somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রহস্যময়

২১ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ৩:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রহস্যময়

দর্পণ কবীর

চাকরির ইন্টারভিউ দিতে এসে কোন প্রশ্নের মুখোমুখি না হওয়ায় মহিমা ভীষণ অবাক হলো। ইন্টারভিউ দিতে এসে ওর ভেতরে কী যে কাঁপুনি হচ্ছিলো, সে কথা বলে বোঝানো যাবে না। কী কী প্রশ্নের জবাব দিতে হবে , কীভাবে কথা বলতে হবে, কতটা বিনয় ভাব দেখাতে হবে আবার বেশি বিনয়ী ভাব দেখাতে গিয়ে স্মার্টনেস যেন লোপ না পেয়ে যায়, সেদিকটাও মনে রাখতে হবে..এ সব কথা এই কিছুক্ষণ আগেও ভাবছিলো। ভাবতে গিয়ে কেমন ভয় ভয়ও লাগছিলো। এক ধরনের অড়ষ্টতা ছিল। এই আড়ষ্টতা নিয়েই ও রুমে প্রবেশ করেছিল। কোম্পানীর এমডির কক্ষ। এমডির কক্ষে প্রবেশ করেই ও চট করে তাকিয়ে নিয়েছিল রুমটা। এটা ওর অভ্যাস। কারো বাড়ি বা অফিস কক্ষে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে ও দেয়ালের চারপাশটা দেখে নেয়। কক্ষের মধ্যে কোন বড় ধরনের বিশেষত্ব আছে কিনা দেখে নেয়। প্রথম প্রথম মহিমা ওর এই অভ্যাসটার কথা বুঝতো না। একসময় ও নিজেই নিজের অভ্যাসটা আবিস্কার করে। এই অভ্যাসটা ভালো, না মন্দ-তা এখনো ভেবে দেখেনি। মহিমা লক্ষ্য করলো এমডির রুমটা বেশ বড়। ৭/৮ শ’ স্কয়ার ফিট হবে। রাউন্ড টেবিলের ওপাশে এমডি চেয়ারে বসে আছেন। রুমটির ডানপাশের দেয়ালের সঙ্গে সোফার কাছে একটা ওয়েল পেন্টিং রয়েছে। ছবিটা দেয়ালে ঝুলানো হবে হয়তো। সোফার কাছে রাখা পেইন্টিংয়ের বিষয়বস্তু যা, তা অফিসের জন্য মানানসই নয়। ছবিতে দেখা যাচ্ছে একজন নগ্ননারী বিছানায় শুয়ে আছেন। ছবিটার দিকে তাকানো যায় না। ঐ ছবিটার দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মহিমার কান লাল হয়ে গেলো। সব সময় সবদিকে তাকানো ঠিক নয়-ছবিটি দেখে এ কথাটি মনে হলো ওর। সবকিছু অনুভব হলো কয়েক মুহুর্তের মধ্যে। তবে পেইন্টিংটা চমঃকার। এমডির চেয়ারের পেছনে দেয়ালে আরেকটা পেইন্টিং। এই পেইন্টিং মানানসই। লিওনার্দো ভিঞ্চির আঁকা ছবি হবে। ছবির বিষয়বস্তু হচ্ছে কয়েকজন শিশুসহ একজন মা। ইন্টারভিউ দেবার টেনশন কাজ করছিলো। কোম্পনীর এমডির দিকে ভালো করে তাকানো হয়নি। তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসতেই এমডি সাহেবের গলা গমগম করে উঠলো,
‘মিস্ মহিমা, আপনি কি চাকরিটা চাচ্ছেন?’
চাকরি প্রার্থীকে মেধা যাচাইয়ের কোন প্রশ্ন না করে সমরাসরি চাকরিটা চাচ্ছেন কিনা, এমন প্রশ্ন করার কথা কেউ শুনেছে বলতে পারবে না। মহিমা অবাক হলো। নরোম গলায় বললো,
‘জ্বি, স্যার। এই জন্যই ইন্টারভিউ তো এসেছি। কোন প্রশ্ন থাকলে করুন, আমি চেষ্টা করবো জবাব দিতে।’
‘আপনাকে কোন প্রশ্ন করবো না। প্রশ্ন ছাড়াই আপনাকে সিলেক্ট করে ফেললাম। আপনার কোন প্রশ্ন আছে?’
প্রশ্ন ছাড়াই চাকরি হয়ে যাচ্ছে, এই বিস্ময়ের একটা ধাক্কা মহিমাকে যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ওর অবাক হবার রেশ যেন কাটছে না। এমডি সাহেব এক মিনিট চুপ থেকে মহিমার বিস্ময়ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘আপনার কোন প্রশ্ন নেই?’
এমডির কথায় সম্বিত ফিরে আসে। মহিমা নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করে বলে,
‘আপনার নাম কি স্যার?’
প্রশ্নটা করেই ওর মনে হলো এটা সঠিক প্রশ্ন হয়নি। কক্ষে প্রবেশ করার আগে ও নেমপ্লেট পড়েছে। সেখানে লেখা ছিলো সীমান্ত ফয়সাল। মহিমা নার্ভাস হয়েই এই প্রশ্নটা করেছে। সীমান্ত ফয়সাল বললেন,
‘আমার নাম সীমান্ত। পুরো নাম সীমান্ত ফয়সাল। আর কোন প্রশ্ন?’
‘না, মানে..!’
‘আপনি কি জানেন, আপনার পদবি এবং কাজ কি?’
