গালিবাজ
দর্পণ কবীর
লাল মিয়াকে এক ঝলক দেখেই চিনতে পারলেন শহীদ হাসান। বঙ্গবন্ধু এভিনিউ রাস্তা দিয়ে স্টেডিয়াম মার্কেটের প্রবেশ পথে তিনি লাল মিয়াকে দেখতে পেলেন। লাল মিয়ার শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। সংজ্ঞাহীন। তাকে পুলিশ চ্যাঙদোলা করে ভ্যানে তুলছে। লাল মিয়ার উদ্দেশ্যে পুলিশ খিস্তি খেউর করছে। পুলিশের পেছনে ুব্ধ যুবকদের আষ্ফালন। তারা সংজ্ঞাহীন লাল মিয়ার উদ্দেশ্যে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করছে। ুব্ধ যুবকরা লাল মিয়াকে পুলিশের কাছ থেকে যেন কেড়ে নিতে চায়। শহীদ হাসান বুঝতে পারলেন লাল মিয়া নিশ্চয় আজ পিটুনী খেয়েছে। গণ পিটুনীও হতে পারে। লাল মিয়াকে অপছন্দ করলেও এই মুহুর্তে তার জন্য তার মনটা মোচড় দিয়ে উঠলো। পরিচয়ের দিনই লাল মিয়াকে তার পাগল বলে মনে হয়েছে। পুরোপুরি পাগল না হলেও তার মাথায় যে ছিট আছে, এ নিয়ে শহীদ হাসানের কোন সন্দেহ নেই। নইলে গালি দেয়াকে কেউ কী পেশা হিসাবে নেয়?
শহীদ হাসান লাল মিয়াকে প্রথম দেখেন প্রায় তিন মাস আগে রমনা পার্কে। কণ্ঠশিল্পী শহীদ হাসান এক বিকেলে রমনা বটমূলে বসন্ত বরণ অনুষ্ঠানে গান গাইলেন। অনুষ্ঠান শেষে রমনা পার্কটা ঘুরে দেখার তার ইচ্ছে হলো। আজকাল রমনা পার্কে ঘুরে বেড়ানো দায়। চোর,ছিনতাইকারী, হকারদের উপদ্রবে পার্কটির পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। তাই শহীদ হাসান রমনা পার্কে অনেকদিন হলো ঘুরে বেড়াতে আসেন না। সেদিন তিনি পার্কে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় এসে দেখলেন, একটি লোক বেঞ্চে দাঁড়িয়ে একা অনর্গল গালি দিচ্ছে। লোকটির গায়ে মলিন, ছেঁড়া পাঞ্জাবী। বড় দাড়ি-গোঁফ জট পাকিয়ে আছে। লম্বা, শীর্ণ-লিকলিকে লোকটির চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছিলো। লোকটি ভাষণ দেবার ভঙ্গিতে গালি দিচ্ছে। পথচারীরা যে যার মতো করে হেঁটে যাচ্ছে। কেউ তার গাল শুনছে না। লোকটির সেদিকে ভ্রপে নেই। সে গাল দিয়েই যাচ্ছে। শহীদ হাসান লোকটির সামনে থমকে দাঁিড়য়ে গালগাল শুনতে লাগলেন। প্রায় দশ মিনিট পর লোকটি থামলো। গালি শোনার একমাত্র শ্রোতার দিকে তাকিয়ে বিগলিতভাবে হেসে লাল মিয়া বললো,
‘স্যার, গালিগুলি কেমন শুনলেন? আমি আরো খারাপ গালি দিতে পারি। চ বর্গের এক শ’ একটা গালি জানি। এমন গাল দিতে পারি, শুনলে কুমারী মাইয়া পোয়াতি হইয়া যায়। হি-হি-হি।’
লাল মিয়ার নিলর্জ্জ হাসি দেখে শহীদ হাসানের রাগ হলো। কিন্তু তিনি রাগ প্রকাশ করলেন না। কৌতুহলী গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
‘তুমি কী কাজ করো?’
‘আমি গালি দেই। ভাড়াইট্টা গালিবাজ।’
‘ভাড়াটে গালিবাজ!’
শহীদ হাসান বিস্ময় প্রকাশ করেন।
‘জ্বি, স্যার! মানুষজন আমারে গালি দেবার জন্য ভাড়ায় নিয়া যায়।’
‘বলো কী! তুমি কাকে গালি দাও?’
