somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেখা-অদেখায়, সাম্প্রদায়িকতায়...

১১ ই মে, ২০২১ রাত ৩:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছোটবেলায় আমি খুব মাহফিলে যেতাম। এলাকায় যেগুলো হতো সেগুলোয় তো যেতামই, বহু দূরের গ্রামে যেগুলো হতো সেখানেও যেতাম। অত দূর পথ হেটে যাওয়া যেত না, আর আমার কোনো সাইকেলও ছিল না, তাই পাশের বাড়ির এক চাচার সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে যেতাম। বিভিন্ন জায়গা থেকে ভাড়া করে আনা হুজুরেরা আসত। কখনো সুর করে, কখনো গলা উঁচু করে, কখনও বা কেঁদে কেটে ওয়াজ করত। শুনতে বেশ ভালোই লাগত।
বিলিভ ইট অর নট, বাংলাদেশের আনাচেকানাচে হওয়া এরকম প্রতিটা মাহফিল মূলত সাম্প্রদায়িক মানসিকতা তৈরির প্রথম এবং প্রধান হাতিয়ার। প্রতিটা মাহফিলে একটা জিনিসই কমন থাকত সেটা হচ্ছে বিধর্মীদের প্রতি সীমাহীন ঘৃণা। হিন্দুদেরকে "মালাউন" বলে গালি না দিলে যেন কোনো হুজুরের ভাত হজম হতো না এমন একটা অবস্থা। নিয়মিত যারা ওয়াজ মাহফিলে যেত তাদের মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গিয়েছিল যে হিন্দু মানেই খারাপ। মুসলিম বাদে অন্য যত মানুষ আছে তারা সবাই খারাপ! আর লোকজন এই ধারণা শুধু নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখত না, বরং মহা উদ্যমে তা আশেপাশের মানুষের মাঝেও ছড়িয়ে দিত। শুধু ওয়াজ মাহফিল না, এমনকি জুম্মার নামাজে ইমামের বয়ানেও এ ধরণের কথা শুনে আমি বিস্মিত হয়েছি! ওয়াজ হোক বা জুম্মার বয়ান, এতে কী পরিমাণে ফলস ইনফরমেশন যে শেয়ার করা হয় তা কেউ না শুনলে বিশ্বাস করতে পারবেন না! শহরের গণ্ডি পেরিয়ে একদম গ্রাম এলাকায় যদি প্রবেশ করেন তাহলে বুঝতে পারবেন মানুষ কতটা সাম্প্রদায়িক মানসিকতার।
আমার কৈশোরের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছি মসজিদের ভেতর। ওইসময় যেসব ইমামরা মসজিদে ছিল তাদের সাথে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। খুব কাছ থেকে তাদের পর্যবেক্ষণ করেছি, তাদের আচরণ দেখেছি, কথা শুনেছি। বলতে বাধ্য হচ্ছি এরপর এদের উপর থেকে রুচি উঠে গেছে। এক ইমামের কথা আমার মনে আছে, সে জুম্মার দিন জিহাদ নিয়ে কড়া বয়ান দিত, অথচ মসজিদে বসে পর্ণ দেখত! মোটেও বাড়িয়ে বলছি না, যা সত্য তাই বলছি। আরেক ইমাম বয়ানে মালাউনদের গালি দেয়, অথচ মক্তবে পড়ানোর সময় মেয়েদের গায়ে হাত দেয়! বলা শুরু করলে আরো বলতে পারব তবে আমি যা বোঝাতে চেয়েছি আশা করি দুইটা উদাহরণেই তা স্পষ্ট হয়েছে।
এখন, এই ২০২১ সালেও গ্রামের বাজারে গিয়ে চায়ের দোকানে আড্ডা শুনে আমি অবাক হয়ে যাই! খবরে যখন দেখায় ভারতে মানুষ মারা যাচ্ছে, তখন তারা হাসিমুখে উল্লাস করে! কারণ যে মানুষগুলো মারা যাচ্ছে তারা সবাই হিন্দু। হিন্দুদের মৃত্যু যে আনন্দ করার মতো বিষয় এই শিক্ষাটা তো তারা সেই ছোটবেলা থেকেই পেয়ে এসেছে। তাদের আর দোষ কী!