‘জ্বি, স্যার। পদবি হচ্ছে সেক্রেটারী। কাজ হচ্ছে এমডির নির্দেশ ফলো করা। এমডিকে এসিষ্ট করা।’
‘রাইট। আপনি কবে থেকে জয়েন করতে পারবেন?’
‘যেদিন থেকে বলবেন, স্যার। তবে দু’তিন দিন সময় পেলে ভালো হয়। কেনাকাটার বিষয় আছে।’
‘হুম। এখুনিই একটা কথা বলে রাখছি, আমাকে কখনো স্যার বলবেন না। আমার নাম ধরে ডাকবেন। সীমান্ত।’
এমডির এ কথায় কেমন ভড়কে গেল মহিমা। একটা বহুজাতিক কোম্পানীর এমডিকে নাম ধরে ডাকা যায়? তাছাড়া নাম ধরে ডাকলে কেমন বেমানান লাগবে না? সেক্রেটারী বসকে নাম ধরে ডাকবে, ব্যাপারটা কেমন বিদঘুটে লাগবে-এমন কথা ভাবছিলো মহিমা। মহিমার অস্বস্থি হয়তো এমডি বুঝতে পারলেন। তিনি বললেন,
‘আমি যুক্টরাষ্ট্রে লেখাপড়া করেছি। নাম ধরে ডাকাটা আমি পছন্দ করি। ‘স্যার’ ডাকলে আমার অস্বস্থি লাগে। তাই..।’
‘এখন বুঝতে পেরেছি, স্যার..!’
মহিমা কথাটা বলেও লজ্জা পেল। ওর মধ্যে চাকরি পাওয়ার আনন্দের চেয়ে টেনশন বেশি কাজ করছে। সীমান্ত বললো,
‘এটাই আপনার প্রথম চাকরি?’
‘জ্বি। প্রথম ইন্টারভিউও।’
‘আমি কিš‘ আপনার ইন্টারভিউ নিইনি।’
‘জ্বি। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না..?’
‘খুশি হননি?’
‘এখন ভালো লাগছে। প্রথমে ঘোর লেগে গিয়েছিলো।’
‘আপনি আগামীকাল এসে এ্যাপয়ন্টম্যান্ট লেটারটা নিয়ে যাবেন। সাতদিন পর এক তারিখ থেকে জয়েন করবেন।’
‘জ্বি, স্যার! সরি স্যার! ও নো, সীমান্ত!’
মহিমার কণ্ঠে এক তাল টেনশন। সীমান্ত মুখ টিপে হাসলো। সে বললো,
‘আপনার আর কোন প্রশ্ন থাকলে বলুন।’
‘একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে।’
মহিমার ভয় কেটে যাচ্ছে। সীমান্ত মহিমার চোখে চোখ রেখে বললো,
‘বলুন।’
‘আপনার মাথার উপর যে ছবিটা আছে, সেটা খুবই ভালো একটা ছবি।’
‘থ্যাংকস।’
‘কিন্তু..?’
এ পর্যন্ত বলে থেমে যায় মহিমা। সীমান্ত চোখ কপালে তুলে প্রশ্ন করে,
‘কিন্তু কি?’
‘সোফার সামনে যে ছবিটা রয়েছে..,সেটা কিন্তু আপনার অফিসের সঙ্গে মানানসই হবে না।’
মহিমার কথা শুনে ‘হা-হা-হা’ করে হেসে ওঠলো সীমান্ত। রুম কাঁপানো হাসি। মহিমা একটু ভড়কে গেল। সীমান্ত হাসছে। মহিমা তার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। নতুন এক আড়ষ্টতা এসে ওকে গ্রাস করলো। হাসি থামিয়ে সীমান্ত বললো,
‘ও মাই গড! আপনি রুমে ঢুকে এতো কিছু লক্ষ্য করেছেন? আপনার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতায় আমি মুগ্ধ।’
‘ধন্যবাদ। কিন্তু ছবিটা..?’
‘এবার কিন্তু আপনার ইন্টারভিউ নেবো।’
‘মানে! চাকরি হবার পর ইন্টারভিউ? এই নিয়ম কি যুক্তরাষ্ট্রে শিখেছেন?’
মহিমার কথায় নিজেকে সংযত করে আবারো হাসলো সীমান্ত। বললো,
‘না, না, ঠিক ইন্টারভিউ নয়। কিছু প্রশ্ন করবো।’
‘প্রশ্ন? করুন।’
‘আমার মাথার পেছনে যে ছবিটা রয়েছে, সেটা কার আঁকা বলতে পারবেন?
সীমান্তের প্রশ্নে গাবড়ালো না মহিমা। ও চোখ রাখলো ছবিটার দিকে। ওর মনে হলো ছবিটা লিওনার্দো ভিঞ্চির আঁকা। ছবির নামটা মনে পড়লো না। ও বললো,
‘জনাব সীমান্ত, ছবিটা লিওনার্দো ভিঞ্চির তৈলচিত্র। ছবির নামটা এই মুহুর্তে বলতে পারছি না।’
সীমান্ত বললো,
‘ছবিটির নাম ‘ভার্জিন অফ দ্যা রকস’। ছবিটি লিওনার্দো আঁকেন ১৫০৫ থেকে ১৫০৮ সালের মধ্যে।’
‘ওহ্!’
‘যে ছবিটা আপনি এই কক্ষের জন্য বেমানান বলেছেন, সেটা কার ছবি বলতে পারবেন?’
