ঈশ্বর বিশ্বাসী একজন মানুষ যখন কোন সমস্যা তার নিজ বিচার, বুদ্ধি ও সক্ষমতায় করতে অসমর্থ হয়, তখন তার একমাত্র যে উপায়টি তার কাছে খোলা থাকে তা হলো ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা। মানুষ ঈশ্বরের কাছে তার প্রার্থনা করে সাধারণত তার নিজস্ব বিশ্বাস, স¤প্রদায়গত বিশ্বাস বা ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে। সে মনে করে এখানে সে ঈশ্বরের কাছ থেকে বিশেষ কোন আশির্বাদ লাভ করতে পারবে। অনেক সময় প্রার্থনার সময় তাদের চোখ বেয়ে অশ্র“ নেমে আসে। তারা ঈশ্বরকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে এবং তারা এটাও বিশ্বাস করে ঈশ্বরই তাদের ব্যাথা সবচেয়ে বেশী বুঝতে পারবে। মানুষ ঈশ্বরকে ততটাই ভালবাসে যতটা তারা তাদের পিতামাতাকে ভালবাসে। সব ধর্মমতই কোন না কোন মহাপুরুষ প্রচার করেছেন। কিন্তু ঈশ্বরের প্রতি প্রত্যেকের ভালবাসা একটি সহজাত বিষয়। এটি অন্তরের
অন্তঃস্থল থেকে স্বতঃ উৎসারিত হয়। কিন্তু একজন মানুষ ঈশ্বরের নৈকট্য পেতে একজন মাধ্যম বা মধ্যস্থতাকারীর শরণাপন্ন হয়। কারণ ঈশ্বর সম্পর্কে জানার আর কোন উৎস নেই। আমিও ঈশ্বর সম্পর্কে জানতে পরিবারের গুরুজন, ধর্মীয় গুরু ও ধর্মীয বইয়ের উপর নির্ভর করতে হয়েছে । আমি আমার অতি আপনজন এক ব্যাক্তির অভিজ্ঞতা এখানে তুলে ধরছি। তিনি তার জীবনের ৬০ বছর দুঃখ, কষ্ট ও যন্ত্রনার মধ্যে অতিক্রম করেছেন । জীবনে এমন কিছু মুহুত্বেরও অবশ্য তিনি সম্মুখীন তিনি হয়েছেন যা তাকে প্রাণ ভরে হাসতে ও আনন্দে থাকতে সাহায্য করেছে। একজন সাধকের রচিত একটি কবিতা আমি মায়ের মুখে শুনেছিলাম। তিনি লিখেছিলেন, মানুষের জীবনে সুখ হলো তিলের মত আর দুঃখ হলো পাহাড়ের মত। আমরা সবাই যদি আমাদের অতীত জীবন সম্পর্কে ভাবি তাহলে দেখতে পাব, আনন্দময় ঘটনা ছিল গুটিকয়েক এবং দুঃখ-যন্ত্রনার ঘটনা ছিল অসংখ্য। আমি যার জীবনের অভিজ্ঞতা বলছি, তিনি সেসব মানুষদের মত না যারা জীবনে অনেক সাফল্য অর্জন করেছেন এবং অনেক ধন উপার্জন করেছেন। তিনি তাদের মত ভাগ্যবান নন। তিনি জীবনে যত বিষয় নিয়ে মন প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি ব্যর্থতার তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। মাঝে মধ্যে তিনি কিছু সফলতা অর্জন করেছেন তাও বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। তিনি ঈশ্বরের পরম ভক্ত ছিলেন। তিনি একজন জন্মগত হিন্দু হয়েও অন্যান্য ধর্মালম্বীদের প্রার্থনালয়ে যেতে কখনো বিব্রতবোধ করেননি। কারন তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ঈশ্বর একজন, একাধিক হতে পারেন না। কয়েক বছর আগেও তিনি ঈশ্বরের পরম ভক্ত ছিলেন। তিনি দৈনিক ঘন্টা করে আরাধনা ও প্রার্থনা করতেন। তিনি স্মরণ করেছিলেন, তার জীবনের একটি পুরানো ঘটনা। তিনি ব্যাংক ব্যবস্থাপকের চাকরি ছেড়েছিলেন আরো বেশী আয়ের জন্য এবং সরকারী ঠিকাদার হিসেব তিনি তার ব্যবসা শুরু করেছিলেন। ১৯৮৭ কি ১৯৮৮ সালের কথা এটা ছিল এপ্রিল মাস, যখন সাধারণত খুব গরম থাকে।তাপমাত্রা সাধারণত ৪০-৪৭ এ উঠা-নামা করে । তিনি তখন তীব্র অর্থ সংকটে এবং পাওনাদাররা তাকে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল। ঐ দিন তিনি একটি কাজ পেয়েছিলেন আর.সি.সি ঢালাইয়ের। যার থেকে ৫লক্ষ টাকা পাবেন। