আমাদের এই বাড়ীর সামনের অংশে আব্বার ফুল বাগান ছিল। হাস্নাহেনা ফুলের ঘ্রাণে নাকি সাপ আসতে এই বাগানে। হেমন্তর রাতে যখন আমরা ছাদে ঘুমাতাম তখন তীব্র এক আশ্চর্য্য সৌরভে সিক্ত হতে হতে তলিয়ে যেতাম নিদ্রার গভীরতম স্তরে।
মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে দেখতাম তারাভরা আকাশ অথবা ক্ষয়ে যাওয়া মরা একাদশীর চাঁদ। মোড়লপাড়ার দিক থেকে থেমে থেকে একটা টক্কোসাপ (তক্ষক) ডাকতো; কখনও ভুতুমের আওয়াজ পেতাম। স্বপ্ন আর জাগরনের মধ্যভাগে যেন আমার কৈশোরিক অস্তিত্বের পুরোটা জুড়ে খেলা করতো বিনম্র এক অপার্থিব শিহরণ।
বাগানে কয়েক রকমের জবা ফুল ছিল। একটা গন্ধরাজ গাছ আর একটা আতা গাছ ছিল। আরও কিছু গাছ যেমন বাগানবিলাশ আর গেইটফুলের ঝোপ ছিল। সাদা সাদা একরকম ফুলের ঝাড় থেকে আমরা ছোটছোট ফুলের মধু চুষে খেতাম। একটা লম্বা ইউক্যালিপটাস ছিল। আমি চোখ বুজলেই সেই বাগানটি দুলে উঠে আমার স্মৃতির আয়নায়!
সেই বাগানের কোন ফটোগ্রাফ আমার কাছে নেই। ইট বসানো উঠানের একপাশে বালিগাদা আর কলাগাছের ঝোপের আগে শিউলী ফুলের মাঝারী গাছ। পিছনে বাতাবী লেবু আর বড় কৃষ্ণচূড়া। একটা তুলশী গাছও আব্বা লাগিয়েছিল। পাশে বড়ফুফুর রান্নাঘরের পিছনে ছিল কালো জামের মস্ত হেলানো গাছ। একটা বুনো কুলগাছ। ও হ্যা আর একটি কুলগাছ ছিল আমাদের বারান্দায় উঠার আগে। ডালিম গাছ ছিল একটা। আব্বার শখ ছিল গাছ লাগানো। ফুল আর ফলের। এমনও হয়েছে প্রয়োজনীয় বাজার না করে আব্বা গাছ কিনে এনেছেন।
ধূপছায়ার মতো সে সময়েরা। গোধূলীর মতো ক্ষণিক। শীতের ভোরের ক্ষণজন্মা সাদা সাদা হাস্নাহেনার মতো এই জীবন। আজ আব্বা নেই, আব্বার বাগানটি নেই। সেই গাছগুলোর একটিও নেই। একটা ফটোগ্রাফও নেই। জীবন তো এমনই, মাঝারাতের ভেঙে যাওয়া ঘুম, শিউলী ফুলে ছেয়ে যাওয়া উঠান, বাগানের বেড়াফুলগাছটির মতো, আব্বার মতো…..
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০২৩ রাত ৯:১৬