এ কথায় ঐ ছবিটার দিকে তাকালো না মহিমা। সীমান্তের সামনে নগ্ন এক নারীর ছবির দিকে সে কীভাবে তাকাবে? মহিমা অস্বস্থি নিয়ে বললো,
‘ছবিটা লিওনার্দোর নয়, এ টুকু বলতে পারি।
‘ঠিক বলেছেন। এই ছবিটি ইতালিয়ান চিত্রশিল্পী টিটানের। ছবিটির নাম ‘ভেনাস অফ উরনিনো’। টিটান এই ছবিটি আঁকেন ১৫৩৮ সালে।’
‘চিত্রশিল্পের প্রতি আপনার অনুরাগ খুব বেশি?’
এ কথার কোন জবাব দিল না সীমান্ত। ও হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেল। মহিমার শেষ প্রশ্নটি ও যেন শুনতে পায়নি। মহিমার একটু ভালো লাগছে। ‘বস’ হিসাবে সীমান্ত ভালোই হবে। শিল্পানুরাগী ‘বস’রা কি মন্দ হতে পারে? মনে মনে ভাবলো মহিমা। মহিমার দিকে কেমন ঘোরলাগা চোখে তাকালো সীমান্ত। সে বললো,
‘মহিমা, ছবিটা আজই মিলানো থেকে এসেছে। ছবিটা অফিসের দেয়ালে ঝুলবে না। ওটা ঝুলবে আমার বেডরুমে। অনফরচুনেটলি, ছবিটা এই কক্ষ থেকে সরাতে ভুলে গিয়েছিলাম।’
সীমান্তের কথায় ছবি নিয়ে জড়তা কেটে গেল মহিমার। ও কী বলবে ভেবে পেল না। চেয়ার থেকে উঠতেও মন চাইছে না। কী এক অদ্ভূত আকর্ষণ অনুভব করতে লাগলো। এমন কখনো হয়নি ওর। সীমান্ত মহিমার দিকে তাকাচ্ছে না। সে ড্রয়ার খুলে কী যেন দেখছে। মহিমা অস্বস্থি বোধ ফের শুরু হতে যাচ্ছিলো, সীমান্ত মুখ তুলে তাকালো। তার চোখে কী এক বিস্ময় আর মাদকতা ফুটে আছে। মহিমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। ও কিছু বলতে যাবে, ঠিক সেসময় সীমান্ত বললো,
‘মহিমা, তুমি ১৫ শ’ খ্রীষ্টাব্দে টিটানের প্রেমিকা ছিলে! টিটান যে ছবিটা এঁকেছেন, সেটা তোমারই ছবি! তুমি কি জানো?’
মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো যেন। প্রথমতঃ সীমান্ত ওকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে কথা বলছেন। দ্বিতীয়তঃ তিনি ওকে নিয়ে আবোল-তাবোল প্রলাপ বকছেন। এ ধরনের কথার জন্য ও প্রস্তুত ছিল না। ওর মুখে কোন কথা ফুটলো না। ও অবাক চোখে সীমান্তের দিকে তাকিয়ে রাইলো। সীমান্ত ঘোরলাগা কণ্ঠে বললো,
‘মহিমা, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছো?’
‘না, স্যার।’
মহিমা চটপট জবাব দেয়। ‘স্যার’ বলে ইচ্ছা করে। এতে ম্যাসেজ দেয়া সীমান্ত ওকে ‘তুমি’ করে বলছে। কিন্তু সীমান্তের হঠাৎ কী হলো? সে কেন আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলো? মহিমা ভাবনায় পড়ে গেল। কোম্পানীর এমডি ইন্টারভিউ না নিয়েই চাকরিটা দিয়ে দিলেন। এমডি এখন ‘তুমি’ করে সম্বোধন করছে, ও কি বলবে ভাবছিল। এবার সীমান্ত বললো,
‘সরি, আমি আপনাকে ‘তুমি’ বলে ফেলেছি। মাত্র কয়েকমুহুর্ত আগে সীমান্তের চোখেমুখে এক ধরনের তন্ময়তা দেখেছে মহিমা। এখন নেই। সীমান্ত ভাবাবেগ থেকে ফিরে এসেছেন বাস্তবে। কেমন একটা ধাক্কা এসে লাগলো মহিমার। ওর মনে সংশয় তৈরি হচ্ছে। সীমান্ত ওর দিকে একটা খাম বাড়িয়ে দিলেন। মহিমা খামটি হাতে নিল। সীমান্ত বললো,
‘আপনি বাসায় যাবার পর এটা খুলবেন। খামটি খোলার পর আপনি চমকে যেতে পারেন, বিস্ময়ে থ’ বনে যেতে পারেন। আপনার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু যা দেখবেন তা অলীক কিছু নয়। মিথ্যাও নয়।’
‘স্যার, ও নো, সীমান্ত এতো রহস্য কেনো করছেন? আপনি কি রহস্য করতে পছন্দ করেন?’
মহিমা জানতে চাইলো। সীমান্ত এবার শব্দ না করে হাসলো। সে বললো,
‘বিশ্বাস করুন, আর না করুন, পৃথিবীতে অনেক রহস্যের সৃষ্টি হয়। তবে আমি কোনো রহস্য করছি না।’
‘কিন্তু..!’
‘এই খাম খুললে আপনি ধ্রুব এক সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াবেন।’
‘ঠিক বুঝলাম না। আমার কাছে আপনার কথা রহস্যময় লাগছে।’
‘জানি। আপনি বাড়িতে চলে যান। রাতে ঘুমাতে যাবার আগে খামটি খুলবেন, প্লিজ!’
‘কি আছে খামে?’