আমাদের এলাকায় কোনো হিন্দু পরিবার ছিল না। দূরের এক গ্রামে দুইটা হিন্দু পরিবার ছিল, তাদের একজন আমাদের বাজারে চুল কাটত। তো সেই ব্যক্তির সাথে বাজারে অন্য যারা ছিল তাদের দেখতাম বেশ ভালোই সম্পর্ক। কিন্তু এই ভালো সম্পর্ক দেখানোটা ছিল স্রেফ বাইরে থেকে, ভেতরে ভেতরে সাম্প্রদায়িক ভাবনা ঠিকই ছিল। দুইটা ঘটনা বললেই বুঝতে পারবেন। তখন ফিচার ফোন মোটামুটি জনপ্রিয় হচ্ছে, মানুষজন রিংটোন হিসেবে ফোনে গান সেট করছে। এমনই একদিন সেই হিন্দু লোকটির ফোন বেজে উঠল, রিংটোন সেট করা ছিল তখন জনপ্রিয় হওয়া "হরে রাম হরে রাম, হরে কৃষ্ণা হরে রাম"। তো এটা শোনার পর আশেপাশে যারা ছিল তাদের রিয়্যাকশন হলো ভয়াবহ! দুয়েকজন তো সরাসরিই বললেন, "এই বেডা এইডা কী লাগাইছো, পাল্টাইয়া ফেল।" তো বেচারা বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে শেষমেশ তাদের সামনে বসে রিংটোন পাল্টাতেই বাধ্য হয়।
আরেকদিনের ঘটনা। যেহেতু তার চুল কাটার সেলুন ছিল, তাই সেখানে বড় আয়নাও ছিল। তো এলাকার ছেলেপুলেরা যারা বাজারে আড্ডা দিত তারা মাঝেমধ্যেই দোকানে গিয়ে চুল আঁচড়াতো। এমনই একদিন এক ছেলে চুল আঁচড়াতে গিয়ে লাইট জ্বালালে ওই লোক বাধা দেয়। এতে জনৈক মুসলিম ভাইয়ের খুব ইগোতে লাগে। সে গালাগালি করতে করতে বের হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর আরো দুয়েকজন হ্যাডমওয়ালা ছেলেকে সাথে নিয়ে আসে। "হালা মালাউনের বাচ্চা, আমাগো বাজারে দোকান দেও আবার আমাগো লগেই ঝগড়া লাগাও। মালাউনের বাচ্চা মালাউন," এরকম বলতে বলতেই তার দোকানে ঢুকে তাকে চড়-থাপ্পর দেয় এবং দোকানের গ্লাসগুলো ভেঙে দেয়! যেই ছেলেরা গ্লাসগুলো ভাঙলো এরা কিন্তু দূরের কেউ নয়! এরাই কিন্তু সেলুনের ওই লোকের সাথে একসাথে চা-সিগারেট খায়, সুযোগ পেলে ফ্রিতে চুল-শেভ করিয়ে নেয়। অথচ, এরাই মনে মনে বিশ্বাস করে "ওই শালা মালাউন, হিন্দুর বাচ্চা, আমাদের থেকে সবসময় নীচে থাকবে।"
দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত জনগোষ্ঠীও কিন্তু ঠিক এভাবেই ভাবে। যদিও নিজেদেরকে কুল দেখানোর জন্য তারা হিন্দুদের সাথে মিশে ঠিকই, কিন্তু মনে মনে সুপিরিয়র ভাবটা থেকে যায়। কলেজে পড়ার সময় দেখতাম হিন্দু মেয়েদেরকে নিয়ে ছেলেরা কী ধরণের নোংরা মন্তব্য করত। অনেকে বলবেন ওরা তো সব মেয়েকে নিয়েই করে। হ্যাঁ তা ঠিক, তবে হিন্দু মেয়েদের নিয়ে ওদের মন্তব্যের ধরণটা এমন ছিল যে, "এই মেয়ে হিন্দু ঘরে জন্মেছে, এরে রেপ করলেও সমস্যা নাই।"
যেহেতু আমার নিজের বেড়ে ওঠা গ্রামে, তাই একটা সময় আমি নিজেও এই ধরণের ধারণাগুলো পোষণ করতাম। কিন্তু একটা সময় যখন অন্ধ অনুকরণ বাদ দিয়ে প্রশ্ন করা শিখলাম, তখন থেকেই ধীরে ধীরে এই মানসিকতা থেকে বের হয়ে এসেছি। কতটুকু পেরেছি জানি না, তবে এই ধরণের হীন চিন্তার বিরুদ্ধে আমৃত্যু লড়াই চালিয়ে যাব।

আমার লেখা অনেকেরই ভালো লাগবে না, অনেকে গালি গালাজও করতে পারে, কিন্তু এখানে যা বলেছি তার এক বিন্দুও মিথ্যে নয়। আমার এই ক্ষুদ্র জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত কিছু অংশই তুলে ধরেছি। দেশে সাম্প্রদায়িকতা নেই বলে যারা মনে করেন, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করুন। কে জানে, আপনার নিজের মধ্যেও হয়ত পেয়ে যেতে পারেন!
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০২১ রাত ৩:১৪
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×