তরুণরাই কবিতার শক্তি- কবি মহাদেব সাহা
দর্পণ কবীর ঃ প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসাবে নিউইয়র্ক এসে জ্যাকসন হাইটসে মুক্তধারা আয়োজিত এক আড্ডায় অংশ নিয়েছিলেন তিন কবি নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা এবং মুহাম্মদ সামাদ। একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার রিপোর্টে কবি নির্মলেন্দু গুণ এবং মহাদেব সাহা’র বরাত দিয়ে বলা হয়েছে এই দুই কবি এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, নতুন লেখকদের বই তারা পড়েন না এবং খাটের নিচে বই ফেলে রাখেন। এই সংবাদ ছাপা হবার পর এ নিয়ে প্রবাসের লেখক মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এই মন্তব্য সম্পর্কে কবি মহাদেব সাহা বলেছেন, এমন কথা তিনি বলেননি। সংবাদটি সঠিক নয়। কবি মাহাদেব সাহা বলেছেন, আমি তরুন ও নবীন লেখকদের প্রতি স্পর্শকাতর। পৃথিবীর সবদেশেই তরুণদের মধ্যে কবিতা বেঁচে থাকে। তরুণরাই কবিতার শক্তি। তরুণদের মধ্য থেকেই পরবর্তী কবির জন্ম হয়। আমি তরুণ লেখকদের কবিতা মনযোগসহকারে পড়ি। তাই তরুণ লেখকদের বই ফেলে রাখি এ ধরনের কথা কোন পত্রিকা লিখে থাকলে-তা সঠিক তথ্য নয়। আমার সঙ্গে তরুণ লেখকদের সম্পর্ক বন্ধুর মতো। তাই তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক কথা অমি বলতে পারি না। আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট এমন নয়। তিনি তরুণ লেখক সম্পর্কে বলেন, এখনকার তরুণ কবিরা বেশি সিম্বলিক। তাদের কবিতায় অল্পকথায় অনেক বিষয় বা চিত্রকল্প উঠে আসে। আমাদের কবিতা বর্ণনাধর্মী। এর কারণও আছে। সে সময়ের রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণে আমাদের লেখা বর্ণনাধর্মী হয়েছে। আমাদের পরবর্তী জেনারেশনের অনেকে ভালো কবি। অনেকে আমাকে বই উৎসর্গ করেছেন। দেশের অন্যতম কবি মহাদেব সাহা বুধবার (২০ অক্টোবর) দুপুরে একান্ত সাক্ষাতকারে আজকাল এর সঙ্গে এসব কথা বলেন।
প্রশ্ন ঃ আপনারা সরকারি অর্থে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে যুক্তরাষ্ট্র সফর করায় অনেকে এ নিয়ে সমালোচনা করছেন। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কি?
উত্তর ঃ আমরা কোন সরকারের সঙ্গে আসিনি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি। আমরা জাতিসংঘের চত্বরে বাংলা বর্ণমালা
গেঁথে দিতে এসেছি। আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে এসেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের সফরসঙ্গী করে কবি ও কবিতাকে সম্মানিত করেছেন। অন্য কোন রাষ্ট্রপ্রধান তো কোন কবিকে সফরসঙ্গী করেননি। আপনারা জানেন, এই সফরে বিজনেজ ক্লাস এয়ার টিকেট পরিবর্তন করে ইকোনমি ক্লাসে এসেছি। এটি একটি দৃষ্টান্ত। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের রাজনৈতিক দল বলেই আমরা এই সফরে সম্মত হয়েছি। এর মধ্য দিয়ে আমি যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার প্রবাসী বাঙালিদের দেখার সুযোগ পেয়েছে। বাংলা যে বিশ্বময় ছড়িয়ে আছে, তা দেখতে পেয়েছি। এর জন্য আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ। আমার কোন চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। উদাহরণ হিসাবে বলছি, আমি এ বছর সরকারি প্রতিষ্ঠানে বড় পদে একটি চাকরি করার অফার পেয়েছিলাম প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। কবিতা লিখতে চাই বলেই আমি সে প্রস্তাব সবিনয়ে প্রত্যাখান করেছি।
প্রশ্ন ঃ জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেবার অনুভূতি কি ছিল?
উত্তর ঃ জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী বাংলা ভাষায় ভাষণ দেবেন-তা দেখতে এসেছিলাম। প্রধানমন্ত্রী বাংলাতে যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখন আমার মনে হয়েছে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিচ্ছেন। জাতিসংঘে দেয়া তাঁর ভাষণ আমরা দেখিনি বা শুনিনি। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ সমবেত সকলের মনযোগ আকর্ষিত হয়। কারণ, তিনি তাঁর ভাষণে নিজের পারিবারিক ট্যাজেডীর কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর পরিবারের ১৮জন সদস্য ঘাতকের হাতে নিহত হয়েছেন এবং তিনি নিজেও হামলার শিকার হয়েছিলেন, এসব কথা তাঁর বক্তব্যে ছিল। শেখ হাসিনার ভাষণ সকলকে আপ্লূত করে। তাঁর ভাষণ শেষ কবার পর মুর্হুমুহু করতালিও পান তিনি। আমরা তিন কবি এই ভাষণ প্রত্যক্ষ করেছি। আমাদের আগমন স্বার্থক হয়েছে বলে মনে করি।
প্রশ্ন ঃ প্রবাসী বাংলাদেশীরা বাংলা কবিতা ভালোবাসেন কি?