‘একটা ছবি। এরবেশি কিছু বলবো না। আর কোন প্রশ্ন করবেন না। আপনি বাড়ি চলে যান।’
মহিমা কথা বাড়ালো না। তাছাড়া ওর কেমন গা ছমছম করছিলো। ওর হাতের মুঠোয় খাম। ও চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। সীমান্ত ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। মহিমা হনহন করে সীমান্তের কক্ষ থেকে বের হয়ে এলো। চাকরি হয়ে যাওয়ার আনন্দের চেয়ে খামের রহস্য ওকে আচ্ছন্ন করে ফেললো।

মহিমা কৌতুহল ধরে রাখতে পারলো না। ও লিফটে উঠে খামটা খুলে ফেললো। খামটা খুলতেই একটা ছবি দেখতে পেলো ও। ছবিটার দিকে তাকাতেই ওর চোখ ছানাবড়া! টিটানের আঁকা নগ্ন ছবিটার সমানে ও দাঁড়িয়ে আছে সীমান্তের বাম হাত ধরে। ওদের দু’জনের মুখে হাসি। এটা কি সম্ভব? এ তো রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। মহিমার গা শিরশির করে উঠলো। ওর মাথা যেন ভনভন করে চক্কর দিতে লাগলো। এ কি দেখছে ও? বুকের ভেতর অজানা ভয়ের স্রোত নেমে গেল। ফাঁকা লিফটে একা দাঁড়িয়ে ঘামতে লাগলো ও। লিপট থেকে নামতেই ওর সেলফোন বেজে উঠলো। আননোন নম্বর। ও ফোন সিরিভ করলো। ও প্রান্তে সীমান্তের গলা।
‘হ্যালো, সীমান্ত বলছি!’
‘হ্যাঁ, বলুন।’
‘আপনি লিফটেই খামটি খুলে ফেললেন?’
সীমান্তের প্রশ্নে ভ্যাবাচোখা খেয়ে গেল মহিমা। ও কিছু বলতে পারলো না। ওর বিস্ময়ের যেন শেষ নেই। সীমান্ত কি করে বুঝলেন যে, ও খামটি লিফটে খুলে ফেলেছে। ও প্রান্ত থেকে সীমান্তের হাসি শুনতে পেলো ও। মহিমা রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে পড়লো। ও বললো,
‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, কি বলবো! ছবিটা দেখে আমার গা কাঁপছে!’
‘কেনো! ছবিটা কি তোমার নয়?’
এবার সীমান্ত ওকে ‘তুমি’ করে কথা বলছে।
‘না। আমার হবে কেনো? ছবিটা কার?’
মহিমার কণ্ঠে অসহায়ত্ব ফুটে উঠে। সীমান্তর গমগমে গলায় বললো,
‘ছবিটা তোমার-আমার। আমরা এই ছবিটা তুলেছিলাম ভেনাস নগরীতে। তুমি ভুলে গেছো?’
বিস্ময়ের তুমুল ঢেউ আছড়ে পড়লো মহিমার ওপর। ঢেউটা যেন ওকে ওর জীবন থেকে এক লহমায় ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়। ও জীবনে কোনদিন বাংলাদেশের বাইরে যায়নি। এমন কি, ওর পাসপোর্ট পর্যন্ত নেই। আর সীমান্ত বলছেন কি! ও প্রাপ্ত থেকে সীমান্ত বলছে,
‘আমি জানি, তুমি মনে করতে পারছো না। তোমার স্মৃতিভ্রম হয়েছে। তোমাকে যেদিন হারিয়েছি, সেদিন থেকে আমিও নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। অভিশাপ মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, সেই কবে থেকে..!’
‘আমি, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, আপনি কী আবোল-তাবোল বকছেন!’
‘আবোল-তাবোল নয়, মহিমা। আমি তোমাকে ফিরে পেতে চাই। অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে চাই।’
‘অভিশাপ! কিসের অভিশাপ?’
‘পেয়ে হারানোর অভিশাপ!’
‘আমি রাখছি, আর কথা বলতে চাই না।’
‘না, না। নিষ্ঠুর হয়োনা, প্লিজ! তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছো না, এইতো?’
‘বিশ্বাস করার কিছু নেই, সীমান্ত সাহেব। আপনি আমার সঙ্গে কেনো এমন করছেন?’
মহিমা হতাশা প্রকাশ করে। ওর কেন জানি, কান্না পেয়ে যাচ্ছে। ও নিজেকে সামলে নেয়। ও প্রাপ্ত থেকে সীমান্ত নরোম গলায় বলে,
‘মহিমা, একটা কথা বলছি, মন দিয়ে শোনো।
‘শুনছি, বলুন।’
‘আজ রাতে তুমি একটা স্বপ্ন দেখবে।’
‘স্বপ্ন?’
