মাহমুদা খাতুন। বৃহস্পতিবার রাতে টেলিভিশনে বাংলাদেশ-ভারতের ওয়ানডে ম্যাচ দেখছিলেন। হঠাৎ দেখলেন ভারতের অধিনায়ক ধোনি কনুই দিয়ে সজোরে ধাক্কা দিল ১৯ বছর বয়সী নবীন পেসার মুস্তাফিজকে। উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়লেন তিনি। দাঁতে দাঁত চেপে খেলা দেখে গেলেন। মুস্তাফিজের নেয়া পাঁচ উইকেটের সহযোগে ৭৯ রানে বিজয়ী হলো বাংলাদেশ।
ম্যাচ শেষে আর সহ্য করতে পারলেন না মাহমুদা, সরাসরি ফোন দিলেন মুস্তাফিজকে। কতখানি ব্যাথা পেয়েছেন তিনি। কেমন আছেন, সুস্থ্যতো। একের পর এক প্রশ্ন করে জর্জরিত করলেন মুস্তাফিজকে। আর বৃহস্পতিবার রাতে ১৭ কোটি বাংলাদেশের নায়ক মুস্তাফিজ বিজয় উদযাপন বাদ দিয়ে এই নারীকে সান্ত্বনা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এক পর্যায়ে তাকে আশ্বস্ত করেই স্বস্তি মেলে মুস্তাফিজের।
আসলে এছাড়া আর উপায় কি। সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা মাহমুদা খাতুন হলেন মুস্তাফিজের মা। ছেলে খেলছেন বলে বিকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত খেলা দেখেছেন। ধোনির আঘাতটা ছাড়া ছেলের সব কিছুই ছিল কবিতার মতো। মায়ের চোখের সামনেই অভিষেকে ম্যাচে মুস্তাফিজ পাঁচ উইকেট নিয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটে দশ ভাগ্যবানদের একজন হয়ে উঠেছেন। হাসি ফুটিয়েছেন সমগ্র বাংলাদেশে।
মুস্তাফিজের বাবা আলহাজ আবুল কাশেম গাজী। পেশায় ব্যবসায়ী তিনি। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে মুস্তাফিজ সবার আদরের ছোট ভাই। বড় ভাই মাহফুজার রহমান মিঠু খুলনায় গ্রামীণফোনের টেরিটরি অফিসার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন, মেজ ও সেজ ভাই ঘের ব্যবসায়ী।
তার ক্রিকেট খেলায় আসার পেছনে সেজ ভাই মোখলেসুর রহমানের অবদানই সবচেয়ে বেশি। কালীগঞ্জ থেকে প্রতিদিন সাতক্ষীরা শহরে মোটরসাইকেলের পেছনে চড়িয়ে নিয়ে যেতেন তিনি। বড় ভাই এক সময় ক্রিকেট খেলতেন, মেজ ভাইও কম যান না, আর সেজ ভাই এখনও ক্রিকেট খেলেন।
সেজ ভাই মোখলেছুর রহমান পল্টু ছোট ভাইয়ের বেড়ে ওঠার গল্প শোনান। তিনি বললেন, “পড়াশোনায় অতটা মন তার কখনোই ছিল না। স্কুল ফাঁকি দিয়ে সে ক্রিকেট খেলতে যেত। বাসায় তো বলেই দিয়েছিল, আমার দ্বারা ওসব হবে না। তোমরা আর জোর করো না। এর পর থেকে ক্রিকেটই তার ধ্যানজ্ঞান। কালীগঞ্জের বরেয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে নেট প্র্যাকটিস করতেন মুস্তাফিজ। এই তো বছর পাঁচেক আগের কথা। সাতক্ষীরায় অনূর্ধ্ব-১৪ ক্রিকেটে বাছাই পর্বে নজর কাড়েন সবার। তারপর তিন দিনের কোচিং ক্যাম্প করানো হয়। এরপর জেলা পর্যায়ে অনূর্ধ্ব-১৬ ক্রিকেট খেলায় সাতক্ষীরার হয়ে প্রথম মাঠে নেমেছিলেন মুস্তাফিজুর।”
সাতক্ষীরা গণমুখী সংঘের কোচ আলতাফই প্রথম ধরতে পেরেছিলেন মুস্তাফিজের ভেতরের “ধারটা”। জেলা পর্যায়ে এসে মুস্তাফিজকে আরও পরিণত করে তুলতে পরিশ্রম করেন সাতক্ষীরার জেলা কোচ মুফাসিনুল ইসলাম তপু।
জেলা পর্যায়ের পর খুব বেশি দিন তাকে অপেক্ষা করতে হয়নি। ডাক পেয়ে যান খুলনার বিভাগীয় দলে খেলার। বছর তিনেক আগে শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ফার্স্ট বোলিং ক্যাম্পে ট্রায়াল দিতে এসে কোচরা আর ছাড়েননি এ প্রতিভাকে। নিয়মিতই অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলেছেন। বল করতেন জাতীয় দলের নেটেও। তবে সম্ভাবনার দ্যুতি ছড়িয়েছেন গত বছর অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে। তার ঝুলিতে ভরেছিলেন ৯ উইকেট। হয়েছিলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি।
গত বছরের মে মাসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে বাংলাদেশ “এ” দলেও স্থান পেয়েছিলেন মুস্তাফিজ। রীতিমতো চমক ছিলেন তিনি। মুস্তাফিজ প্রথম শ্রেণিতে খেলা শুরু করেন গত বছরের এপ্রিলে। এই তো ছয় মাস আগে অভিষেক হয়েছে ঘরোয়া এক দিনের ম্যাচে।
মুস্তাফিজের স্বপ্ন পূরণে আনন্দে আত্মহারা হয়েছেন তার বাবা-মাসহ গোটা জেলাবাসী।
মুস্তাফিজের ক্রিকেট কোচ আলতাফ হোসেন বলেন, “সৌম্য এবং মুস্তাফিজ দুজনই আমারই ছাত্র। দুজনই একসাথে জাতীয় দলে খেলছে। একজন বোলার আরেকজন ব্যাটসম্যান, এর চেয়ে আনন্দের কিছু হতে পারে না।”
মুস্তাফিজের আরেক কোচ মুফাসিনুল ইসলাম তপু বলেন, “তার সেজ ভাই অনূর্ধ্ব ক্যাম্পে নিয়ে আসে। প্রথমে তার বোলিং দেখি বুঝেছিলাম সে ভালো করবে। সে তো প্রথমে ব্যাটসম্যান হতে চেয়েছিল। আমি তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম বোলার হওয়ার জন্য। আমার ছাত্র জাতীয় দলে খেলছে এতে আমি গর্বিত। তাকে দলে টিকে থাকতে হলে পরিশ্রম করে যেতে হবে।”
মুস্তাফিজের বাবা আলহাজ আবুল কাশেম আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমার ছেলে যে জাতীয় টিমে খেলছে এটি গর্বের বিষয়। তিনি আরও বলেন, মুস্তাফিজ আজকে আমার একার ছেলে নয় গোটা জাতির হয়ে ২২ গজের রণাঙ্গনে লড়বে।” তিনি সকলের কাছে দোয়া প্রার্থনা করেছেন।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০১৫ দুপুর ১২:০৯