সাতানব্বই
ওর সাথে আমার সম্পর্ক বেশ নিবিড় হয়ে এসেছিলো, ও ছিলো বাকসংযমী, আমি ওর বাকসংযমকে বোঝার চেষ্টা করতে করতে একদিন দেখলাম, ওর নৈঃশব্দ্যও অনুবাদ করা কঠিন নয় তেমন
ওর পেশা কী ছিলো জানিনি আমি, উপার্জন অথবা জীবন ধারণের উপায় কী ছিলো জানিনি আমি, জানার প্রয়োজন মনে করিনি, শুধু জেনেছিলাম, ও শবদেহ সৎকারে সত্যিকার আগ্রহী একজন, প্রথমে কর্তব্যবোধ থেকে, তারপর শখে, তারপর কৌতূহলে, তারপর শবদেহ সৎকারের সংখ্যাটা যখন চল্লিশ স্পর্শ করলো, তখন বিষয়টা পরিণত হল নেশায়, এবং সংখ্যাটা ছেষট্টি অতিক্রম করতেই ওর নেশাটা পরিণত হল নীরব উন্মাদনায়, ও তখন স্থির করে ফেললো একশত শবদেহ সৎকারের সংকল্প
আমার সঙ্গে ওর পরিচয় বাহাত্তরে, ভীষণ রকম হঠাৎ, আমাদের চেনা-জানা হলো শবদেহ সৎকারশালার বাইরের টি-স্টলে
ওর উন্মাদনা আমাকেও কীভাবে যেন ছুঁয়েছিলো, আমিও কীভাবে যেন উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলাম ওর শতকছোঁয়া শবদেহ সৎকার সংকল্পের সাক্ষী হতে, আমিও ভুলে গিয়েছিলাম কোন ধরনের জীবন প্রণালীতে বাঁধা ছিলাম আমি, ভুলে গিয়েছিলাম অতীত, ভুলে গিয়েছিলাম ভবিষ্যৎ, শুধু ঘটমান বর্তমানের হাতে হাত রেখে বাজি ধরেছিলাম একান্ত ব্যক্তিগত আগ্রহের সর্বস্বটুকু
ধীরে ধীরে আমার পোশাক শতছিন্ন হলো, সহস্রছিন্ন হলো, চুল-দাড়ি বাড়তে লাগলো, লাগামহীন উত্তেজনায় চোখের মণি আশ্চর্য রকম উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, শুধু দেহটা কঙ্কালসার, আমি শুধু দেখছিলাম, আর দেখছিলাম
পঁচানব্বইতম শবদেহটি ছিলো একজন বিষপানে আত্মহত্যাকারী মহিলার
ছিয়ানব্বইতম শবদেহটি ছিলো একজন শতবর্ষী বৃদ্ধের
সাতানব্বইতম শবদেহটি ছিল লঞ্চডুবিতে মৃত একটি ৯ বছরের বালকের
আটানব্বইতম শবদেহটি আর সৎকার করা হয়ে উঠলো না ওর, ও নিজেই মৃত্যুবরণ করল হঠাৎ হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে
ওর আকস্মিক মৃত্যু আমাকে যতোটা না কষ্ট দিলো, তার চেয়ে বেশি কষ্ট দিলো শবদেহ সৎকারের শতকপূর্তির মতো একটা উত্তেজনাকর ঘটনা দেখতে না-পাবার আশাভঙ্গের বেদনা, জীবন একেবারে ভরে উঠলো হতাশায় যেন, বিপুল বিহ্বলতার ঘোরে সৎকার করলাম ওর শবদেহ, আক্ষরিক অর্থে সেটাই শুরু আমার, এবং শুরু করার সাথে সাথে আশ্চর্যজনকভাবে ওর স্বপ্ন সংক্রমিত হলো আমার ভেতর
ছিয়ানব্বইতম শবদেহ সৎকার করেছি আজ সন্ধ্যায়, জল-ঝড় মাথায় নিয়ে চা খাচ্ছি পুরোনো টি-স্টলে, একটা লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স এসে থামলো সৎকারশালার গেটে
সাতানব্বই
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০২১ রাত ১০:১৬