আরাকান সেকালে ছিল রোসাঙ্গ রাজ্য। এর অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যেও। বাস্তবে রোসাঙ্গ রাজ্য গড়েই উঠেছিল বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের ভিত্তিতে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে রাজধানী গৌড়ের পতন ঘটলে আরাকানের রোসাঙ্গ রাজসভাই বাংলা সাহিত্যের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর দৌলত কাজী, আলাওল, মরদন ও নাসুল্লা খানের মতো অনেক কবি-সাহিত্যিকের বর্ণনাতেও এসব বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। অর্থাৎ রোহিঙ্গা মুসলমানরা হঠাৎ করে গিয়ে হাজির হয়নি রাখাইন প্রদেশে তথা আরাকানে। তারা সেখানে বসবাস করছে হাজার বছর ধরে। তাছাড়া ইদানীংকালে মিয়ানমারের অধিবাসী হিসেবে তারা বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় ও আঞ্চলিক নির্বাচনেও ভোট দিয়েছে। সরকারকে খাজনা-ট্যাক্সও রোহিঙ্গারা বহুকাল ধরেই দিয়ে আসছে।
প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন বললেই রোহিঙ্গা মুসলমানরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হয়ে যায় না। নৃ-তাত্ত্বিক বিশ্লেষণেও রোহিঙ্গারাই ওই অঞ্চলের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে এসেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, যুগে যুগে তাদের উপর মিয়ানমার তথা সাবেক বার্মার শাসক গোষ্ঠী ও মগসহ বিভিন্ন সম্প্রদায় নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতন চালিয়েছে। এমনকি ১৯৪২ সালেও আকিয়াব, রাছিডং, কাকথ, মাব্রা, মিনবিয়া, পুনাজয় প্রভৃতি এলাকায় হত্যা করেছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানকে। হত্যা ও নির্যাতনের সে নিষ্ঠুর কর্মকা- এখনও অব্যাহত রয়েছে। এর প্রধান কারণ, তারা মুসলমান। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আধুনিক যুগের রাষ্ট্রনায়ক হলেও প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের মুখেও মুসলমানবিরোধী একই মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে। রোহিঙ্গাদের নাক বোঁচা না হওয়াটা কারণ নয়, রোহিঙ্গারা মুসলমান বলেই যত আপত্তি!
ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে জানা যায়, এই উপমহাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সর্বপ্রথম যে ক’টি এলাকায় মুসলিম বসতি গড়ে উঠে, আরাকান তথা বর্তমান রাখাইন প্রদেশ তার অন্যতম। রোহিঙ্গারা সেই আরকানী মুসলমানদের বংশধর। এক সময় আরাকানে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় ১৪৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসন দুশ’ বছরেরও অধিককাল স্থায়ী হয়। ১৬৩১ থেকে ১৬৩৫ সাল পর্যন্ত আরাকানে মারাত্মক দুর্ভিক্ষ হয়। এরপর মুসলিস শাসনের অবসান ঘটে। ১৬৬০ সালে আরাকান রাজ্য সান্দথুধম্মা নিজ রাজ্যে আশ্রিত মোগল শাহজাদা সুজাকে সপরিবারে হত্যা করে। এরপর শুরু হয় মুসলমানদের উপর তার নিপীড়ন ও নির্যাতন। প্রায় সাড়ে তিন শ’ বছর মুসলমানদের এই দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে কাটাতে হয়। ১৭৮০ সালে বর্মী রাজা বোধাপোয়া আরাকান দখল করে নেয়। সেও ছিল ঘোর মুসলিমবিদ্বেষী। বর্মী রাজা ঢালাওভাবে মুসলমানদের শহীদ করে। ১৮২৮ সালে বার্মা ইংরেজ দখলে গেলে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। তবে ১৯৩৭ সালে বার্মার স্বায়ত্তশাসন লাভের পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্যাপক রূপ নেয় এবং অন্তত ৩০ লাখ মুসলমান শহীদ হয়। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু মুসলমানদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। স্বাধীন দেশের সরকার আজ পর্যন্ত তাদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার দেয়নি। অত্যাচার নির্যাতন ও বিতাড়নের মুখে বহু রোহিঙ্গা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহুদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। এরা বিশ্বের রাষ্ট্রহীন নাগরিক। ১৯৮২ সালে সে দেশের সরকার যে নাগরিকত্ব আইন করেছে, তাতে তিন ধরনের নাগরিকের কথা বলা হয়েছে। এর কোনটির মধ্যেই রোহিঙ্গারা নেই। সরকারীভাবে তাদের সে দেশে বসবাসকারী বা ‘Resients’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের সাংবিধানিক ও আর্থ-সামাজিক অধিকার নেই। তারা একার্থে বন্দী। কারণ মিয়ানমারের অন্য স্থানে তারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া যেতে পারে না।
এক সময় যে আরাকান মুসলমান প্রধান ছিল, এখন সেখানে রাখাইন বসতি বাড়িয়ে তাদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হয়েছে।