somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ওয়াশিংটন ডিসি'র আকাশে শাদা কালো রোদ-২

১৮ ই নভেম্বর, ২০১৩ সকাল ৯:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




ল্যাব ক্লাশ শেষে জিনিষ পত্র গোছাচ্ছি-এমন সময় চোখ পড়ল ক্লাসের কোনায়। টেবিলে মাথা গুজে মন খারাপ করে বসে আছে আমার এক স্টুডেন্ট। আমার তাড়া আছে তাই বিনম্র ভাবেই জিজ্ঞেস করলাম “তুমি যাবেনা”?

কোন উত্তর নেই। আবার জিজ্ঞেস করলাম “তোমার কি মন খারাপ”।

ও বললো- “হ্যা”।

ভাবলাম বয়ফ্রেন্ড এর সাথে ঝগড়া হয়েছে বুঝি তাই ব্যাক্তিগত বিষয় ভেবে আর আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলামনা। কিছুক্ষন চুপচাপ। আমি কাজ গুছিয়ে এনেছি প্রায়। আমার নিজের ল্যাব এ ওয়েস্টার্ণ ব্লট এক্সপেরিমেন্ট (প্রোটিন আইডেন্টিফিকেসন) অন গোয়িং অবস্থায় রেখে এসেছি।

- পরের সেমিস্টার এ আমি আর এই ইউনিভার্সিটিতে থাকবোনা।

- কোথায় যাচ্ছো তুমি?

-আমার বুঝি আর অন ক্যাম্পাস পড়াশুনা করা হবেনা।

এই বার সে আমার মনোযোগ কাড়ল। হাতের উপর রাখা প্রজেক্টর ট্যাবিলে রেখে জিজ্ঞেস করলাম “ কি বলছ তুমি” আর ইউ ওকে? ইউ আর ইন দি মিডল অফ অফ ইয়োর জার্ণি; আর তুমি ক্যুইট করতে যাচ্ছো? অদ্ভুত তো!

- আমি জানি বাট আমার নেক্সট সেমিস্টার এর টিউশন ফী হিসেবে ৪০ হাজার ডলার দেয়ার মত টাকা নেই। আমার স্কলারশিপ এর মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে। ওরা বলেছে সেটা আর রিনিউ করবেনা। আর নিজের জমানো টাকাও প্রায় শেষ।

- তো তুমি লোন নিচ্ছোনা কেনো?

- আমি ব্যাঙ্কের সাথে কথা বলেছি। ওরা বলে একজন গ্যারেন্টর লাগবে। আর নিজের ক্রেডিট হিস্টোরিও নেই। সো ওরা একপ্রকার না ই করে দিয়েছে।

- তাহলে তুমি তোমার বাবা-মা’র সাথে এটা নিয়ে ডিসকাস করছোনা কেনো?

- আমার বাবা নেই। আই মিন সে আমাদের টেক কেয়ার করেনা। আমার জন্মের পর থেকে উনাকে আমি দুই কি তিনবার দেখেছি। যখনি এসেছে দেখেছি মা’র সাথে ঝগড়া করছেন। কিন্তু তবুও আমি উনাকে ভীষন ফীল করি।

আচ্ছা তুমি তো ইন্ডিয়ান, না?

- না, আমি বাংলাদেশি, ইন্ডিয়ার নেইবার কান্ট্রি। যেমনটা মেক্সিকো তোমাদের।

- ও আচ্ছা। আমি স্লামডগ মিলিওনিয়ার দেখেছি। তোমাদের ওখানেও কি বাবা’রা বাচ্চাদের রেখে চলে যায়? আর রিচ পিপলরা সেই বাচ্চাদের কিনে নেয়?

- আমি একটু ভাবলাম। কি বলা যায় ওকে। বললাম- হ্যা, এটা আমাদের ওখানেও হয়, তবে খুব বেশি মাত্রায় নয়। আর যেহেতু আমাদের দেশের মেয়েরা আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বি নয় তাই গভর্নমেণ্ট থেকেও আইন কানুনও সেইভাবে করা হয়েছে যাতে বাবারা মা এবং বাচ্চাদের টেক কেয়ারের টাকাটা দিতে বাধ্য থাকে। আর রিচ পিপলরা অনেক সময় সেই অনাথ বাচ্চাদের নিয়ে যায় তাদের হোম এসিস্ট্যন্ট হিসেবে। প্রসঙ্গে ফিরলাম।

- তো তুমি তোমার মা’র কাছে হেল্প সিক করছোনা কেন?
- মা’র সাথে এটা নিয়ে আমি ডিসকাস করতে চাই কিন্তু পারিনা
- কেন?