‘হ্যাঁ, স্বপ্ন। ঐ স্বপ্নই বলে দেবে প্রকৃত ঘটনা। এরপর তুমি আমার কাছে চলো এসো। তখন হয়তো তোমার বিশ্বাস হবে।’
এর জবাবে কিছু বললো না মহিমা। ওর কিছু বলারও নেই। ওর মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ও প্রান্ত থেকে সীমান্ত ফের বললো,
‘স্বপ্নটাই তোমাকে ঘটনা বলে দেবে। আজ রাখি।’
এ কথা বলে ফোন রেখে দিল সীমান্ত। মহিমা রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে হতভম্বের মতো। ওর মনে হচ্ছিলো এই ভরদুপুরেই ও এক রহস্যময় স্বপ্নের ঘোরে ডুবে গেছে। এই স্বপ্ন থেকে ও যেন বের হতে পারছে না। অজানা ভয়ের ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে ওর সারা শরীরে।

অট্টালিকা নয় যেন সুরম্য প্রাসাদ! কতদিনের পুরানো কে জানে। জলের ওপর ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে এই প্রাসাদ দাঁড়িয়ে আছে। ভেনাস নগরী জুড়ে এরকম অনেক অট্টালিকা! পুরানো এই অট্টালিকাগুলো যেন একেকটি জীবন্ত জাদুঘর। ভেনাস নগরীতে এসে মহিমার চোখে অপার বিস্ময়। ও ভাবছিলো, জলের ওপর এমন পাথুরে নগর গড়ে তুলে রোমের সম্রাট পৃথিবীতে অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। এই নগরীকে মনে হয় জলের ওপর ভাসমান এক শহর। নৌকা ছেড়ে দিয়ে যে প্রাসাদে মহিমা ও সীমান্ত প্রবেশ করেছে, ঐ প্রাসাদটি একেবারে নির্জন ও ভূতুরে! প্রাসাদের প্রবেশ করার পর বড় হলরুমের দেয়াল জুড়ে দৃষ্টিন্দন তৈলচিত্র ওরা দেখতে পেলো। ওদের মাথার ওপর ১২টি ঝাড় ঝুলছে। মহিমার মনে হলো, প্রাসাদের কেয়ারটেকারের বয়স এক শ’র কম হবেনা। বয়সের ভারে বুড়ো গুজো হয়ে গেছেন। বুড়ো কথা খুব একটা বলেনি। এতো বয়সের একজন মানুষ কেনো এমন একটি অট্টালিকার কেয়ারটেকার হয়েছেন, বুঝতে পারছে না মহিমা। ও লক্ষ্য করেছে কেয়ারটেকারের চোখের দৃষ্টি বরাবরই নির্লুপ্ত। তার চোখের দিকে তাকালে গা ছমছম করে উঠে। একটি নগ্ন নারীর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে কেয়ারটেকারকে কাছে ডাকলো সীমান্ত। কেয়ারটেকার ওদের কাছে আসতেই তার দিকে ডিজিটাল ক্যামেরাটা বাড়িয়ে দিয়ে সীমান্ত বললো,
‘আমাদের একটা ছবি তুলে দিন তো!’
এ কথায় বুড়োর চোখে মুখে কেমন ভয়ার্ত ভাব ফুটে উঠলো। বুড়ো নিচু গলায় বললো,
‘এই ছবির সামনে ছবি তুললে টিটান রাগ করবে!’
‘টিটান? টিটান আবার কে?’
‘ঐ ছবি টিটান এঁকেছে।’
‘কবে এঁকেছেন?’
‘তা প্রায় ৫ শ’ বছর হবে!’
বুড়োর কথায় হো হো হো করে হেসে উঠলো সীমান্ত। মহিমা অজানা ভয়ে সীমান্তের বাম হাত শক্ত করে আকড়ে ধরলো। সীমান্ত বুড়োর কথায় অগ্রাহ্য করে বললো,
‘একটা ছবি তুলুন তো! দেখি, টিটান কী করে?’
বুড়ো গভীর অনীহা ও বিরুক্তি চোখে মুখে ফুটিয়ে ওদের দিকে ক্যামেরা তুললো। সীমান্ত ও মহিমা মুখে হাসি ফুটিয়ে তুললো। ‘ক্লিক’ শব্দের সঙ্গে ক্যামেরার সাটারের আলো বিজলীর মত চমকালো। সীমান্ত এরপর চটপট বুড়োর কাছ থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে বললো,
‘থ্যাঙ্কস। কোথায় টিটান? ওর ভূত আছে নাকি এই প্রাসাদে? আসবে এখন?’
সীমান্তের প্রশ্নে রসিকতা ও তাচ্ছিলো ফুটে উঠলো। বুড়ো কিছু বললো না। সে প্রাসাদের প্রবেশ মুখের না দিকে না যেয়ে ভেতরের অন্দর মহলের দিকে ধীরে ধীরে হেঁটে গেল। মহিমা বুড়োর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘লোকটিকে অমনভাবে না বললেও পারতে! বুড়ো মানুষ, কষ্ট পেয়েছে হয়তো।’
মহিমার কথায় আলতো হেসে সীমান্ত বললো,
‘বিংশ শতাব্দীতে এই আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে ঐ সব ভূতুরে কথা বা আষাঢ়ে গল্প শুনলে, কী আর বলবো? ৫ শ’ বছর আগে যে টিটান মারা গেছে। তার ছবির সামনে ছবি তুললে সে রাগ করবে-এ কথা বিশ্বাস করতে হবে?’
