“আচ্ছা ভাই নভো-থিয়েটারটা যেন কোন-দিকে?”
“চিনি না।”
পাশের থেকে একজন বলে উঠল- “হেইডা আবার কি?”
“ঐ যে ছবি-তবি দেখায় যে; বড় একটা গুম্বুজের মত আছে...”।
রিক্সাচালকগণ মুখ ঘুরিয়ে আগের মত পরম তৃপ্তিতে বিড়িতে সুখটান দিতে লাগলেন। তখন মাত্র সকাল ১০.০৫। কোনো সাইনবোর্ড আছে কিনা দেখলাম। নেই -আমাদের দেশে প্রয়োজনে সাইনবোর্ড আর ডাস্টবিন খুঁজে পাওয়া যে দূরহ তা আমি আগেই টের পেয়েছি। আশে-পাশে ঐ পেশার লোকজন ছাড়া আর কেউ নেই। ১১টা নাগাদ গন্তব্যে পৌছালেই হবে তাই তেমন কোনো তাড়া নেই। ভেবেচিন্তে বললাম- “আশেপাশে কোনো যাদুঘর চেনেন?”। এবার তাদের একজনকে কিছুটা আগ্রহী মনে হল-“ও হেইডা...আহেন”। আমি আর মেহেদি রিক্সায় চড়ে বসলাম। বসন্তের ফুরফুরে হাওয়া বইছে তাই রোদের প্রকোপ তেমন কড়া মনে হচ্ছে না। রিক্সা এগিয়ে যাচ্ছে আমি আর মেহেদি গল্প করেই যাচ্ছি। এর মধ্যে শুভকে কল করলাম- “কিরে এখনো তুই মতিঝিল? আমরা তো নভো-থিয়েটারের একেবারে দোরগোড়াঁয়”। লাইন কেটে আমি আর মেহেদি হাসিতে লুটোপুটি- শুভকে একটু টেনশানে রাখলাম এই যা। একটু পরেই প্লাবনের ফোন- “কিরে তোরা কই? লোক ছাড়া তো টিকিট বিক্রি করবে না...তাড়াতাড়ি আয়”। “ও.কে, এইতো আর ৫ মিনিট”।
রিক্সা থামল - যেখানে নামলাম তা মোটেই নভো-থিয়েটার টাইপের কিছু নয়। সামনে মস্ত ডাইনোসরের প্রতিকৃতি; আমরা তখন বিজ্ঞ্যান আর প্রযুক্তি যাদুঘরের সামনে। আমার যতদূর মনে আছে নভো-থিয়েটারের পাশেই সামরিক যাদুঘর ছিল।
যাদুঘরের কথা বলায় রিক্সাচালক আমাদের বিজ্ঞ্যান আর প্রযুক্তি যাদুঘরের সামনে নিয়ে এসেছে, তাতে রিক্সাচালকের খুব বেশি দোষ দেখছি না। এদিকে যে আরেকটি যাদুঘর আছে তা আমার একেবারেই খেয়াল ছিল না। নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য নিজেকে মনে মনে গালাগাল দিলাম। এবার পুরোপুরি নিজকে ভাঁড় মনে হতে লাগল। আশেপাশের কয়েকজন পথচারিকে জিজ্ঞেস করতে তারা এমনভাবে তাকায় দেখলে মনে হয় তারা ভাবছে- “এরা কোন গ্রহের লোক”। কিন্তু আমি অবাক না হয়ে পারলাম না, সেখানকার কেউই নভো-থিয়েটার চেনে না? এটা কেমন করে হয়? আমরা নিশ্চয়ই অনেক দূরে চলে এসেছি। এবার একটু টেনশানে পড়ে গেলাম কারণ সময় তখন ১০.৩৫ এর মত। ভাগ্য এবার সুপ্রসন্ন মনে হল যখন একজন লোক আমাদের ভাঁড় প্রমাণ করে দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন-“নভো-থিয়েটার তো বিজয়স্মরণীতে, এখানে কী খুঁজেন?” এই টানটান উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তে আবারো প্লাবনের ফোন -“কিরে তুই কই?”। “আর ৫ মিনিট”- মুখ দিয়ে এর চেয়ে বেশি কিছু বের হল না।
রিক্সাচালককে অনুরোধ করতে সে আমাদের চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের সামনে নামিয়ে দিল। মনে মনে স্মৃতিশক্তির সাথে লড়াই করছি। এইতো মাত্র বছর দেড়েক আগে ঘুরে গেছি নভো-থিয়েটার থেকে- এরই মধ্যে ভুলে গেলাম। বুঝতে বাকি থাকল না যে আমার স্মৃতিশক্তি শুধু পরীক্ষার খাতাতেই ফেল মারে না, অন্য জায়গাতেও মারে। এবার একটা বুদ্ধি আসল মাথায়, যা আরো অনেক আগেই আসার উচিৎ ছিল- শিমনকে কল করলাম। একঝাঁক কথার ভিড়ে সে আমাকে লোকেশনটা বলে দিল। চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র থেকে বিজয় স্মরণী হাঁটার পথ খুব একটা বেশি না হলেও সময় যখন ঘাড়ে চেপে বসে আছে তখন এই সল্প দৈর্ঘ্যের পথ চলাও নিতান্ত সহজ নয়। কতটুকু হেঁটেছি জানি না- মাথায় তখন সময়ের তাড়া। কিছুদূর হাঁটার পর একটা রিক্সা নিলাম। রিক্সায় উঠতে না উঠতেই রিক্সাচালক তার দন্ত বিকশিত হাসিতে জানালেন আমরা পৌঁছে গেছি বিজয়স্মরণীতে এবং রিক্সা আর যাবে না। আবারো ভুল- বেশিরভাগ পথ আমরা হেঁটেই পার করে ফেলেছি রিক্সার প্রয়োজন ছিল না। কথা বাড়াবার সময় নেই- ঘড়িতে তখন ১০.৫৫। হাতে সময় আর মাত্র ৫ মিনিট। আমরা ১০.০৫-এ এখানে ছিলাম ১০.৫৫-তেও একই জায়গায়। ফিজিক্সের ভাষায় আমরা আসলে কোনো কাজ করি নি। ব্যাপারটা কি বাস্তবেও তা-ই?
আবারো হন্টন। শিমন কল করল-“আমি তোদের জন্য টিকিট কিনে বাইরে দাঁড়িয়ে আছি...তোরা আয়...আর কতক্ষণ?”। আমার সেই একই জবাব -”আর ৫ মিনিট”।
৫ মিনিট অবশ্য লাগল না। ৩ মিনিটেই পৌছে গেলাম। ঘড়িতে তখন ১০.৫৮ শিমন রোদের মধ্যে দাড়িঁয়ে আছে- হাতে দুটো টিকিট। প্রথমেই সে যা বলল তার সাথে আমি একমত না হয়ে পারলাম না- “তুই একটা আস্ত গাঁধা”। এই যাত্রায় বেঁচে গেলাম। ১১.০০ টায় নভো-থিয়েটারের শো শুরু হবার কথা থাকলেও একটু দেরীতে শুরু হল। পেছনের জায়গা সব দখল, সামনের দিকেই বসতে হবে। অন্ধকারে আমার পাশে কে ছিল খেয়াল করি নি। পাশ থেকে বলল- “তুই এখন নভো-থিয়েটারের একেবারে দোরগোড়াঁয়”। কন্ঠসর শুনে বুঝতে পারলাম আমার পাশে শুভ।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



