।
।
।
।
।
।
।
।
।
আজ সকাল থেকেই নাদিমের কেন যেনো খুব অস্থির লাগছে।
মেসের রুমের ভেতর বারবার পায়চারি করতে করতে ভাবছে,এখনো ফোনটা আসছে না কেনো? ক্যালেন্ডারের পাতার দিকে আরেকবার তাকিয়ে দেখল।না! ঠিক ই তো আছে,আজ শুক্রবার।তবে কি আজ আর ফোন আসবে না।ওদিকে টিউশনিতে যাওয়ার ও সময় প্রায় হয়ে এলো।
নেত্রকোনার কেন্দুয়া নামের অজপাড়াগ্রামে গন্জের হাশেমের দোকানে মেহেরুন্নেসা বসে আছেন হাতে এক টুকরি কাগজ নিয়ে।বহু ব্যবহারে মলিন হয়ে যাওয়া শাড়ির আচঁলে বাধাঁ ১০টি টাকা।খানিক আগে মুরগির ডিমগুলো বিক্রি করে পেয়েছেন।বারবার হাতের টুকরো কাগজের দিকে তাকাচ্ছেন।আর তাতে লিখা মোবাইল নাম্বারের বদলে চোখে ভেসে উঠছে বুকের ধন একমাত্র ছেলেটির ছবি।
বাবা,আরেক বার চেষ্টা কইরা দেখবা?
চাচী কইলাম তো আইজকা নেটওয়ার্কে সমস্যা কথা কওন যাইবো না।
বাপ না ভালা আরেকবার দেখো,পোলাডা আমার ফোনের লাইগা বইয়া আছে।
খালাম্মা যে কি কও? পোলাপাইন ঢাকা গেলে কি আর বাপ মার কথা মনে থাকে?
আমার পোলারে আমি চিনি রে বাপ।আমারে ছাড়া কিচ্ছু বোঝেনা।একবার কি হইল শোন....
হাশেম, মেহেরুন্নেসার কথায় কান দেয় না।সে এই গল্প কম করে হলেও ১০ বার শুনেছে।তবে একটা জিনিস দেখে সে অবাক হয় ,প্রতিবার সে এই গল্প শোনার পর দেখে বুড়ি অঝোরে কাদঁছে।জানে আজো তার ব্যতিক্রম হবেনা।
চাচী লাইন পাইছি,লও কথা কও।
নাদিম বেরিয়ে যাচ্ছিলো এমন সময় মেসের রুমমেট শফিক সাহেব ডেকে বলে, ঐ মিয়া তোমার বাড়ি থাইকা ফোন আইছে।
দৌড়ে গিয়ে ফোনটা হাতে নেয় নাদিম।
মা,এতো দেরী করলা যে? আমি তো মনে করছিলাম আইজ আর তোমার লগে কথা হইবো না।
কেমন আছস বাপ?
আমি ভালা মা,তুমি কেমন আছো কও? বাজানে কেমন আছে?
ভালা আছিরে বাপ।তোর বাপেও ভালা,তোর কথা জিগায় খালি কবে আইবি।
আমু মা এই মাসের টিউশনির টাকা ডা পাইলেই আমু।কতোদিন তোমারে দেখিনা।মুক্তা কেমন আছে?
বাবা,একটা ভালা খবর আছে।মুক্তার একটা সমন্ধ আইছে।পোলায় হাটে চাইলের আড়তে কাম করে।দেখতে শুনতে ও ভালা।
তোমরা যা ভালো মনে করো মা।
কিন্তু সমস্যা হইলো হেরা কিছু টেকা চায় পোলারে বিদেশ পাঠানির লাইগা।
কত চা্য়?
প্রায় লাখ খানিক।হাজার পন্চাশ এর মতো তোর বাপে জোগাড় করছে আমাগো জমিগুলান বন্ধক রাইখা।আর বাকিটা না হইলে তো সমস্যা হয়া যাইবো বাজান।মুক্তার ও তো বয়স হয়া যাইতাছে।
মা চিন্তা কইরো না।আমি দেখতাছি।
তুই ছোট মানুষ ,তুই কেমনে ব্যাবস্থা করবি?