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন যত তাড়াতাড়ি তিনি টাকা পাবেন , তত তাড়াতাড়ি তিনি পাওনাদারদের টাকা পরিশোধ করতে পারবেন। সকাল থেকে সন্ধ্যাবধি প্রায় ১০০ জন শ্রমিক কাজ করে সেই কাজ শেষ করেছিল। তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন এবং সারাদিন রোদের মধ্যে কাজ করে ক্লান্ত হয়ে তিনি বাড়ি ফেরার উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। হঠাৎ কালো মেঘে আকাশ ডেকে যেতে শুরু করলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে বৃষ্টি শুরু হলো। এত মুষলধারে বৃষ্টি হলো যে, নেমে আসা পানিতে স্লেভ এর পুরো কাজটি নষ্ট হয়ে গেল। তার চোথের সামনেই তিনি দেখতে পেলেন এত মানুষের এত পরিশ্রম নিমিষেয় নষ্ট হয়ে গেল। বৃষ্টির সময় তিনি ঈশ্বরের কাছে কত প্রার্থনা করেছিলেন, কিন্তু হায়! ঈশ্বর তার প্রার্থনা শুনেননি এবং তাকে রক্ষাও করেননি। পরবর্তী দিন তিনি টাকা পাননি এবং পাওনাদাররা তাকে মারধর করল।তাদের একজন তার বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা দিল। এ মামলার কারণে তাকে কয়েক বছর ঝামেলা পোহাতে হল। পরবর্তীতে তিনি সমঝোতার মাধ্যমে ছাড়া পেলেন। সাধারণত কেউই এপ্রিল মাসে বৃষ্টি কল্পনাও করে না। তিনি সতর্কতার সাথেই তার কাজ সমাধা করেছিলেন। কিন্তু কেউই দূর্ভাগ্যকে এড়াতে পারে না। এটা যে শত শত দূর্ভাগ্যের তিনি স্বীকার হয়েছিলেন তার একটি উদাহরণ মাত্র। তিনি যে জ্ঞাণ অর্জন করেছিলেন তা বই পড়া বিদ্যা নই। তার জীবনের ৫টি যুগের অভিজ্ঞতা। আমি এখানে ঐ ব্যাক্তি ও আমার জীবনের অভিজ্ঞতালব্দ জ্ঞান প্রকাশ করছি। আমি কোন মত বা বিশেষ ধর্মকে প্রচার করতে চেষ্টা করছি না। অন্যকোন ধর্মের সমালোচনাও করছিনা। অনেকে হয়ত এ প্রবন্ধ পড়ে এ ধারণা পোষন করতে পারেন আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না। তারা আমাকে নাস্তিক মনে করতে পারেন। কিন্তু এটা সত্যি নয়। আমার ঈশ্বরে বিশ্বাস আছে এবং আমি ঈশ্বরকে খুবই ভালবাসি।আমার ভালবাসা কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল যখন আমার মধ্যে আত্মপোলব্দি এসেছিল। আমি সবার সাথে এ উপলব্দি শেয়ার করতে চায়, যারাও ঈশ্বরকে ভালবাসে। যে ব্যাক্তির অভিজ্ঞতা এখানে তুলে ধরছি তিনিও এমন জ্ঞাণ অর্জন করেছেনা। যার কারণে কোন কিছুই এখন আর তার সুখকে নষ্ট করতে পারে না। এখনও রোদ আছে, এখনও বৃষ্টি হয়, কিন্তু জ্ঞাণের ছাতা দিয়ে তিনি এতটাই সুরক্ষিত যে, সকল রকমের সমস্যার মধ্যেও তার মনকে শান্ত ও আনন্দময় রাখে। তিনি তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও পড়াশুনাতে দেখেছেন, আবেগময় যে প্রার্থনা তা পরিস্থিতি মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়। বরংচ শান্ত-শিষ্টভাবে ঐ দূর্ভাগ্যের বা ঐ পরিস্থিতির কারণ অনুসন্ধানই খারাপ পরিস্থিতিকে জয় করতে মূখ্য ভূমিকা পালন করে। তাই আমি ঐ ব্যাক্তির পক্ষ থেকে বিণীত অনুরোধ রাখছি প্রবন্ধটি এমন একজন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখুন যিনি তার যৌবনের অধিকাংশ সময় দুঃখ, কষ্ট ও যন্ত্রনার ভিতর দিয়ে পার করেছেন। তথাকথিত প্রার্থনা তার জীবনে কোন কাজে লাগেনি। তাই তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন শুধুমাত্র প্রার্থনা কারো জীবনে কাজে লাগেনা। এ প্রসঙ্গে আমার গুরু বলেছেন, প্রার্থনাতে কইলি কত/ করলি না তো কাজে/ ফুটলো ওটা কল্পনাতে/ ফলটা পেলি বাজে।
এটা মানুষের উদারতা যে, মানুষ যে গুটি কয়েক সৌভাগ্য জীবনে অর্জন করে তার জন্য তারা প্রার্থনাকে সাধুবাদ দেন। এটা তাদের মহত্ত্ব যে তারা তাদের অকৃতকার্যতার জন্য কখনোই প্রার্থনাকে দায়ী করেন না। এমনকি জীবনে ক্রমবর্ধমানভাবে দুঃখ পাওয়ার পরও।
এখন প্রশ্ন হলো কেন মানুষ ঈশ্বরের প্রার্থনা করে?
