছে। খুব স্বাভাবিক যে ইলিয়াসপ্রেমী মানুষেরা তাদের নেতাকে ফিরে পাওয়ার জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করবে। কিন্তু সরকার ও তার লেলিয়ে দেয়া বাহিনী ইলিয়াসপ্রেমী বিক্ষুব্ধ জনতার উপর সেদিন হায়েনার মতো আক্রমন করেছিলো। তিনটি তাজা প্রান কেড়ে নিয়েছিলো সেদিন তারা বিশ্বনাথের শান্ত-শ্যামল জনপদ থেকে। হাজার হাজার বিরোধী নেতা কর্মীর নামে মামলা হয়েছে, অনেকেই এখনো ফেরারী হয়ে ঘুরছেন, অনেকে অন্যায় অবিচারের মাধ্যমে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। প্রিয় ভাই, প্রিয় নেতা ও প্রিয় প্রতিবেশীকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবীতে আন্দোলন করা কি অপরাধ? সরকার এই আন্দোলনে পুলিশ দিয়ে গুলি করিয়ে মায়ের বুক খালি করে কি প্রমান করতে চাইলেন? বিষয়টা এখনো ধোয়াচ্ছন্ন। সরকার জড়িত এটা প্রমান করার জন্যই কি এই আন্দোলন দমনে পুলিশ ও সরকারী দলের চিহ্নিত ক্যাডারেরা সেদিন হামলা করেছিলো?

২.
একদিন ইলিয়াস আলী সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়েছেন। অতিথিরাও বিদায় হয়েছেন। বাসায় কেউ নেই শুধু তার ভাতিজা ও দাদা (দাদার নাম ভুলে গেছি, তিনি অথিতিদের জন্য চা নাস্তা বানাতে সবসময় ব্যাস্ত থাকতেন)। সেদিন সম্ভবত অস্ট্রেলিয়ার খেলা ছিলো। আমরা সবাই হানা দিলাম ইলিয়াস আলীর ডেরায়। ইলিয়াস আলীর ভাতিজাসহ আমরা সাবাই ৬/৭ জন মিলে দখল করলাম ইলিয়াস আলীর বেড রুম। সেই বেড রুমে ছিলো ৩০/৩২ ইঞ্চির একটা টেলিভিশন। আয়েশ করে ইলিয়াস আলীর বেডে হাত পা উঠিয়ে বসে খেলা দেখছি। দু একজন তারই ফেলা রাখা প্যাকেট থেকে বেনসন সিগারেট ধরিয়ে ফুঁকছে ইতোমধ্যে। চিৎকার চেচামিছি, হৈ হৈ করে খেলা দেখছি।

ঘ্যাচ করে দরজাটা খুলে গেলো। হঠাৎ করে মনে হলো একটা ঝড়। ঝড়ের তোপে সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। টেলিভিশনের জেফ্রি বয়কট একাই কথা বলছেন। সেই ঝড় আর কিছু না। ইলিয়াস আলী নিজেই আমাদেরকে অষ্টম আশ্চর্য দেখিয়ে দড়জায় দাঁড়িয়ে। আনাড়ী ধুমপায়ীদের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন রুম, হাই ভলিয়্যুমে জেফ্রি বয়কটের ধারাভাষ্য। ওয়া ব্রাদার্স জুটির শতরান। সবকিছুই যেন দুর্বোধ্য। কিংকর্তব্যবিমুঢ় আমরা স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছি। ইলিয়াস আলি একটা দীর্ঘশ্বাষ ফেলে দরজাটা আস্তে করে লাগিয়ে বাইরে দাড়ালেন। সম্বিত ফিরে পেয়ে পেছনের লাগোয়া বারান্দা দিয়ে সবাই পালিয়ে যাচ্ছি। যেন বাঘের হাত থেকে মুক্তি পেলাম। তার পর অন্তত কয়েক সপ্তাহ ইলিয়াস আলীর নাগালের বাইরে থাকার চেস্টা করেছি। আজো সেই স্মৃতি মনে হলে কিছুটা শিউরে উঠি। কিন্তু বারবার মনে করতে ইচ্ছে করে। ইলিয়াস আলীর সামনে থেকে পালিয়ে যাওয়ার এই স্মৃতি কেন জানি খুব মধুর স্মৃতি বলে মনে হচ্ছে আজ। মনে হচ্ছে আরো কয়েকবার যদি এরকম পরিস্থিতি হতো তাহলে আরো ভালো হতো, বেশী ভালো হতো।

৩.
ইলিয়াস আলী আমি আপনাকে চিনি। আমার মতো করেই চিনি। আমাদের মতো করেই চিনি। উপশহরে আপনার বাসার আশে পাশে আমরা যে তরুনগুলো সেদিন প্রতিবেশী হিসেবে ছিলাম, তাদের সবাই আজ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছোট-বড় বিভিন্ন কাজে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু যখনই আমরা একে অপরের সাথে কথা বলি, মিলিত হই, আড্ডায়, গল্পে কিংবা গানে। একবার, একটিবার হলেও আপনার প্রসংগ আসে। তখনই আমরা বেদনাহত হই। তখনি আমরা সিক্ত হই নয়নজলে। তখনই আমরা প্রার্থনা করি পরম করুনাময়ের কাছে আপনার ফিরে আসার জন্য। আপনার আগমনের জন্য। বিশ্বাস করুন শুধু আমি কিংবা আমরা নয়, আপনার পরিবার, আপনার প্রতিবেশীসহ সারা বাংলাদেশ অপেক্ষা করছে আপনি ফিরে আসবেন। আপনি নিশ্চয় ফিরে আসবেন। আমিন।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১২:৪৯
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=আকাশে তাকিয়ে ডাকি আল্লাহকে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০১


জীবনে দুঃখ... আসলে নেমে
শান্তি গেলে থেমে;
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হই উর্ধ্বমুখী,
আল্লাহকে বলি সব খুলে, কমে যায় কষ্টের ঝুঁকি।

আমি আল্লাহকে বলি আকাশে চেয়ে,
জীবন নাজেহাল প্রভু দুনিয়ায় কিঞ্চিত কষ্ট পেয়ে;
দূর করে দাও সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

"ছাত্র-জনতার বেপ্লবের" ১৮ মাস পরে, আপনার ভাবনাচিন্তা ঠিক আগের মতোই আছে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৭



২০২৪ সালের পহেলা জুলাই "ছাত্র-জনতার বেপ্লব শুরু হয়, "৩৬শে জুলাই" উহা বাংলাদেশে "নতুন বাংলাদেশ" আনে; তখন আপনি ইহাকে ব্যাখ্যা করেছেন, ইহার উপর পোষ্ট লিখেছেন, কমেন্ট করেছেন; আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

লিখেছেন কিরকুট, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৭



চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

×