তুমি যে কি কওনা মা? আমি কি আর ছোট আছি ?
পাগল পোলা কি কয় শুনো,মা হাসেন ।
ঐদিকে শফিক সাহেব অফিসে যাবেন, তাড়া দেন মোবাইলের জন্য।
মা আইজ রাইখা দেই,আমি অহনে পড়াইতে যামু।দেরী করলে হেরা রাগ করবো।
আইচ্চা গো বাপ,রাখি তাইলে,নিজের যত্ন লইয়ো।
আইচ্ছা মা,বাজান রে আমার সালাম দিও।
মেহেরুন্নেসা আচঁলের খুট থেকে ১০ টাকার নোট টা বের করে দেন।দোকান থেকে বের হয়ে হাটতে থাকেন আর মনে মনে ছেলের কথা গুলো মনে করে একা একা হাসেন।ভাবেন এই ছেলে ছোটবেলায় তার সাথে না শুলে ঘুমাতে পারতো না,আর আজ কতদূরে পড়ে আছে।নিমিষেই অজান্তে চোখের পানি গড়িয়ে পরে।
মেস থেকে বেরিয়ে নাদিম জোরে পা চালাতে থাকে।রিকশা তো তার কাছে বিলাসিতা।মনে শুধু একটা চিন্তাই কাজ করছে এতোগুলো টাকা কিভাবে জোগাড় হবে।কিছু একটা করতেই হবে।বাবা রিটায়ার্ড করছেন ৫ বছর হলো।পেনশনের টাকায় সংসার চলে।ঘরে বিবাহের উপযুক্ত বোন।ভাবতে গেলই দম বন্ধ হয়ে আসে।
মিসেস মুনমুন খেয়াল করে দেখেছেন ছেলেটি কে যাই নাস্তা দেন ,খুব তৃপ্তি করে খায়।মনে হয় সকালে নাস্তাই করা হয়নি।খুব মায়া হয় ছেলেটিকে দেখে।১ বছর হলো বাবুনকে পড়াচ্ছে।একদিনের জন্য ও দেরী করে আসেনি বা ফাকিঁ দেয়নি।কেন জানি আজ ছেলেটিকে খুব বিষন্ন দেখায়।তিনি একবার জিগ্গেস করে দেখবেন? না থাক,যদি লজ্জা পায়।
আজ ৪ দিন হয়ে গেলো এখনো টাকা জোগাড়ের কোন পথ ই নাদিম দেখতে পাচ্ছে না।মাত্র ১৫ হাজার টাকার জোগাড় হয়েছে।অনেক জায়গায় ঘুরেছে,অনেকের কাছে গিয়েছে।সবি বিফলে গেছে।এক বন্ধু বলেছিলো কিছু টাকা দেবে।তার জন্য রাত ১১ টা পর্যন্ত বসে থেকে উঠে মেসের পথে পা বাড়ালো।কিছুদুর এগোতেই হাসপাতালের সামনে দেখলো ছোট একটা জটলা।যাবেনা যাবে মনে করেই কেন যেনো এগিয়ে গেলো।
কিছুক্ষন কথা শুনে যা বুঝলো এক লোক তাদের কে এখানে এনেছে।সবাই রক্ত বিক্রি করবে,বোঝাই যায় এদের সবাই নেশাগ্রস্থ।১০ সেকেন্ড লাগলো সিদ্ধান্ত নিতে।
নেতাগোছের লোকটিকে গিয়ে বললো,ভাই আমিও রক্ত দিবো।
কি মিয়া নতুন নাহি?
কবে থাইকা এই লাইনে? নাকি টিকটিকি?