সীমান্তের কথা শেষ হওয়া মাত্র জলের কান ফাটানো গর্জন শুনতে পেলো ওরা। অতর্কিত ভয়ে মহিমা ঝাপটে ধরলো সীমান্তকে। জলের গর্জন বাড়ছে এবং মনে হচ্ছে গর্জনটা ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। বাতাশের শো শো শব্দও শুনতে পাচ্ছে ওরা। বাইরে হঠাৎ জলোচ্ছ্বাস শুরু হলো কি? এই প্রশ্নে ভড়কে গেল সীমান্ত। ঠিক এই সময়ে জলের বিশাল এক ঢেউ প্রাসাদের দেয়াল ভেঙ্গে ঢুকে পড়লো। কিছু বুঝে উঠার আগেই জলের তীব্র স্রোত এক লহমায় ওদের দুজনকে বিচ্ছিন্ন করে দিল। মহিমা চিৎকার করে উঠতেই ওর ঘুম ভেঙ্গে গেল। ওর শরীর কাঁপছিল। ঘুম ভাঙ্গা চোখে ও নিজের চারপাশটা দেখে নিল এবং বিছানায় উঠে বসলো। মধ্যরাতে ও এ কি স্বপ্ন দেখলো? প্রশ্নটা ওর মনে ছড়িয়ে যেতে লাগলো। ওর ভীষণ ভয় লাগছে এখন। সীমান্ত ওকে বলেছিল ও আজ রাতে একটা স্বপ্ন দেখবে। ঐ স্বপ্নে ও ছবির রহস্যের কথা জানবে। মহিমা তো সত্যি সত্যি একটা অদ্ভূত স্বপ্ন দেখলো। এটাও কি বিশ্বাসযোগ্য? মহিমার চিন্তা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এই প্রথম ও সীমান্তকে নিয়ে সিরিয়াসলি চিন্তা শুরু করলো। মাথার ওপর ফ্যান ফুলস্পিডে ঘুরছে। তারপরও ও ঘামছে। ওর ভেতরে দুঃশ্চিন্তার মেঘ জমে যেতে লাগলো।

মহিমার কথা শুনে ওর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন শফিক ফয়সাল। কাল তার অফিসে কারো ইন্টারভিউ নেয়া হয়নি। অথচ এই মেয়েটি বলছে সে কাল এখানে এসে ইন্টারভিউ দিয়েছে এবং ইন্টারভিউ নিয়েছে সীমান্ত। মেয়েটির কথা কোনভাবেই বিশ্বাস করার সুযোগ নেই। কারণ, তার ছেলে সীমান্ত এক বছর আগে মারা গেছে। কিš‘ মেয়েটি সীমান্তের যে বর্ণনা দিচ্ছে, তা উপেক্ষা করার মত নয়। মেয়েটি ইন্টারভিউর চিঠি পর্যন্ত দেখিয়েছে। শফিক ফয়সালের চিন্তায় একটা রহস্যের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। বাড়ছে কৌতুহল। তিনি মহিমাকে বললেন,
‘মহিমা, কাল আমাদের অফিসে চাকরির জন্য কারো ইন্টাভিউ নেয়া হয়নি। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে স্বীকার করছি তুমি যে কালকের তারিখে ইন্টারভিউ গ্রহণের চিঠি দেখিয়েছো, তা আমাদের অফিস থেকে পাঠানো হয়েছে। আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে আমাদের কোথাও একটা ভুল হয়েছে। ইন্টারভিউ নেয়া হবে তো আগামী সপ্তাহে!’
শফিক ফয়সালের কথা শুনে মহিমা ভড়কে গেল। ও এখন আর বিস্মিত হতে চায় না। ও বুঝতে পারছে এক রহস্য থেকে আরেক রহস্যে ও পড়ছে। ও বললো,
‘সীমান্ত ফয়সাল কি এই কোম্পানীর এমডি নন? আপনার রুমে আসার সময় আমি দেখলাম তার রুমে তার নাম এবং পদবীর নেমপ্লেটটা ঝুলছে।’
‘হ্যাঁ। সীমান্ত ফয়সাল আমার একমাত্র পুত্র। সে এই কোম্পানীর এমডি ছিলেন।’
‘ছিলেন মানে?’
‘মানে হচ্ছে, সীমান্ত এক বছর আগে এক দূর্ঘটনায় মারা গেছে।’
কথাটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল মহিমা। এমন কথা শোনার পর আর কি বলা যায়? ও চুপসে গেল। শফিক ফয়সালও চুপ। কয়েক মিনিট মৌনতায় পার হলো। এরপর শফিক ফয়সাল বললেন,
‘মা, সত্যি করে বলো তো, সীমান্তের সঙ্গে কি তোমার আগে কখনো দেখা হয়েছিল? বা পরিচয়?’
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মহিমা। ও বললো,
‘না, কখনোই দেখা হয়নি। পরিচয়ও হয়নি। তবে কাল সীমান্ত আমাকে একটা ছবি দিয়েছিল।’
‘ছবি দিয়েছিল! বলো কি! ছবিটা আছে?’
বিস্মিত ও ব্যাকুল হয়ে উঠেন শফিক ফয়সাল। মহিমা বলে,
‘ছবিটা দেখে আমি চমকে উঠি। কারণ, ছবিটা আমি কখনো তুলিনি। অথচ ছবিতে দেখা যাচ্ছে সীমান্তের হাত ধরে আমি দাঁড়িয়ে আছি।’
‘স্ট্র্যাঞ্জ! ছবিটা বের করো, প্লিজ!’
মহিমা নিজের ব্যাগ থেকে ছবিটা বের করে শফিক ফয়সালের দিকে বাড়িয়ে দিলো। তিনি অনেকটা ছোঁ মেরে ছবিটা নিলেন এবং দ্রুত চোখের সামনে মেলে ধরলেন। মহিমা ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। মাত্র কয়েকমুহুর্ত। ও দেখলো শফিক ফয়সালের দু’হাত কাঁপছে এবং দু’চোখের কোণ থেকে দু’টি জলের ধারা নেমে আসছে। মহিমা অবাক হলো না। ওর ভেতরে কান্নার ঢেউ বইছে। ও নিজেকে সামলে রাখছে। ও বললো,
‘কাঁদছেন কেনো?’
