চেতনায় যুদ্ধ তখন! মুক্তির চেতনায় তাড়নায় তখন দেশবাসী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো। স্বাধীনতার যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করতে পারায় এ জীবনটাকে মূল্যবান, সার্থক ও মহিমান্বিত মনে করাটা যৌক্তিক এবং আবশ্যিক। এর চেয়ে সার্থকতা এক জীবনে অনেকের ভাগ্যেই প্রত্যক্ষ করা সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার স্বপ্ন মানুষ জনম জনম ধরে আন্দোলনের ধারায় লালন করে গেছেন। মানসিক যুদ্ধ ছিল ক্রমবর্ধমান। কিন্তু যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতার উদয় দেখাটা একান্তই দুর্লভ। তাই জীবনকে অসাধারণ মনে করি।
মন প্রাণ যুদ্ধের প্রচন্ডতায় একান্ত মিশে যাওয়ায় মৃত্যু অনিবার্য জেনেও ঢাকায় অবস্থান করছিলাম। অন্ধকার নগরী, যেন মৃতের শহর। জনমানবহীন প্রান্তরে কিয়ামতের আবির্ভাব যেন। দিনে শুধু কাকের কা কা শোনা যেত। রাতে দিনে অন্ধকারে বসবাস।
ন,মাস স্থলযুদ্ধ, জলযুদ্ধ কাহিনী তখন পরিণত – সচেতন সবাই উপলদ্ধি নিয়ে অনুধাবন করেছে। সবেগে দেশের মায়ায় অনেকে ঘর ছড়েছে মৃত্যুকে বরণ করেছে। ত্রিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে যুদ্ধের অবসান হয়েছে। অর্জিত হয়েছে কাঙ্খিত বিজয়ের স্বাধীনতার সূর্য। সে ইতিহাস দেশবাসীর অন্তরে সোনার অক্ষরে লেখা হয়ে গেছে। ভুলবেনা কেউ ‘চরমপত্রের’ কথা, দুঃসাহসিক ঘটনায় মর্মান্তিক নির্যাতনে জীবন উৎসর্গের কথা। সব কথাই তো এখন ইতিহাস ধারণ করে আছে। আমার ব্যক্তিগত অবিস্মরণীয় স্মৃতিগুলো তখনকার এক মানসিক ইতিহাস যা শুধু মনেই রাখা যায়।
আমার ব্যক্তিগত ডায়েরিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন যে দৈনন্দিন সত্যিকার তথ্য ও ছবি সনচিত করেছিলাম সেই-ই তো ইতিহাস। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে অনেক যত্নে মাটির নিচে পুঁতে রাখা সত্ত্বেও লেখাগুলো উদ্ধার করা গেল না। পরবর্তিতে একজন হতাশ দেশপ্রেমিক হিসেবে কিছু নমুনা ও ছবি সংগ্রহে রেখেছিলাম। তাও অর্ধেক চুরি হয়ে গেছে অতি আগ্রহীদের গোপন হস্তক্ষেপে।
যুদ্ধ নিয়ে এখানে কিছুই লেখা হয়নি। শুধু বলছি কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা। তখন আমি ধানমন্ডি সরকারি বালিকা উচচ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা। সবে চাকুরিতে যোগদান। আমাকে হোস্টেল সুপারিন্টেডেন্ট হিসেবে পছন্দ করা হল। পাক-বাহিনী আমার ছাত্রীবাসকে তাদের হেড কোয়ার্টার হিসেবে নিয়ে নিল। আমি ছাত্রীদের নিয়ে টেনশনে। কোনক্রমে ওদের লোকাল গার্ডিয়ানের হাতে পৌছে দিয়ে আমি সর্বস্ব ত্যাগ করে ঢাকাস্থ বোনের বাসায় চলে আসি। সে অবশ্যই পঁচিশে মার্চের পরের কথা। তারপরও সরকারি চাকুরেদের উপস্থিতি ছাড়া রেহাই ছিল না। ইডেন গার্লস কলেজ অফিসে হাজিরা দিতে হত। পুরো রাজধানী তখন পাক সৈন্যদের কবলে। চলছে তাদের টহল। ট্যাঙ্ক, লরী চলছে শহর জুড়ে। জীবনটাকে হাতে নিয়ে, রক্ষা কবজ বুকে নিয়ে ‘চার কুল’ পড়তে পড়তে গলা শুকিয়ে আসতো। তারপর আবার স্কুল খুলে দেয়া হল।