উত্তর ঃ হ্যাঁ, তারা ভীষণ ভালোবাসেন। আমি জানতাম না প্রবাসে বাংলা কবিতার এতো কদর। যেখানেই গিয়েছি সেখানেই সম্মান পেয়েছি। ক্যালগরির আলবার্তায় তো ছেলে বাসায় একদিনও খেতে পারিনি। বিভিন্ন বাঙালির বাসায় নেমন্তন্ন খেতে হয়েছে। সেখানে আমাকে বাংলাদেশী সমিতির পক্ষ থেকে সংবর্ধনাও দেয়া হয়েছে। এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সেদেশের শিশু ও সমাজ কল্যাণমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় এমপি দেবেন্দ্র সরি, প্রভিন্সের ৩ এমএলএ, ডেপুটি স্পিাকার উপস্থিত ছিলেন। বাংলা ভাষার একজন কবিকে তারা যেভাবে সম্মানতি করেছেন, আমি অভিভূত। অনুষ্ঠানে কোমলমতি শিশুরা বাংলা কবিতা পাঠ করেছে, আমার কবিতাও পড়েছে ওরা। আমার মন ভরে গেছে। এখানে না এলে আমি জানতামই না, দেশের বাইরে আমাদের কবিতার কদর আছে। কবি হবার স্বার্থকতা খুঁজে পেয়েছি। আরেকটি বিষয় দেখেছি, এ দেশীয়রা কবি-লেখখদের অনেক সম্মান করেন। বাংলা ভাষার কবিতা অনুবাদ করে বিভিন্ন দেশে পাঠানো উচিত। বাংলা একাডেমী, বিভিন্ন প্রকাশক বা সরকারও এ ধরনের উদ্যোগ নিতে পারে। বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া দরকার। আমি দেখেছি, প্রবাসীরা বাংলা ভাষার বই বুকে আগলে রাখে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাস, বঙ্গবন্ধুর ছবি ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখতে দেখেছি অনেকের বাড়িতে।
প্রশ্ন ঃ নিউইয়র্কে এসে প্রবাসী বাংলাদেশীদের সান্নিধ্য কেমন লেগেছে?
উত্তর ঃ নিউইয়র্কে এসে আমি প্রবাসী বাঙালিদের আতিথিয়েতায় অভিভূত। সর্বত্র উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছি। মনে হয়েছে তারা আমার আত্মীয়। দেশের মানুষকে না দেখার দুঃখ প্রবাসীরা আমাদের পেয়ে ভুলে যান। আমি নিউইয়র্ক এবং কানাডার ক্যালগেরিতে গিয়ে প্রবাসী বাঙালিদের আন্তরিকতা প্রবলভাবে উপভোগ করেছি। এখানে ভিন্ন পরিবেশে মহুজাতিক সংস্কৃতির দেশেও আমাদের নতুন প্রজন্মের শিশুরা বাংলা বলছে, বাংলায় গান গাইছে দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বাংলা ভাষা, বর্ণমালা এবং আমাদের সংস্কৃতি এভাবে লালিত হচ্ছে দেখে আমার মনে হয়েছে, বাংলা ভাষা যে বিশ্বায়নের যুগে প্রবেশ করেছে, এর কৃতিত্ব প্রবাসী বাঙালিদের। তারা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছেন বলেই বাংলাও ছড়িয়ে পড়েছে। আজ বিভিন্ন ভাষাভাষীরাও বাংলা সাহিত্য নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। প্রবাসী বাঙালিরা সহিত্য-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে চান। আমাদের উচিত তাদের সহযোগিতা করা।
প্রশ্ন ঃ আপনি তো সাংবাদিকতাও করেছেন? আপনি কি সাংবাদি বা কলামিষ্ট?
উত্তর ঃ না, সে অর্থে বলা যাবে না। আমি সংবাদপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত, তবে পেশাদার সাংবাদিক নই। কলাম লিখি।
প্রশ্ন ঃ আপনার কবিতায় আছে, ‘মানুষই মহৎ শিল্প’। আপনি এই দর্শনে বিশ্বাসী?
উত্তর ঃ অবশ্যই। জীবন সবার ঊর্ধ্বে অর্থাৎ মানুষ সবার উর্ধ্বে। জীবন একটাই এবং সবচেয়ে প্রিয়।
প্রশ্ন ঃ কবি আর গীতিকবির মধ্যে পাথ্যর্ক কি?
উত্তর ঃ পার্থক্য নেই। গীতিকারও কবি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সলিল চৌধুরী, গৌরী প্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপধ্যায়, ডি এল রায় এর কথা যদি বলি, তারা তো সত্যিকারের গীতিকার এবং কবিও।
প্রশ্ন ঃ আপনার কবি হয়ে ঊটার নেপথ্যে আপনার স্ত্রীর ভূমিকা কি রয়েছে?
উত্তর ঃ অবশ্যই। ওর সহযোগিতার কথা স্বীকার করতেই হবে। স্ত্রী হচ্ছে সর্বাঙ্গিনী, অর্ধাঙ্গিনী নয়। অর্ধাঙ্গিনী সঠিক ব্যাখ্যা নয়। আমার স্ত্রী নীলা’র মধ্যে আমার অস্থিত্ব।