শফিক ফয়সাল রুমাল বের করে চোখের জল মুছলেন। তিনি কান্না সামলাতে সামলাতে বললেন,
‘মা, সত্যি করে বলো তো তুমি কে? সীমান্ত তোমাকে ভালোবাসতো, তাইনা?’
এই প্রশ্নের জবাব কী দেবে মহিমা? ও ফের একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘বিশ্বাস করুন। আপনার ছেলেকে আমি কাল ছাড়া কোনদিন দেখিনি। এখন তো শুনছি, সে এক বছর আগে মারা গেছেন। তাহলে তার প্রেতাত্মার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, বলতে হবে।’
এ কথায় চুপ করে রইলেন শফিক ফয়সাল। মহিমা কয়েক মুহুর্ত চুপ থেকে প্রশ্ন করলো,
‘সীমান্ত কবে, কোথায় এবং কীভাবে মারা গেছেন, বলবেন?’
‘কাল ছিল সীমান্তের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। এক বছর আগে সে ইতালির ভেনাস নগরীতে পানিতে ডুবে মারা যায়।’
শফিক ফয়সালের কথা শুনে মহিমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। রাতে যে স্বপ্নটা ও দেখেছে, সেটাও কি এক বছর আগের একটি সত্যি ঘটনা? সত্যি হলে মহিমা কী করে এর সঙ্গে জড়িত হবে? ও তো কখনো ভেনাস যায়নি, সীমান্তের সঙ্গে ওর পরিচয়ও হয়নি। রহস্যের পর্ব যেন বাড়ছে। মহিমা কাল রাতে দেখা স্বপ্ন এবং সীমান্তের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার বিষয়টা আর তুললো না। ওর জবাব না পেয়ে শফিক ফয়সাল বললেন,
‘আমরা জানতে পেরেছি, সীমান্তের সঙ্গে ওর গার্লফ্রেন্ড ছিল। সীমান্তের সঙ্গে সে-ও মারা গেছে, শুনেছি।’
এ পর্যন্ত বলে থামলেন তিনি। মহিমার চোখ ফেটে জল নেমে আসতে চাইছে। ও নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিচ্ছে। এখন ও কী বলবে, বুঝতে পারছে না। ওর চাকরি হয়েও হলো না। চাকরি নিয়ে ওর আফসোস হচ্ছে না। কিন্তু সীমান্ত নামক এক ঘোর লাগা রহস্য ওকে কোথায় যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মহিমা আলতো করে বললো,
‘আমি জানিনা, এরপর আমি কী বলবো, কী বলা উচিত। আমি নিজেই এক বিস্ময়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আপনাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষাও আমার জানা নেই।’
‘না, মা। অমন করে বলো না। আমি তোমার কথা ভাবছি।’
‘আমার কথা ভাববেন না। আমি চাকরি চাচ্ছি না। কাল যা হয়েছে, ধরে নোবো, কোন এক স্বপ্ন। আপনার কাছে আমার চাওয়ার কিছু নেই। বরং আপনার পুত্রহারার শোকের কষ্ট আমাকেও একরাশ কষ্টে ভাসিয়ে দিয়েছে।’
শফিক ফয়সাল ভেজা চোখে মহিমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘আমি কিন্তু তোমাকে চাকরিটা দিচ্ছি। তুমি আমার এখানেই জয়েন করবে। আমার মৃত ছেলের আত্মা তোমার সামনে এসেছে। তোমাকে চাকরি দিয়েছে। তাছাড়া সত্যি-মিথ্যা যাই হোক, তোমার সঙ্গে সীমান্তের ছবি আছে। এতোকিছুর পর তোমাকেই তো চাকরি দেবো।’
‘কিন্তু আমি এখানে চাকরি করবো না। আমি যে কী রহস্যের জালে আটকা পড়েছি, আপনাকে বলে বুঝাতে পারবো না।’
বললো মহিমা। শফিক ফয়সাল বললেন,
‘মাথা ঠাণ্ডা রাখো, মা। তোমার চাকরির প্রয়োজন। আমারও তোমাকে প্রয়োজন। অন্ততঃ আমার প্রয়াত সন্তানের আত্মার শান্তির জন্য তোমাকে দেখভাল করার দায়িত্ব আমার। তুমি অন্যভাবে বিষয়টা নিয়ো না। আমি তোমার পিতার সমান। একজন পিতা হিসাবে তোমাকে আমাদের এখানে জয়েন করার অনুরোধ করছি।’
মহিমা একটু ভাবলো। এরপর বললো,
‘আমি ভেবে দেখি, আপনাকে জানাবো।’
‘ঠিক আছে মা। তুমি আমাকে প্রতিদিন একবার ফোন করবে।’
‘আচ্ছা, ফোন করবো। আজ তাহলে উঠি?’
‘এসো। ভালো থেকো, মা।’
মহিমা শফিক ফয়সালের রুম থেকে বের হয়ে এলো। শফিক ফয়সালের ব্যবহার ওর ভালো লেগেছে। পুত্রকে ভীষণ ভালোবাসতেন তিনি। পুত্রের প্রতি ভালোবাসার টান থেকে তিনি মহিমাকে চাকরি দিতে চাচ্ছেন। কিন্তু মহিমা এক অপার রহস্যের সামনে দাঁড়িয়ে হাতরে বেড়াচ্ছে অনেক প্রশ্ন। মৃত ব্যক্তির আত্মা কি দৃশ্যমান হয়? অবিকল নিজের অবয়বে ফিরে আসতে পারে? আত্মা কি টেলিফোনে কথা বলতে পারে? এই প্রশ্ন যখন গভীর ছায়া ফেললো, ঠিক তখনই ওর ফোন বেজে উঠলো। ফোন কল রিসিভ করতেই সীমান্তের কণ্ঠস্বর!