না ভাই আমি কিছুই না,আমার টাকার খুব দরকার।
আইচ্ছা ব্যবস্থা আমি করমু।জিগাইলে কইবা শেষবার রক্ত দিছো ৭ মাস আগে।আর বাকি সব আমি দেখুম।১০০ আমার বাকিটা তোমার।
আমি রাজ্বি।
হঠাত পুলিশের গাড়ির আলোতে চোখ ঝলসে উঠে।কিছু বুঝে উঠার আগেই ৪-৫ জনকে ধরে ফেলে পুলিশ।কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই টেনে হিচড়ে গাড়িতে নিয়ে তোলে।
১ ঘন্টা হলো থানায়।সেলের ভিতর অন্ধকার।২ জন নেশা করছে।একজন বসে কাদঁছে, কিছুক্ষন আগে ও সে আদি রসাত্নক কথা বলছিলো আর হেসে গড়িয়ে পড়ছিলো।বাকিরা ঘুমোচ্ছে।
আরো ২ ঘন্টা পর একজন পুলিশ এসে ওকে আরেকটি রুমে নিয়ে গেলো।সেখানে একজন বসে বিরানি খাচ্ছে।খাবার দেখে মনে পড়ে গেলো রাতে কিছুই খাওয়া হয়নি,বলতে গেলে সারাদিন ই কিছু খায়নি আজ সে।
বিরক্তি সত্বেও অফিসার টি উঠে এসে চুলির মুঠি ধরে ওকে টেনে তুললো।
কবে থেকে এই কাজ করিস?
স্যার আমি স্টুডেন্ট আজ ই প্রথম টাকার জন্য রক্ত বিক্রি করতে গিয়েছিলাম।
আমার টাকার খুব দরকার।নাহলে আমার বোনের বিয়ে আটকে যাবে।
ধরা পরলে এসব সবাই বলে,১ হাত দুরে ছিটকে পড়লো নাদিম চড়ের আঘাতে।জিহ্বায় নোনতা স্বাদ অনুভব করতে পারলো সে।মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে,
আরো কিছুক্ষন পর বুঝতে পারলো ঠোট কেটে গেছে,চোখের নিচে ফোলা,মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা।যন্ত্রনায় মাথার পাশের শিরা দপদপ করছে।
কষ্ট করে শরীরের সবটুকু শক্তি একত্র করে মাথাটা টেনে তুললো।দেখলো লোকটি আবার খেতে বসেছে, যেনো কিছুই হয়নি।
(ছোটবেলায় একবার পড়ে গিয়ে জিহ্বা কেটে গিয়েছিলো।ঝালের জন্য কিছু খেতে পারতো না।শুধু পায়েস,ডাবের পানি খেয়ে থাকতে হয়েছিলো ১সপ্তাহ।ঐ কটা দিন মেহেরুন্নেসা নিজে ১ বেলার জন্যও ভাত খাননি।স্বামী জিগ্গেস করলে বলতেন আমার বাজান ভাত খাইতে পারে না,আমি মা হইয়া আমার গলা দিয়া কেমনে ভাত নামবো?
শত রাগারাগি,অনুরোধ সত্বেও তিনি তরল কিছু ছাড়া অন্য কিছু খাননি।
হঠাত মায়ের মুখটা নাদিমের চোখে ভেসে উঠলো।মা নিশ্চয়ই তার জন্য চিন্তা করছেন।বাবা ভাবছেন ছেলে কিছু একটা ব্যাবস্থা করবে।আদরের বোনটি স্বপ্ন দেখছে নতুন কিছুর।)
আমাকে ধরে রেখেছেন কেন? আমাকে যেতে দিন প্লীজ।
মাত্র মুখে আয়েশ করে একটা পান ঢুকিয়েছে পুলিশ অফিসারটি।
কি বল্লি হারামির বাচ্চা? আমাকে প্রশ্ন করিস? আমাকে অর্ডার দিস শু..র বাচ্চা।সাহস কতো বড়ো..আবার তাকিয়ে আছে?
