সকাল থেকে বৃষ্টি। থামবার কোন আভাস নেই!
বই হাতে আনমনে মৃদু ঝম ঝম শব্দে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। দূর থেকে আকাশ চিড়ে বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা যাচ্ছে। অশনিসম্পাতের এই মহাক্ষণ মনে করিয়ে দিলো আপনার মৃদু হাসি। অদ্ভুত মায়াময় হাসি আপনার। দেখলে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।
চারিদিকে বাতাস বেড়েছে আরো। ইচ্ছে করে এই মুক্ত বাতাসে করে ভেসে যাই। হাতে থাকা ড্যান ব্রাউন সাহেব হয়ত বড্ড অপমান বোধ করছেন। কিছুক্ষণের জন্য তাকে ভুলেই গিয়েছিলাম। মেঝেতে থাকা কফির মগটাও তারই সঙ্গী। মা কে আরেক মগ কফি দিতে বললাম। এদিকে বিকেল আর সাঁঝের মাঝে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেছে। দিনের এই শেষ প্রান্তে এসে বৃষ্টির অবসান। রাস্তায় হাটু পানি জমেছে।
বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে কফির মগে চুমুক দিচ্ছি। পেছন থেকে হঠাৎ আওয়াজ এলো,
"কি ভাবছেন?"
পেছন ফিরে দেখি আপনি দাড়িয়ে। ভাগ্যের এই সমাপতন দেখে মোটেও অবাক হই নি। স্থির কন্ঠে বললাম,
"কিছুনা। আপনি এই সময়ে এখানে!"
বাসায় বসে বোর হচ্ছিলাম তাই চলে আসলাম গল্প করতে।
আমি গল্প করতে পারিনা।
শুনেছি আপনি ভালো গাইতে পারেন।
কে বলেছে আপনাকে?
রিমির মুখে সারাদিন আপনার গানের প্রশংসা শুনি।তার ফোনে আপনার রেকর্ডিংও শুনেছি।
আমি অপরিচিতদের গান শুনাই না। আপনি এখন আসতে পারেন।
জোর করে আপনাকে বিদায় জানাতে একদমি ভালো লাগছিলোনা। ইচ্ছে করছিলো ধমক দিয়ে বলি, দাড়ান! কোথাও যাবেন না। আমার পাশে এসে বসুন। আমি গল্প করব আপনার সাথে। সারাজীবন গল্প করব।
তা আর হলো কই! আপনি অভিমান করে চলে গেলেন। যাবার সময় মাকে বললেন আর ককখনোও আসবেন না। মা'র বুঝতে বাকি রইল না।তবুও আমায় কিছু বললেন না। হয়তো ছেলের অসামাজিকতায় তিনি অতিষ্ঠ।
আলো ছায়ার খেলার মতো ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে মুখরিত রাত। অন্ধকারে ছায়ার রঙ শুধুই নাকি কালো। জানালার পাশের ইজি চেয়ারে বসে হাজারো কল্পনার ভিড়ে আচ্ছন্ন হয়ে আছি। ইজি চেয়ারটার বয়স আমার সমান। শৈশবে দুলতে দুলতে আছড়ে পড়ার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে চড়ুই পাখির কলরবে ঘুম ভাঙলো। হাউস স্প্যারো।মানুষের আশপাশে বসবাস করতে এরা ভালোবাসে। প্রায় ১০হাজার বছর আগে এরা মানুষের সান্নিধ্যে এসেছিলো। মাত্র দুই দশক আগেও ঘরের ভেন্টিলেটরে চড়ুই পাখির সংসার দেখা যেত।
রোদ ঝলমলে সকাল। বারান্দায় সাদা-লাল-হলুদ পর্তুলিকার ফুলগুলো যেন বৃষ্টি শেষের রঙধনু সাঁজে সেঁজেছে। এমন সময় রিমি এসে জানালো অন্বেষা আমার উপর খুব রেগে আছেন।
আমি সে কথা কানে নিলাম না। তবে ভেতরে এক অজানা অনুতাপ আমায় গ্রাস করছিলো।
