প্রিয় পাঠক,
ছুটির দিনের এই রৌদ্রজ্জ্বল সকালে হয়ত চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার অলস মুহূর্তে আপনি এই লেখা পড়ছেন, কিংবা নিরন্তর জীবিকার খোঁজে ছুটে চলার ফাঁকে এ লেখা আপনার চোখে পড়েছে। যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন, আল্লাহ আপনাকে ভালো রাখুন। আজকের বাংলাদেশে সবচেয়ে কঠিন তো এই ভালো থাকা- তাই না?
দেখতে দেখতে দেড় মাস কেটে গেলো, পদ্মা মেঘনার পানি অনেকদুর গড়িয়েছে। আমার দেশ বন্ধ হয়েছে দুই বার- আবার প্রকাশিতও হচ্ছে। ধন্যবাদ আমার দেশের সাহসী সংবাদিকদের, যারা জালিম সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সাহসিকতার সাথে শুধু পত্রিকা প্রকাশই করছেন না বরং সরকারের নানাবিধ অসংগতির বিরুদ্ধে সোচ্চার আছেন। যে সব আইনজীবিরা হাইকোর্ট এবং সুপ্রীমকোর্টে দাঁড়িয়ে আমার দেশে'র পক্ষে, বাক স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই করেছেন, তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা। সন্তানের উন্নতিতে সব পিতা মাতারই চোখ জুড়ায়, আর আমার দেশ তো আমার কাছে সন্তানের চেয়েও বেশী কিছু।
কারাগারের এই নির্জন সেল আমাকে আর কিছু দিতে না পারুক, অখন্ড চিন্তার অবসর দিয়েছে। পাথুরে দেয়ালে আমার দৃষ্টি সীমাবদ্ধ, কিন্তু আমার চিন্তা চেতনাকে তো কোন দেয়াল আটকে রাখতে পারছে না। আমার প্রতিজ্ঞা এখন আরো কঠিন, ঠিক পাথরের দেয়ালটার মতো।
নেলসন ম্যান্ডেলা কে বছরের পর বছর এর চেয়েও নির্জন কারাবাস করতে হয়েছিলো, তাতে তো তার প্রতিজ্ঞা টলেনি। তাই বলে ভাববেন না, নিজেকে ম্যান্ডেলার মতো ভাবছি। ওসব বালখিল্য কল্পনা কেবল অর্বাচীনদেরই মানায়, যদিও বর্তমান রাষ্ট্রপতি আগের আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তার নেত্রীকে আব্রাহাম লিংকনের সাথে তুলনা করেছিলেন।
গতকাল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহান সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন, সন্ত্রাসকে তার সরকার প্রশ্রয় দেয়না। যেখানেই সন্ত্রাসী কার্যক্রম হয় সেখানেই পুলিশকে কঠোর হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করার পরেও তারা হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে গিয়ে আবার গন্ডগোল শুরু করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আইন আপনার, আদালত আপনার, আমলাতন্ত্র আপনার, আওয়ামী লীগও আপনার- এতসব 'আ' নিয়েও আপনি যদি পঞ্চম 'আ' -আক্ষেপই করেন, তাহলে আমরা ষষ্ঠ 'আ'- আমজনতা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো?
যে দেশে একজন মাহমুদুর রহমানকে দিনের পর দিন রিমান্ডের নামে নির্যাতন করা হয়, একজন প্রবীন কুটনীতিক শমসের মোবিন চৌধুরীকে রিমান্ডে নেয়া হয়, উদীয়মান তরুন রাজনীতিক ও জনপ্রিয় এমপি শহীদউদ্দীন চৌধুরী এ্যানি কে পিটিয়ে জেল হাজতে পাঠানো হয়, সে দেশে একজন ছাত্রলীগের পাতি সন্ত্রাসী কত সহজেই না জামিন পেয়ে যায়! হায় সেলুকাস!
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে সারি সারি আহত ছাত্রদের ছবি এখনো চোখে ভাসছে। আর ভাবছি, যদি এ দৃশ্যটা রাজশাহী বা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হতো? তখন হয়তোবা সময়ের সাহসী সাংবাদিকদের রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবিদের সারি সারি লাশের কথা মনে পড়তো।
কারাগারে বিরাট সেলে (যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ১৬-১৭ জন বন্দী থাকতেন বলে শুনেছি) আমাকে একাই রাখা হয়েছে। সম্ভবত: আমার সাথে রাখার মতো কাউকে কারাগারে পাওয়া যায় নি। যাকে রাখা হবে, সে যদি পরবর্তীতে আমার মতো হয়ে যায়? হাজার হলেও সততার একটা আলাদা শক্তি আছে, আর সেই শক্তির বলে বলীয়ান হয়েই লিখেছিলাম, 'সততায় পারবেন না মাননীয় প্রধানমন্ত্রী'। আজো সে প্রশ্নগুলোর উত্তর পাই নি।
জেলে আসার সময়ে বলেছিলাম, এই সরকার আমাকে জীবিত বের হতে দেবে না. বিশ্বাসটা নড়ে যাওয়ার কোন কারণ এখনো পাইনি। জেলে হাজারটা কষ্ট, সবচেয়ে বড় কষ্ট মনের কথা প্রকাশ করতে না পারা। যে আমার দিন শুরু হতো পাঠকের কাছে নিজের কথা পৌছে দিয়ে, সারাদিন কাটতো দেশের নিষ্পেষিত মানুষের অধিকারের কথা পত্রিকার মাধ্যমে জন গনের কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্রত নিয়ে, সেই আমি এখন মুক। আমার কলম কেড়ে নেয়া হয়েছে, একজন সাংবাদিকের মুক্ত কলম বোধহয় কখনো কখনো সমগ্র রাষ্ট্রের চেয়েও শক্তিশালী।
ইতিহাসের ছোট একটা গল্প দিয়ে শেষ করি। একজন ইংরেজ ইতিহাসবিদ বলেছেন, যদি ১৭৫৭ সালের পলাশীর ময়দানে ভারতবাসী একটা ছোট পাথরও ছুড়তো, তাহলে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা সত্ত্বেও সমস্ত ইংরেজসেনা পরাস্ত হতো।
তখন ভারতবাসী স্বাধীনতার দায়িত্বটা সৈন্যদের উপর দিয়ে নিজেরা ঘরে বসে ছিলো। যার মূল্য তাদের পরবর্তী দুইশ' বছর ধরে দিতে হয়েছে।
আজকে আমরা বাংলাদেশীরা'ও কি সেই একই কাজ করছি না?
ভালো থাকবেন।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