‘বাবার সঙ্গে কী এতো কথা বললে?’
মহিমা সেল ফোনটা চোখের সামনে ধরলো। আননোন নম্বর। ও প্রান্তে সীমান্তের হাসির শব্দ শুনতে পেলো। লিফট থেকে নেমে ও পা চালিয়ে ভবনের বাইরে চলে এলো। বললো,
‘তুমি কে? সীমান্ত?’
এই প্রথম মহিমা ওকে ইচ্ছা করে ‘তুমি’ করে বললো। ও প্রান্তে সীমান্ত এতে খুশি হলো। সীমান্ত বললো,
‘কাল স্বপ্ন দেখেছিলে?’
‘হুম। বুড়ো কেয়ারটেকার টিটানের ছবির সামনে ছবি তুলতে বারণ করেছিল। তুমি ওর বারণ শুনোনি কেনো?’
‘আম জানতাম না, ঐ বুড়োটাই ছিল টিটান। এক জন্মে সে ছিল জগতবিখ্যাত চিত্রশিল্পী, উদারমনা। পরের জন্মে হিংস্র, প্রলয় সৃষ্টিকারী জাদুকর!’
মহিমা ধাতস্ত হয়ে আসছে। ও সীমান্তের সঙ্গে কথা চালিয়ে যেতে চায়। ও বললো,
‘তুমি এখন কোথায়? আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারি?’
এ কথায় হাসলো সীমান্ত। ও বললো,
‘আমি জানি, আমার বাবার কাছ থেকে তুমি আমার মৃত্যুর কথা শুনেছো, তাইনা?’
এর জবাব না দিয়ে মহিমা বললো,
‘তুমি কি সীমান্তের আত্মা?’
এ কথায় হো হো হো সীমান্ত হেসে উঠলো। মহিমার সারা গা কাটা দিয়ে উঠলো। ও প্রশ্ন করলো,
‘হাসছো কেনো? আমাকে গভীর রহস্যে ঠেলে দিয়ে তোমার আনন্দ?’
‘কেনো, তুমি রহস্য পছন্দ করো না?’
‘জানি না। ভেবে দেখেনি। তবে তোমার রহস্য উন্মোচন করতে চাই। তোমার মুখোমুখি আরেকবার দাঁড়াতে চাই। দেখা দেবে?’
মহিমার কথায় অনুরোধ ফুটে উঠে। সীমান্ত চুপ। মহিমা ফের বললো,
‘আমি জানি, তুমি আমাকে ভালোবাসো। যদি ভালোবাসো, আমাকে দেখা দাও, প্লিজ!’
সীমান্ত বললো,
‘তাহলে এখুনি চলো আসো, আমি যেখানে আছি।’
‘তুমি কোথায় আছো?’
‘আশুলিয়ায়। যেখানে বর্ষার জল তৈরি করেছে বিশাল জলাশয়, সেখানে আমি দাঁড়িয়ে আছি। এখানে এলে আমাকে দেখতে পাবে। চলে এসো।’
‘সত্যি বলছো? আসলে তোমার দেখা পাবো?’
‘একবার এসো দেখো। ভেনাস নগরীতে অভিশাপের জলের স্রোতে তোমাকে হারিয়েছি, আজ আশুলিয়ার জলের ধারে তোমাকে পাবো! এ কথা ভাবতেই আমার ভালো লাগছে।’
‘রিয়েলি! সত্যি বলছো?’
‘সত্যি বলছি, তুমি না আসা পর্যন্ত আমি এখান থেকে নড়বো না।’
এ কথা বলে ফোন কেটে দিল সীমান্ত। মহিমার মাথা চক্কর দিচ্ছে যেন। ও কিছুক্ষণ ভাবলো। এরপর রাস্তায় নেমে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করলো। ও আশুলিয়া গিয়ে দেখতে চায় সীমান্ত সশরীরে আছে কি, নেই। আত্মা এমন রহস্য করতে পারে কি? নাকি হেলুসিনেশন? মহিমা নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখলো এটি কোন স্বপ্ন নয়। ও ট্যাক্সিতে চড়ে ড্রাইভারকে তাড়তাড়ি যেতে তাড়া দিল। ও জানে না, সীমান্তের সঙ্গে ওর দেখা হবে কিনা। যদি দেখা না হয়, তাহলে এটাও রহস্য বলে ধরে নেবে। কিন্তু মহিমার মন বলছে, সীমান্তের সঙ্গে ওর দেখা হবে। ও গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো, মেঘের আড়াল সরিয়ে উজ্জ্বল হচ্ছে শেষ বিকেলের সূর্য।








সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০১০ ভোর ৬:২০
১টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পানির অপচয় রোধ: ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা এবং সমকালীন বিশ্বের গভীর সংকট

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৬

পানির অপচয় রোধ: ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা এবং সমকালীন বিশ্বের গভীর সংকট



পানি জীবনের মূল উৎস। এটি ছাড়া কোনো প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন:

وَجَعَلۡنَا... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে shoot করে লাভবান হলো কে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:২৪


শরিফ ওসমান হাদি যিনি সাধারণত ওসমান হাদি নামে পরিচিত একজন বাংলাদেশি রাজনৈতিক কর্মী ও বক্তা, যিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গঠিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত। তিনি ত্রয়োদশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×