হোস্টেল সুপারের ডাক পড়লো। টিচার সবাই এলেন। স্কুল বেজায় অপরিস্কার। এর সংস্কার না করে ছাত্রীদের আনা যাবে না। হোস্টেল ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়েছে। টেলিভিশন, ফ্রিজ, বই-পত্র, অফিসের ফাইলপত্র কিছুই নেই। খাটগুলো পা ভাঙা, চেয়ার ডেস্ক এগুলো পুড়িয়ে রান্না করা হয়েছে। তখন গ্যাস ছিল না। জিনিসপত্র লুটপাট। মাসের বেতন পেয়ে আমার সৌখিন জিনিস কেনার অভ্যেস ছিল। নামী-দামি বই, শাড়ি, শো-পিস ইত্যাদিতে আমার আলমারী সমৃদ্ধ ছিল! হায়, সব শেষ। দেখা গেল প্রায় রুমেই মোটা মোটা রুটি ও খাবারের ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে। আছে কিছু অত্যাচারিত নারী-পুরুষের প্রামাণ্য চিহ্ন।
হেড মিস্ট্রেস ও হোস্টেল সুপার (আমি) এর সাথে তারা কথা বলতে এল। আমি সব মিসিং জিনিসপত্রের তালিকা দিলাম। কিন্তু এত হিসাব লেখা সম্ভব নয়। তাই শেষে বললাম And what not? হেড মিস্ট্রেস আমার মত কয়েকজন অবিবাহিতা শিক্ষক নিয়ে বিচলিত হয়ে পড়লেন। যেই ভাবা সেই কাজ। পরদিন আমি স্কুল গেটে নামতেই দারোয়ান এসে আমাকে বলল “ওই কর্ণেল সাহেব আপনার সাথে কথা বলবেন, বললেন ‘হোস্টেল সুপারকো বুলাও।’ কেন আমাকে একা ডাকবে? অস্থির হয়ে বড় আপাকে (প্রধান শিক্ষককে) সব জানালাম। কতক্ষণ পর দারোয়ান এসে আবার বলছে ‘আপনাকে শাদীকা পয়গাম পাঠাইছে।’ আমি এবং আমার বান্ধবী পড়ি মরি করে পিছনের তালাবদ্ধ গেট টপকে ও পাশে গিয়ে সোজা বাসার পথ ধরলাম।
স্কুলের ক্লাস রুমগুলোর ভীষণ দুর্দশা। এখানেও ময়লা কাপড় চোপড় স্তুপ স্তুপ মোটা রুটি। আবর্জনায় একেবারে ভূতের বাড়ি। ওয়াল বোর্ডগুলোতে লেখা “No Bangladesh, but due Pakistan”।
নিষ্ঠুর বর্বরতা আর নারী-পুরুষের ওপর নারকীয় অত্যাচারের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ তড়িৎ গতিতে এগিয়ে চলেছে। দুঃসাহসিক সব ঘটনায় আমরা হারিয়েছি প্রিয়জন, আত্নীয়। অনেক স্বামী, ভাই-বোন, মা-বাবা। হারিয়েছি আমার স্নেহের ছোট ভাই হাসানকে। যার সাথে কেরাম খেলায় হারতেই হত। সে কমান্ডার হয়ে সবার আগে বুক পেতে দিয়েছিল স্টানগানের বুক ঝাঁঝরা করা গুলিতে। ওদিকে আমার বাড়িতে আব্বার বিশেষ যুদ্ধ কৌশল ভিত্তিক অবদান দেশবাসী তথা স্বাধীনতাকে আশান্বিত করছিল।
সময় যুদ্ধের শেষে এসে দাঁড়াল। এবার বিমান যুদ্ধের পালা। আমরা তখন বংগ ভবন ও ইত্তেফাক পত্রিকা অফিসের মুখোমুখি একটা বাসায় থাকছি। তার বাঁ দিকেই ন’তলা এক হোটেল, এখন সেটা ইলিশিয়াম বিল্ডিং নামে পরিচিত। তখন পাক-বাহিনীর হেড কোয়ার্টার হিসেবে সেটিকে ব্যবহার করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, আমরা তখন ঝুঁকিপূর্ণ এই জায়গাতেই অবস্থান করছিলাম।তাই বেঁচে থাকার কোন আশাই আমাদের ছিল না। শুধু যুদ্ধ দেখে ধন্য হবে জীবন- এটাই আশা।
