সাল ১৯২৪, লেখ্ নদীর তীরে ল্যান্ডসবার্গ দুর্গে কারাজীবন শুরু হয় এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবকের। সদ্য অতিক্রান্ত যুদ্ধের সাহসী বীর থেকে সে এখন আদ্যোপান্ত রাজনীতিবিদ।
কারাবরণের কারণ জানবার পূর্বে কয়েক দশক পেছনে দৃষ্টিপাত করা জরুরি।
সাল ১৯০৩, পরলোকগমন করেন অ্যাডল্ফের পিতা এলোইস। সমাজ সাপেক্ষে এলোইস এর জীবিন হয়তো কখনো সুখকর ছিলোনা। এলোইস ছিলেন তার মায়ের নীতিবিরুদ্ধ সন্তান। একারণে তাকে মায়ের পদবিতেই বড় হতে হয়। পরবর্তীতে তিনি হিটলার পদবি গ্রহণ করেছিলেন এবং তার পুত্র অ্যাডল্ফও আমৃত্যু এই পদবিই সর্বত্র ব্যবহার করে গিয়েছিলেন। সে যাইহোক, বাবার মৃত্যুতে অ্যাডলফের পরিবার টানাপোড়েনের জালে জড়িয়ে পড়ে। একসময় বন্ধ হয়ে যায় হিটলারের পড়াশোনা। লেখাপড়ায় সুবিধা করতে না পারলেও চিত্রাঙ্কনের প্রতি তার ছিলো প্রবল অভিনিবেশ।
১৯০৭ সালে মাকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যান হিটলার। জীবিকার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান ভিয়েনায়। সেখানে তিনি দিনমজুর এর কাজ করতেন। কখনো রঙ বিক্রি করতেন অথবা বিক্রি করতেন পোস্টকার্ড। এর বাহিরে ভিয়েনার রাস্তায় ছবিও এঁকেছেন পয়সার বিনিময়ে। যৎসামান্য এই উপার্জন নিয়ে দ্রুত বদলে যাওয়া শহরে দিন কাটাতে বেগ পেতে হতো তার। তাছাড়া চিত্রশিল্পী হিসেবেই তার সম্ভাবনা ছিলো অধিক।
সে আশাতেই পরীক্ষা দিলেন অস্ট্রিয়ার "একাডেমি অফ ফাইন আর্টস"-এ। সেখানেও পরপর দুবার নিগৃহীত হলেন।
এসবের গ্লানি মুছে ১৯১৩ সালে চলে আসেন মিউনিখে। ১৯১৪ তে চেষ্টা চালান সামরিক বাহিনীতে যোগদানের তবে স্বাস্থ্যগত সবলতার অভাবে সুযোগ পাননি। সে-বছরই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগদান করেন জার্মান সেনাবাহিনীতে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকেই সূচনা হয় তার জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের। বদলে যায় জীবনের গতিপথ। সে পথের শুরুটা কণ্টকাকীর্ণ। সেই সাথে উপরি পাওনা হিসেবে ছিলো প্রচন্ড অবহেলা। তবে খুব শীঘ্রই এই যুবকের হাত ধরেই রচিত হতে চলেছিলো পশ্চিম ইউরোপের নতুন ইতিহাস।
যুদ্ধের পুরোটা সময় হিটলার জার্মানিকে সেবা দিয়ে গেছেন ১৬ তম ব্যাভারিয়ান রেজিমেন্ট এর হয়ে। যুদ্ধে সাহসিকতা ও বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছিলেন " ফার্স্ট ক্লাস আয়রন ক্রুশ"।
কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেরে যায় জার্মানি। সেই সাথে ভার্সাই চুক্তির (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ) থাবায় দিশেহারা হতে শুরু করে জার্মান অর্থনীতি।
যুদ্ধাহত হিটলার সুস্থ হয়ে পুনরায় কাজ করতে থাকেন জার্মান সেনাবাহিনীতে। নিজের সক্ষমতা ও দূরদর্শিতার জানান দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি সেনাবাহিনীতে নিজের নাম ছড়িয়ে দেন। ১৯১৯ সালে সামরিক এজেন্ট হিসেবেই কাজ শুরু করেন "জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি"-তে। পরবর্তীতে এই দলটিই পট পরিবর্তন করে হয়ে ওঠে "জার্মান নাৎসি পার্টি"। তৎকালীন জার্মানির অর্থনীতি স্থিতিশীল ছিলোনা সেই সাথে ছিলোনা জার্মান নাগরিকদের মানসিক অবস্থা। যুদ্ধ পরবর্তী জার্মান নাগরিকদের মধ্যে বাসা বেধেছিল মানসিক অসন্তোষ।