‘সাবাইরেই গালি দেই। ধরেন খালেদা জিয়ারেও গালি দেই। আবার শেখ হাসিনারেও গালি দেই। একদল পয়সা দিলে অন্যদলরে গালি দেই। হা-হা-হা।’
‘আশ্চার্য! এমন তো শুনি নি! তা কোথায় তোমাকে নিয়ে যায়?’
‘এই ধরেন, ছোট খাটো জনসভায়, সভা-সমাবেশে তেনারা লইয়া যায়। স্যার, বড় বড় জনসভায় বা সেমিনারে যদি গালি দেয়া যাইতো, তবে জাতির অনেক উপকার হইতো।’
‘গালিতে জাতির আবার কী উপকার হয় বা হতে পারে?’
‘স্যার, গালিতেই জাতির উপকার হইতে পারে। ঘুমাইয়া থাকা জাতি জাগতে পারে। ভুল পথে যাওয়া এই জাতির হুঁস ফিইরা আইতে পারে। শুধরাইতে পারে। যার বিবেক হারাইয়া গেছে, তার বিবেক ফিরা আইতে পারে। ধরেন, সবাই যদি প্রতিদিন একবার কইরা ঘুষখোরকে গালি দেয়, কেমন হইবো অবস্থা! ১৪ কোটি গালি একসাথে কোন ঘুষখোর হজম করতে পারবো?’
‘ভালোই বলছো, গালি দিয়ে জাতির মধ্যে জাগরণ!’
‘স্যার, আমাগো অহন যেই অবস্থা, তাতে গান শুনাইয়া কারো বোধ জাগানো যাইবো না!’
এ কথায় বিব্রতবোধ করতে লাগলেন শহীদ হাসান। তিনি নিজেই একজন কণ্ঠশিল্পী। ভাড়াটে গালিবাজ এ কী কথা বলছে? তিনি বললেন,
‘তোমার এ কথাটি ভুল। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকে গান গেয়েই এ জাতিকে তুমুল বিদ্রোহে জাগিয়ে তুলেছিলেন।’
‘স্যার, এখন কী আর সেই সময়টা আছে? চারপাশে কেমন পচন দেখতে পারতাছেন না! সবার বিবেক-বুদ্ধি কেমন নষ্ট হইয়া যাইতাছে! এখন কী আর কেউ গান শোনে? গালি কিন্তু ঠিকই শোনে!’
শহীদ হাসান আর তর্ক বাড়ালেন না। লোকটির কথাবার্তা সুবিধের নয়। এর সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করতে চান না তিনি। তবে পাগল এই লোকটির কথাগুলোর কেমন একটা আকর্ষণ যেন আছে। তিনি প্রসঙ্গ পাল্টানোর উদ্দেশ্যে বললেন,
‘তোমার নাম কী? কোথায় থাকো?’
‘আমার নাম লাল মিয়া। থাকার কোন জায়গা নাই। কখনো পার্কে, কখনো ফুটপাতে রাইত কাটাইয়া দেই।’
‘ও আচ্ছা। ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি।’ শহীদ হাসান বিদায় নেন।
পেছন থেকে লাল মিয়া বলে,
‘স্যার, একটা অনুরোধ ছিল। রাখবেন?’
‘কী অনুরোধ?’
‘আপনারে ভালা মানুষ বলে মনে হইতাছে। ভালা মানুষদের গালাগালটা এখন জাতির খুউব দরকার। আপনে আমার পাশে আইসা একটু দাঁড়ান।’
‘কেন!’
‘আসেন, আমরা একসাথে দেশের দুর্নীতি আর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গালি দেই। খুবই খারাপ ধরনের গালি দিমু।’
‘তুমি একটা পাগল!’
বলেই শহীদ হাসান জোরে পা চালালেন। পেছনে লাল মিয়ার অট্টহাসির শব্দ শোনা গেল। এই অট্টহাসি উপহাসের হাসি কিনা শহীদ হাসান বুঝতে পারছিলেন না।
মতিঝিল থানা হাজতের লোহার শিক ধরে দাঁড়ালো লাল মিয়া। দুর্বল শরীর। ওঠে দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছিলো তার। মাথায় ব্যান্ডেজ। লাল মিয়ার জন্য শহীদ হাসানের খুব মায়া হলো। তিনি বললেন,
‘কেমন আছো, লাল মিয়া? আমাকে চিনতে পেরেছো?’