রিমি আমার ছোট বোন। এইচএসসি পাশ করে সদ্য ভার্সিটির আঙিনায় পা দিয়েছে। মাথায় জেইন অস্টেন এর মতো বিচারশক্তি না থাকলেও নাচে-গানে খুব পারদর্শী। এরই মধ্যে ঝুলিতে বেশকিছু পুরস্কার জমিয়ে ফেলেছে।
অন্বেষা তোর কথায় খুব কষ্ট পেয়েছে। তুই এক্ষুনি ওর কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইবি। চল আমার সাথে।
আমি চুপ করে রইলাম।
দেখ ভাইয়া অন্বেষার বাবা নেই। মায়ের পেনশনের টাকায় তাদের সংসার চলে। খুবই শান্ত স্বভাবের মেয়ে। এমন মেয়ের মনে কষ্ট দিলে আল্লাহও মাফ করবেন না।
রিমি হয়তো নিছক অভিমানে এসব বলেছিলো। কিন্তু কথাগুলো তীরের মতো আমায় আঘাত করল।
সকাল থেকে দুপুর এক আচ্ছন্ন অবসাদ আমায় গ্রাস করছিলো। বিকেলে ছাদে এলাম। বেশ কিছুদিন বৃষ্টি থাকায় বাগানের টবগুলোতে পানি দেওয়া হয় না। বাবার নিজ হাতে তৈরি বাগান। যেমন আছে চন্দ্রমল্লিকা,দোপাটি,গাঁদা,কৃষ্ণকলির মতো দেশীয় ফুল। তেমনি বাবা ইন্দোনেশিয়া, চীন থেকে আনিয়েছেন ডালিয়া,ক্যামেলিয়া,জিনিয়া,প্যান্সি আর বেশ কিছু হুয়াইট অর্কিড। বাবার বাগানপ্রেম দেখে একসময় আমিও গাছগুলোর প্রেমে পড়ে যাই। বাবা ব্যাস্ত থাকলে গাছগুলো তাদের নতুন ভৃত্য খুঁজে পায়।
পাশের বাড়ির ছাদে রহমান সাহেবের কবুতরেরা উড়ে বেড়াচ্ছে। খুব অদ্ভুত ব্যপার, কবুতরগুলো ঠিক ছাদের ব্যাসার্ধ ঘিরেই উড়ছে। ঝাঁঝরিতে করে দোপাটির টবে পানি দিচ্ছি। হঠাৎ সিড়িতে পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম।
তাকিয়ে দেখি অন্বেষা।
আমায় দেখে আবার উল্টো দিকে রওনা দিচ্ছিলো।তবে এবার কোনো এক সাহসে ভর করে বলে ফেললুম,
এই যে শুনছেন। দাড়ান! যাবেন না।
সংকোচের চোখে অন্বেষা উত্তর দিলো,
বলবেন কিছু?
হ্যাঁ। এদিকটায় আসুন।
বলুন কি বলবেন।
I'm really sorry for what happened yesterday.
আপনি ক্ষমা চাইছেন কেন! ক্ষমা তো আমার চাওয়া উচিত। আমিই নির্লজ্জের মতো আপনার ওখানে গিয়েছিলাম। দোষ টা তো আমারই বলুন!!
আমি সবার সাথে মিশে অভ্যস্ত নই। চারদেয়ালের মাঝেই আমার সময় কাটে। আমি,আমার বই আর এই বাগান। এরাই আমার কাছের মানুষ।
অন্বেষা চুপ করে রইলো। আমিও কিছু বললাম না। তবে এবার সে চলে যায়নি। ছাদের অন্য দিকটায় দাড়িয়ে আকাশ দেখছে। এদিক থেকে আমি মুগ্ধ হয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।
অন্বেষার দীঘল কালো চুল। মনে হচ্ছে শ্রাবণ মাসে যেন কালো মেঘ সাজ করেছে। নারীর সৌন্দর্য,রুচি আর ব্যাক্তিত্বের পরিচায়ক চুল।
হঠাৎ আকাশের থেকে মুখ ফিরিয়ে এদিকে তাকালো সে। আমি হুরমুরিয়ে পেছনে ঘুরে আবার এক ঝটকায় গাছে পানি দিতে লাগলাম।
হয়তো অন্বেষা আমায় দেখে মুচকি হেসেছিল সেদিন।
To be continued...
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০২১ সকাল ৮:২১