সে কি ভুলতে পারি? মনে পড়তেই থাকে। তখন শৈশব, বিস্ময় আর প্রশ্ন যখন দৃষ্টি আর মন জুড়ে খেলা করে। বিচিত্র সত্য একদিনের কথা যে বলতেই হবে। আব্বু তখন অতি জনপ্রিয় প্রভাবশালী দীর্ঘকালীন এমপি। তাই আমাদের বাড়িটি ছিল অন্যরকম সম্মানিত। এলাকার মানুষ ভাবত এটাই তাদের শান্তি আর নিরাপত্তার জায়গা। তখন আমি শুধু প্রত্যক্ষই করতে পারতাম। এত সব কি বুঝতাম?
নিরীহ গ্রামবাসী, অপরাধীর সংখ্যা খুবই নগন্য। মাঝে মধ্যে দু’একটা ছোটখাট চোর ধরা পড়ত। কদাচিৎ থানার ওসি কিছু সংখ্যক পুলিশ নিয়ে এদিক সেদিক আসতেন। কোন কোন দিন আব্বার দরবার ঘরে এসে তাঁর সাথে কথাবার্তা বলে নাস্তাও করতেন তারা। আমার সাথে তারা কথা বলতেন, আদর করতেন। তখন দেখতাম মানুষ পুলিশ দেখলেই ভয় পেত। কিন্তু কেন? আমাদের এক কাজের বুয়া অনেক ভয়ে ভয়ে জীবনে প্রথম পুলিশ দেখল উঁকি দিয়ে। তারপর বিস্ময়ে বলে উঠল, “ওম্মা পুলিশও দেহি মানুষ!” আমার ভাই বোনেরা তো এ নিয়ে হেসে লুটোপুটি। এখন সেই বিচিত্র সত্য দিনটির কথা বলছি। আব্বু তখন বাড়ি নেই। হঠাৎ দেখি অসংখ্য নারী-পুরুষ আমাদের বাড়ির চারপাশে ছুটোছুটি করছে।কেউ ভয়ে চিৎকার করছে, কেউ কলেমা পড়ছে। কিছু লোক এদিক ওদিক দিয়ে আমাদের বাড়িতে ঢুকে অস্থিরভাবে বাড়ির পেছনের বাঁশঝাড়ে লুকোচ্ছে। কেউ আবার ঘরের পেছনে ও বাইরের বাথরুমে। ল্যাট্রিনেও ঢুকে পড়েছে কেউ। কিছু চেনা গরীব ‘আম্মা বাঁচান’ বলে আমাদের খাটের নীচে, আলমারীর পেছনে লুকিয়ে গেল। আমি অবাক হলাম। দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম।মানুষের ভীড় আরো বেড়ে গেল।তাদের আতংকে আর কান্নাকাটিতে বাড়িটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। পুলিশ, পুলিশ চিৎকারে আমি হতচকিত। আমি কি করতে পারি? চোখ বন্ধ করে মাকে জড়িয়ে ধরেই আছি। দেখি মার চোখে মুখে হাসি। আবার ওদের ধমকাচ্ছেন, আঙ্গিনা ভর্তি আতংকিত জনগোষ্ঠী। খানিক পরে তাকিয়ে সব দেখলাম।
মার প্রশ্নের উত্তরে তারা বলল “আমরা হুনছি ঐ পাড়ায় পুলিশ আইছে। আমরা ডরে মইরা যাইতাছি। পুলিশ নাহি দেখলেই মারে আর দইরা থানায় লইয়া যায়?”
পুলিশ কি তাহলে সত্যিই এত অত্যাচারী? কই আব্বার সামনে তো এমন মনে হয়নি? মনে মনে অনেক রাগ করলাম, কষ্ট পেলাম। কচি মনে ঘটনাটা দাগ কেটে রইল। ঘন্টা দেড়েক বাড়িটার এই অবস্থা গেল। ইতিমধ্যে মা আমাকে বললেন, “বাড়িতে মেহমান এসেছে। মা তুমি আমাদের কাঠের বড় আলমারি থেকে দু’টো বালিশ বের করে আনতো।“ আলমারিটা ছিল চওড়া আর চার দরজার। অনেকে এটাকে বড় সিন্দুক বলত। আমি মার আদেশ পালনে সিন্দুক খুললাম। খুলে ভীষণ ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠলাম। অনেকটা ভূত দেখার মত! দেখি তিনজন লোক ভেতরে ঢুকে আছে। বাড়ির সবাই দৌড়ে এসেছে তখন। লোকগুলো বলতে লাগলো “আম্মা আপনের পায়ে পড়ি। আমরা এহনেই বাইর অইতাছি। আম্মা, আমরা কিচ্চু দুষ করি নাই। আমরা চুর না।“ দেখা গেল, তারা সত্যিই নিরীহ, নির্দোষ গরিব গ্রামবাসী।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