‘জ্বি। অহন একটু ভালো আছি। তা আপনে?’
‘কাল বিকেলে পুলিশ যখন তোমার সংজ্ঞাহীন দেহটাকে ভ্যানে তুলছিলো,
তখন আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম ভ্যানটির সামনে। তোমাকে ওরা কেন মেরেছে? পুলিশ ধরে এনেছে কেন?’
শহীদ হাসানের উৎকণ্ঠিত প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে লাল মিয়া ফিক করে হেসে ফেললো। বললো,
‘স্যার, কাল আমি একটা সাহসের কাজ কইরা ফালাইছি!
‘কী কাজ করেছো?’
‘পল্টনে জামাতের জনসভা হইতেছিলো। দাঁড়াইয়া ছিলাম জনসভার এক পাশে। হঠাৎ দেখি, আমার সামনে দিয়া মঞ্চের দিকে যাইতাছে মন্ত্রী নিজামী। নিজামীরে দেইখ্যা সবচেয়ে খারাপ গালিগুলা মুখ দিয়া বাইর হইয়া আইতেছিল। কোন রকম তা সামলাইলাম। লাফ দিয়া পড়লাম নিজামীর পায়ের সামনে। বললাম, ‘স্যার, আমারে আপনার পায়ের ধুলি দেন!’
‘তাই নাকি!’
‘মন্ত্রী প্রথমে ভড়কে গেলেও আমারে মাটি থ্যাইকা টাইন্যা তুলতে গেলেন। ব্যাস, আর দেরী করলাম না। উইঠ্যা দাঁড়াইতে গিয়া নিজামীর বিছি খপ করে ধইরা ফেললাম! রাজাকার মন্ত্রী চিৎকার কইরা উঠলো!’
‘বলো কী!’
‘শুধু কী তাই! যত খারাপ গালি জানতাম দিতে লাগলাম। ততণে দলের ক্রদ্ধ নেতাকর্মী ও পুলিশ আমার ওপর ঝাঁপাইয়া পড়লো। কিল, লাথি, চড়-ঘুষির ঝড় বইলেও জ্ঞান থাকা পর্যন্ত মন্ত্রী শালার অন্ডকোষ আমি ছাড়ি নাই। হা-হা-হা।’
‘তারপর!’
‘বেধড়ক পিটুনীতে জ্ঞান হারাইয়া ফেললাম, স্যার। জ্ঞান ফিরলো হাসপাতালে।’
‘তুমি দেখছি...তুমি দেখছি.. !’
‘স্যার, খুউব কী খারাপ কাজ করছি? স্বাধীন দ্যাশে রাজাকার হইছে মন্ত্রী, এটা কী সহ্য করা যায়?’
শহীদ হাসান লাল মিয়ার এ প্রশ্নের কোন জবাব দিতে পারলেন না। এক ধরনের অস্বস্থি তাকে গ্রাস করে। এই প্রশ্নটি তার নিজেরও। তার ধারনা, ১৪ কোটি জনগণের মনেই এই প্রশ্ন। অথচ সবাই কেন জানি নীরব। এদের কী গালি দিয়েই জাগাতে হবে? শহীদ হাসানের মন বদলে যেতে থাকে।
‘স্যার, অহনও বলতাছি, ভালা মানুষরা চুপ কইরা বইসা থাকলে সব শেষ হইয়া যাইবো! গালি দেন! জাগাইয়া তোলেন বেবাকরে!’
লাল মিয়ার নির্ভীক ও ুব্ধ মুখের দিকে শহীদ হাসান অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন। এই লোকটিকে পাগল ভেবে উপো করেছিলেন বলে এই মুহুর্তে তিনি অনুশোচনায় ডুবে গেলেন ।
রমনার বটমূলে শহীদ হাসান আবার এলেন। তবে গান গাইতে নয়। তিনি বটমূলে দাঁড়িয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিতে শুরু করলেন। স্বাধীন বাংলা বেতারের কণ্ঠশিল্পী রমনা বটমূলে কেবল গালাগাল দিয়ে যাচ্ছেন-এই দৃশ্য দেখে কৌতুহলী পথচারীরা ভিড় জমাতে লাগলো।