প্লিজ আমার বাবা মাকে নিয়ে কিছু বলবেন না।আমার বাবা একজন শিক্ষক।
উহ...আসছে আমার লাট সাহেবের বাচ্চা।বুট দিয়ে সজোরে লাথি হাকাঁয় পুলিশটি।শরীরের শক্তি দিয়ে মারতে থাকে যতক্ষন না হাবিলদার টি টাকে থামায়।
মাটিতে লুটিয়ে পড়ে নাদিমের দেহটি।ফিনকি দিয়ে মাথা কেটে রক্ত বের হতে থাকে।
হাবিলদারের চিতকার শোনা যায়,পরমুহূর্তে অফিসার টি উত্তেজিত ভাবে কি যেনো বলতে থাকে।
মাথার ভেতর ধীরে ধীরে অনুভূতি গুলো ভোতা হতে শুরু করে।মায়ের হাসি হাসি মুখটা ভেসে উঠে আরেকবার।ঐতো বাবা দাড়িয়ে আছেন বাজারের থলে হাতে, গন্জে যাবেন বলে।ছোট বোনটি সুর করে পড়ার টেবিলে বসে কবিতা পড়ছে।কিন্তু সবকিছু এতো ঝাপসা হয়ে আসছে কেনো? এখন কি রাত?
শুক্রবার ,মেহেরুন্নেসা আগের মতোই হাশেমের দোকানে বসে আছেন ।আজও নেটওয়ার্ক সমস্যা।রোদের মাঝে অনেকখানি পথ জোরে হেটে আসার কারনে মুখটা ঘেমে গেছে।
চাচী ১ গেলাস পানি দেই ?
নারে বাপ,নাদিমের লগে কথা কই পরে খামুনে।কাইল সারা রাইত ঘুমাইতে পারি নাই খালি বাজানডার কথা মনে পড়ছে।
চিন্তা কইরোনা চাচী আগামি সপ্তাহেই তো তোমার পোলা আইবো।
মেহেরুন্নেসা হাসেন,আনন্দের হাসি।কতোদিন ছেলেকে দেখেন না।গতো ঈদেও ছেলে বাড়িতে আসেনি।টিকেট পায় নি নাকি।কিন্তু ঠিক ই মানি অর্ডার করে টাকা পাঠিয়েছে।
দোকানের পাশ দিয়ে ভ্যান গাড়িতে করে ২ পুলিশ চাটাই বাঁধা একটি লাশ নিয়ে যাচ্ছে।দেখে মেহেরুন্নেসার বুকটা কেঁপে উঠে।
হাশেম কে আবার তাড়া দেন, বাবা আরেকবার দেখবা?
বুকের ভেতরটায় যেনো সূক্ষ ব্যাথা অনুভব করেন ।
ঐদিন সকালের কাগজ হাতে নিয়ে মিসেস মুনমুন চিতকার দিয়ে উঠেন,হাসবেন্ড রফিক সাহেব কে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন।
রফিক সাহেব বিরক্ত হন কাঁচা ঘুম ভাংগানোর জন্য।
কি হয়েছে?
দেখেছো আমাদের বাবুনের টিউটরের ছবি না এটা?
ছবির উপর লেখা " জেলখানায় মাদকসেবীর মৃত্যু"
এই লেখা তখনো কেন্দুয়া গ্রামের কেউ পড়েনি,মেহেরুন্নেসা তখনও বসে আছেন হাশেমের দোকানে,ছোট বোনটি বসে আছে মায়ের পথ চেয়ে,যে পথে দেখা যায় একটি ভ্যান গাড়ি বাড়ির পথে আসছে.....................................
এই লেখাটা উতসর্গ করলাম আমার "মা" সহ সকল ব্লগারদের মায়েদের জন্য।
লেখাটি অনেক বড় হয়ে গেলো।ক্ষমা করবেন।আর দোষ ইশতিয়াক চয়নের যার কথায় এমন লেখা লিখলাম।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১২:০০