- মা’র বয়ফ্রেন্ড আছে। আর সেই বয়ফ্রেন্ড এসব মা’র কাছ থেকে শুনে এসে আমাকে ডিসকারেজ করে।ও আমাদের বাসায় এলেই বলে তোমার এতো পড়াশুনার কি দরকার। তুমি তোমার মাম্মি কে স্ট্রেস আউট করছো। আমার এটা শুনতে ভালো লাগেনা। যদিও ওই লোকটাকে আমি ভীষন অপছন্দ করি এবং আমি তার সাথে কথাও বলিনা, যখন তুমি জানবে যে তুমি ওর কেউনা তখন তোমার ভেতর থেকে তার জন্য কোন অনুভুতিই আসবেনা। ও একটা কাওয়ার্ড। আমি তাকে ডিসলাইক করি এটাও সে বোঝেনা। যেচে এসে কথা বলে।

- মনে মনে ভাবলাম- প্রকৃতির কি অদ্ভুত লীলা। নিজের শরীরে যার রক্ত সে যত ইগনোর কিংবা তীব্র বিষাদের কারনই হোক না কেন তবু তার প্রতি আদি অকৃত্রিম টান। বিচ্ছেদের নাটাই টা যার হাতেই থাকুক না কেন সুতোটা হয়তো সম্পূর্ণ ছিড়ে যায়না; আপাতভাবে অদৃশ্য হয় শুধু। ভাবনায় ছেদ পড়ল ওর প্রশ্ন শুনে।

- আচ্ছা তোমরা কি মা-বাবা সহ একসাথেই বাস কর ওখানে।?
- আমার বাবা বেচে নেই। গত হয়েছেন ২০০৯ সালে। তবে মারা যাবার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত আমার মা কিংবা আমাদের ভাবনায় অস্থির ছিলেন উনি; এমনকি নিজে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যাচ্ছেন এটা জেনেও।

- আহা! আমার বাবাও যদি এমন হতো! আমি দুঃখিত তোমাকে আহত করার জন্য।

- না, না , ইটস ওকে। ফরগেট এবাউট ইট। তোমার প্রসঙ্গে আসি। তোমার আত্মিয়দের কাছে হেল্প চাচ্ছ না কেন?ওদের কে বল টাকাটা তুমি ধার হিসেবে নিচ্ছো এবং তোমার পড়াশুনাটা শেষ হলে তুমি ফেরত দিয়ে দিবে।প্রিটি ইজি।

- যতটা সহজ ভাবছো আসলে এটা এত সহজ নয়। আমি আমার জীবনে কখনো কারো কাছে কিছু চাইতে শিখিনি। আমার মা ছোট বেলা থেকেই আমাকে শিখিয়েছে আমার যা প্রয়োজন সেটা যেন আমি নিজেই অর্জন করে নেই। আর তাছাড়া আমি একটু অন্তর্মুখি স্বভাবের। কারো কাছে হাত পাতা আমার ধাতে নেই। এজন্য আমার বয়ফ্রেন্ড ও আমাকে বকে। ও আমাকে এনকারেজ করে যেন আমি জিজ্ঞেস করি আমার কি লাগবে। তবে যা বলসিলাম। আত্মিয়দের কাছে লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করিনি যে তা নয়। তবে বিনিময়ে ওরাও কিছু এক্সপেক্ট করে কিংবা ভবিষ্যতে করবে সেটা আমার ভালো লাগেনা।

- আমি সচেতন ভাবেই এই প্রসংগটা এড়িয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম তোমার বয়ফ্রেণ্ড কি করে?