আমরা যদি পুরো মানব গোষ্টীকে বিবেচনা করে নিরপেক্ষভাবে, শান্তভাবে এবং অতীত সব চিন্তাধারা বাদ দিয়ে চিন্তা করি। তাহলে এটা বুঝতে কোন অসুবিধা হয় না যে, কেন মানুষ পৃথিবীতে ঈশ্বরের প্রার্থনা করে।
১. অজানাকে ভয়।
২. জীবনে দুঃখ কষ্ট থেকে দূরে থাকার যে তীব্র ইচ্ছা।
৩. স্বাস্থ্যের চিন্তা ও মৃত্যু ভয়।
৪. বৈষয়িক জীবনে আনন্দ উপভোগের লোভ।
৫. একটি সহজাত প্রবৃত্তি, নিজের মঙ্গলের জন্য সুপার পাওয়ারের আশির্বাদ লাভের জন্য।
৬. সহজাত প্রবৃত্তি নিস্বার্থভাবে ঈশ্বরের নৈকট্য লাভের ইচ্ছা।
৭. ধর্মীয় চাপ (প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ)।
যদি এই সাতটি বিষয় আপনার মনে অনুপস্থিত থাকে,তাহলে আপনার সম্ভবত ঈশ্বরের কোন প্রয়োজন হবে না। আপনি হবেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। আপনার ঈশ্বরের প্রয়োজন কারণ, উপরের ৭টির যেকোন ১টি বা ৭টিই আপনার মনে বা অবচেতন মনে বিদ্যমান।
হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রেও এটা পরিষ্কার উল্লেখ আছে। ঈশ্বর কেন? আমাদেরই বা ঈশ্বরের দরকার কেন? পুরাতন ধর্ম শাস্ত্রে বলা হয়েছে, মানুষের জীবনের সকল দুঃখকে দূর করে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি অর্জন করাই হলো এর কারন। কেন একজন আধ্যাত্বিক বিজ্ঞানের জ্ঞান অর্জন করে?
এখন আমরা একবিংশ শতাব্দিতে। আমরা আমাদের জ্ঞান দ্বারা ঈশ্বরকে জানতে চায়। এটা তথ্য প্রযুক্তির যুগ। আমরা যেসব বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করি সেসব বিষয়ে আমাদের জানার প্রয়োজন রয়েছে। ঈশ্বর সম্পর্কেও আমাদের জানা দরকার। আমরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করি কারণ, বইয়ে আমরা পড়েছি ঈশ্বর আছেন অথবা পুরোহিত আমাদেরকে বলেছেন। কিন্তু এ বিষয়টি নতুন প্রজন্ম এতটা সহজে গ্রহন করবে না। যেসব ছেলেরা জীবনের শুরু থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শিক্ষা লাভ করেছে। তারা সহজে তা মেনে নেবে না। এটাই প্রধান কারণ শিক্ষিত ছেলেরা কেন ঈশ্বরে অনাগ্রহী। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ঈশ্বরে বিশ্বাস হারিয়েছে। তারা এমন স¤প্রদায়ে ঝুঁকেছে, যারা পুরোপুরি নাস্তিক এবং ঈশ্বরের অনুপস্থিতির মত প্রচার করছে। তারা এটাকে আধুনিকতা বলে প্রকাশ করতে চাই। এটি মানব সভ্যতার জন্য হুমকি স্বরুপ যে, তার আগামী প্রজন্ম ঈশ্বরে বিশ্বাস হারাচ্ছে। সমগ্র পৃথিবী জুড়ে যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস হারাচ্ছে তারা মনুষ্যত্ব ও চরিত্রহীন হয়ে পড়ছে। নতুন প্রজন্ম বিকৃত আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত হয়েছে (অসংযত যৌনাচার, সংগীত, মাদক ইত্যাদি)। ঈশ্বরকে ভালাসার ও খোজার বদলে। সকল ধর্মীয় গ্রন্থ তাদের উপর নিয়ন্ত্রন হারিয়েছে। শুধুমাত্র তরুন প্রজন্ম কেন? ঈশ্বর সম্পর্কে অজ্ঞতা ও আরাম আয়েশের চিন্তায় নিমগ্ন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
চলমান...........