এরই মধ্যে ১৯২০ সালে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ডানপন্থীদের এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। হিটলার তখন নাৎসি পার্টির উদীয়মান নেতা। তিনি বিভিন্ন দফা পেশ করা শুরু করলেন, প্রকাশ করলেন স্বস্তিকা চিহ্নযুক্ত বিখ্যাত সেই নাৎসি পতাকা। দলের ব্যানারটিও তার নিজ হাতে বানানো। এছাড়া ইহুদিদের বিরুদ্ধে তার বিদ্বেষমূলক নানা বক্তব্য তাকে দ্রুত খ্যাতি এনে দেয়।
১৯২১ সালে নাৎসি দলের চেয়ারম্যান ডেক্সলারকে পদত্যাগ করিয়ে নিজেই দলের প্রধান নিযুক্ত হন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের চুক্তি মোতাবেক ফরাসিদের নিকট জার্মানদের অর্থ পরিশোধের যে বিধান ছিলো তা ধীরে ধীরে অসহনীয় হয়ে যায়, জন্ম দেয় ক্রোধের। ফরাসিদের নিকট এই বিধান স্থগিতকরনের প্রস্তাব দিলেও তারা তা প্রত্যাখ্যান করে। এমন সময় হিটলারের বৈষম্য বিরোধী বিয়ার হলের বক্তৃতাগুলি নিয়মিত আকৃষ্ট করতে থাকে জনসাধারণকে। ক্রমেই অনুসারী পেতে থাকেন হিটলার। বিশেষ করে তরুণরা দলে দলে যোগদান করতে শুরু করে পার্টিতে। সারাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন হিটলার।
বিয়ার হল অভ্যুত্থান-
১৯২৩ সালে গুস্তাভ স্ট্রেসম্যান জার্মানির চ্যান্সেলর পদে আসীন হন ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তিনি ঘোষণা দেন ফরাসি দের ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করবেন। তার এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে গণবিক্ষোভের আশঙ্কা থাকায় তিনি জরুরি অবস্থা জারি করেন। দেশজুড়ে এই উত্তেজনা চলাকালীন সময়ে হিটলার বিয়ার হাউজে ঘোষণা করেন জাতীয় বিপ্লব শুরু করার। হিটিলারের এই ঘোষণা জন্ম দেয় এক পরিকল্পিত অভ্যুত্থানের। বিয়ার হাউজের সেই স্ফুলিঙ্গ থেকে জাত হওয়া অভ্যত্থানটি ইতিহাসে "বিয়ার-হল অভ্যুত্থান" নামে পরিচিত। তবে অভ্যুত্থানটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়।
অভ্যুত্থান এর তিন দিনের মাথায় গ্রেফতার করা হয় হিটলারকে।
১৯২৪ সালের ১ এপ্রিল মিউনিখ গণ আদালতের এক বিচারকার্যে তাকে ৯ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। প্রেরণ করা হয় ল্যান্ডসবার্গ দুর্গে। এই কারাবরণ জনগণের মাঝে তার জনপ্রিয়তা আর গ্রহণযোগ্যতাকে বাড়িয়ে দিয়েছিল কয়েক হাজারগুন।
কারাগারে থেকে হিটলার রচনা করেন তার বিখ্যাত "মাইন ক্যাম্ফ" গ্রন্থটি যা তখন জার্মান নাগরিকদের কাছে আলোক বার্তা হয়ে ধরা দিয়েছিল।
এই জনপ্রিয়তা,গ্রহণযোগ্যতা-ই তাকে পরবর্তীতে চ্যান্সেলর পদে নিয়ে যায়। সরকারপ্রধান হিসেবে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কও হয়ে যান। সমস্ত ক্ষমতা দিয়ে বৃদ্ধি করতে থাকেন সামরিক শক্তি। তার এই সাফল্যের কেন্দ্রে ছিল জনগনকে অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে ঘুরে তিনি বৈষম্য আর আর্তনাদের কথা বলতেন। এসব কৌশলই তাকে জার্মান নাগরিকদের সমর্থন আদায়ে সাহায্য করেছিল।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০২১ সকাল ৮:২২