- ও আমার মত স্ট্রাগল করে টাকা পয়সা নিয়ে। তাই সেও এক্ষেত্রে নিরুপায়। ও আর আমি গত সামারে স্টারবাক্ আর ম্যাকডোনাল্ডে কাজ করে কিছু টাকা জমিয়েছিলাম সেটা দিয়ে এইবছর টা আমরা কষ্ট করে পার করলাম। ইভেন আমার শীতের কাপড়গুলোও কয়েক বছর আগের।

ওর কথা শুনে আমার মনে হচ্ছিল ইশ্বর আসলে ভদ্র পল্লীতেও দুর্লভ। কি আমেরিকা কি বাংলাদেশ সবখানেই অসহায়দের আর্তনাদ একই রকম। বললাম তুমি আপসেট হয়োনা। মনে রেখ তুমি পৃথিবীর অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে স্বাবলম্বী দেশের একজন নাগরিক যাদের জন্য আছে এম্পল অব অপরচ্যুউনিটি। শুধু চোখ কান খোলা রেখো—একটা উপায় বের হয়ে যাবে। আমার দেশ অর্থনৈতিক ভাবে এখনো ডেভেলপিং এর লিস্টে। অথচ সেই রাষ্ট্রটিও আমাদের পড়াশুনা করিয়েছে নামে মাত্র ফী নিয়ে। সব মিলিয়ে আমার নিজের ৫০০ ডলারও খরচ করতে হয়নি। যদিও এর জন্য আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। প্রায় হান্ড্রেড থাওজেন্ড ছেলে মেয়েকে পেছনে ফেলে জায়গা করে নিতে হয়েছিল।

-ও বললো আর সেই দেশ কে রেখে তুমি এমেরিকা চলে এলে? এখন এদের কে সার্ভ করছ। তুমি কি এখানেই থেকে যাবে?

- আমি বললাম আমার যদি দেশে গিয়ে ভালো কিছু করার সু্যোগ হয় আমি অবশ্যই ফিরে যাবো। হাজার হলেও আমার স্বদেশ। আর কিছু ঋন শোধেরও ব্যাপার আছে, কী বলো?

- ও স্মিত ভাবে হাসলো। বললো তোমাদের অবশ্যই ফেরত যাওয়া উচিত। যদিও এদেশের নাগরিক হওয়ার টিকিট তোমার হাতে। বাট দ্যাটস নাথিং এট অল।

- আমি এইবার সবকিছু গুছিয়ে দরজার দিকে হাটা দিলাম। ও আবার জিজ্ঞেস করলো তুমি কি আমাকে একটু সাহায্য করবে? আমিও এই বছর কিছু স্কলারশীপে এপ্লাই করবো।যেহেতু তুমি এইখানে স্কলারশীপ নিয়ে পড়তে এসছে তাই আমার ধারনা তুমি আমাকে এই বিষয়ে ভালো সাহায্য করতে পারবে।

- বলো কি ভাবে সাহায্য করতে পারি?

- আমার এস ও পি টা তুমি রিভিউ করে দিবে?আমাকে তোমার ইমেল টা দাও। আমি পাঠিয়ে দেব ওটা।

- আমি বললাম শিউর। আই উড লাইক টু হেলপ ইউ। আমি তোমার এই স্ট্রাগল টাকে ভীষন শ্রদ্ধার চোখে দেখছি। আই লাইক ইয়োর পার্সোনালিটি ঠু। জাষ্ট কীপ গোয়িং। নেভার গিভ আপ। রিমেমবার ইউ আর স্ট্রাগলিং ফর ইউর এডুকেশন, নট ফর হেভিং ফান। আর এই জার্নিতে তুমি যদি সফল হও তবে একদিন এই যুদ্ধটা তোমার সুখ-স্মৃতি হিসেবে নস্টালজিক করে তুলবে। নেভার কম্প্রোমাজ উইথ দিস। জাস্ট ট্রাই ইয়োর বেষ্ট।

- ও কিছুই বললোনা তেমন। জানালার দিকে তাকিয়ে আনমনে নিজের ব্যাগটা কাধে নিতে নিতে বললো—আই উইশ মাই ড্রিম কামস ট্রূ। আমি এই যুদ্ধে জয়ী হতে চাই।

- আমি বললাম গড ব্লেস ইউ। আর ভাবলাম হে ইশ্বর আমি নিশ্বাস নিতে পারছি এর জন্য তোমার কাছে থ্যাঙ্কফুল আমি......


১১টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×