আমি শৈশব থেকেই বাড়ীর আংগিনায়, বিশালদেহী, বোঝার ভারে নুয়েপড়া বিদেশী এই মানুষগুলোকে দেখে আসছিলাম; এরা বর্ষা সইতে পারতো না, শীতে আসতো গ্রামে; প্রতিটি বাড়ী বাড়ী গিয়ে উলের চাদর, উলের টুপি, হালুয়া, কিসমিস, মক্কার তসবিহ, আফিম বিক্রয় করার চেষ্টা করতো। গ্রামের বাচ্চারা উৎসাহের সাথে এই লম্বাদেহী ধৈয্যশীল মানুষগুলোর পেছনে পেছনে হাঁটতো; গ্রামের খুব অল্প পরিবারেরই ক্রয় ক্ষমতা ছিলো, তেমন বিক্রি হতো না। আমাদের বাড়ী এলে আমি টিউব ওয়েলে থেকে জগে করে পানি দিতাম; খেতে দিলে খেতো।
এরা আজকের যেসব বাংগালী স্ত্রী, পরিবারকে ফেলে সাউথ আফ্রিকা, লিবিয়া, মালয়েশিয়া চলে যাচ্ছে, তাদেরই মতো ছিলো। আজকে কারা আন্দামান সাগরে ডুবছে, কারা ভুমধ্যসাগরে ডুবছে, কেহ খবর রাখছে? সেই ৬০'এর দশকে ২০০০ মাইল দুর থেকে এক দরিদ্র কাবুলীওয়ালা, বাংলার দরিদ্র মানুষদের কাছে সামান্য এটা সেটা বিক্রয় করে কিইবা পেতো, ২/৪ বছর পর, স্ত্রীপুত্রদের জন্য কি নিয়েই বা দেশে ফিরতো? কতবারই বা ততকালীন সময়ে ২০০০, ২০০০ করে ৪০০০ মাইল পাড়ি দিতে পারতো?
আমি যখন এঁদেরকে আমার গ্রামে ফেরি করতে দেখেছি, তখন তাঁদের রাজা ছিলেন জহির শাহ; ততকালীন আফগানিস্তনানের জন্য ভালো শাসকই ছিলেন: রাজতন্ত্রের মাঝে তিনি গণতন্ত্র চালু করেছিলেন: পার্লামেন্ট ছিলো, মন্ত্রীসভা ছিলো; এবং অবশেষে দেশে গণতান্ত্রিক সংবিধান করেন। কিন্তু দেশকে অর্থনৈতিক দিক থেকে ভালোভাবে এগিয়ে নেয়ার মতো বড় ধরণের মাথা হয়তো ছিলো না।
ভারত, পুর্ব পাকিস্তানে কাবুলীওয়ালাদের দেখেই বুঝা যেতো যে, সেই দেশের অর্থনীতি তেমন ভালো ছিলো না। তবে, মানুষ খুব একটা অসুখী ছিলো না, তাদের পৃথিবীতে চাহিদা কম ছিলো; মানুষের সামাজিক চরিত্র ছিল কঠিন; ওরা অন্যায় করলে, সমাজই সাজা দিতো, সবার কাছে ছোরা, কিংবা বন্দুক থাকতো; ফলে, কেহ কাউকে সহজে হেনস্তা করার সুযোগ পেতো না। ওরা নিজেদের মানুষকে নিয়ে গর্ব করতো, ওরা বৃটিশকে বারবার পরাজিত করেছে, সেই গল্প বলে গর্ব অনুভব করতো।
১৯৭৩ সালে রাজা জহির শাহ চোখের সমস্যায় ভোগেন; মস্কোতে উনার চিকিৎসার কথা হচ্ছিল; কিন্তু উনার পরিচিত এক ডাক্তার ছিলেন ইতালীতে, তিনি সেখানে যান। উনার চিকিৎসা চলার সময়, উনার আত্মীয় ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, জেনারেল দাউদ খান দেশে সামরিক ক্যু' করে, দেশের ক্ষমতা দখল করে ফেলে; আফগানিস্তান ভয়ংকর সমস্যার দিকে পা বাড়ালো