বিকট আওয়াজে যখন যুদ্ধ বিমান বংগভবন আক্রমণে আসছে, তখনই সেই ক্যাম্প থেকে অসহ্য শব্দে এন্টি এয়ার-ক্রাফট ছাড়া হচ্ছিল বিমান ধ্বংসের টার্গেটে।মাঝে মাঝে আগুন জ্বলে বিমানের ডানা ভেঙে পড়তে দেখেছি। দুয়ে মিলে আকাশ ভেঙে পড়া শব্দ। তার মাঝখানে আমরা।ঝাঁকিয়ে দিচ্ছে বাসা। জানলার কাঁচগুলো ভেঙে চুরমার হচ্ছে। কিছুক্ষণের জন্য দম আটকে যেত, মাথা ঘুরে বমি আসতো। আপার বাচচাদের দাঁতে উড পেন্সিল দিয়ে কানে তুলো ঢুকিয়ে কোনমতে অজ্ঞান ভাবের মধ্যে রাখতে হয়েছে। কান্নাকাটি করছি সবাই। আপাতো পাগল প্রায়। শেষে মনে হচ্ছিল শব্দের আঘাতে হয়ত সবাই মারা যাব। কারফিউ চলছে। আশে পাশে কোন মানুষ ছিল না।রাতে না পারতে মোম জ্বেলে সাথে সাথে নিভিয়ে দিতে হত। ভেন্টিলেটর কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা। যাতে মানুষের অস্তিত্ব কেউ টের না পায়, পাক সৈন্যদের দৃষ্টিতে কেউ না পড়ি। সে কারণে দোতলা বাড়ির নিচতলায় কারখানা ঘরে অন্ধকার ঘুপচিতে পাটিতে বসে মুহুর্তগুলো কাটানো।
দুপুরের দিকে একবার কারফিউ ব্রেক দেয়া হলো। কয়েকটা দোকান কয়েক মিনিটের জন্য অর্ধেক দরজা খুলেছিল। আমার আপু ইত্যবসরে দুই বাচচা বুকে নিয়ে পাগলের মত রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো।পেছনে আমি, দুলাভাই আর আমার ছোট বোন ছুটছি। এবার বুঝি রাস্তায় মরতে হবে। তবু আপু বাচচা বাঁচানোর চেষ্টা তো করবেই।আমরাও চাই। হঠাৎ দু’একটা গাড়ি এদিক ওদিক ছুটে গেল। আপু হাত বাড়িয়ে একটা গাড়িতে উঠে গেল। আমরাও বাধ্য। অনেক অনুরোধে ড্রাইভারকে দু’মিনিট দাঁড় করিয়ে আমি সামনের ‘হক’ এর দোকান থেকে বাচচার দুধ, চিনি ও বড় এক প্যাকেট টোস্ট নিয়ে কি যে দ্রুত গতিতে গাড়িতে উঠলাম। মনে হলে এখনও বুক কাঁপে।শুধু বাচচা বাঁচানোর জন্য এটুকু বুদ্ধি কারো মাথায় আসছিল না। গাড়ি যে দিকে যায়। দ্রুত গতিতে দৌড়াচ্ছে সদর ঘাটের দিকে। বুড়িগঙ্গা পার হবে। গন্তব্য জিঞ্জিরা।
ঘাটের কাছে এসে নামতেই আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে এক দানব বোমার বিস্ফোরণ ঘটল। যেন মাথায় পড়ল! আমরা তখন মাটিতে লুটিয়ে পড়েছি। কতক্ষণে তাকিয়েছি জানিনা। বেঁচে আছে কি কেউ? সবই ধূলোয় অন্ধকার, ধূয়ায় আচ্ছন্ন। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আধঘন্টা পর দৃষ্টি স্পষ্ট হলো কিছুটা। শোনা গেল কাছেই খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেবের লাল বাড়িটার ওপর বোমা পড়েছে। নদীতে কোন ডিঙি নেই। হঠাৎ একটা ডিঙির দেখা পাওয়া গেল। দৌড়ে সেটাতে উঠতে যাচ্ছি আমরা। কিন্তু কি আশ্চর্য! এক ষাঁড় কোথা থেকে ছুটে এসে আমাদের আগেই ডিঙির মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালো। ভয় লাগছে। মাঝি অভয় দিল, “বিপদে কেউ কারো ক্ষতি করেনা।“ কিছু সাহসই তখন সম্বল।কোনমতে কিনারে চেপে বসলাম আমরা ক’জনে। কিন্তু পড়ে তো যাচ্ছি। মাঝি বলল বিপদ সবাই বুঝে, “আপনেরা ষাঁড়ের পায়ে, লেজে ধরে থাকেন।“ তাই করতে হল আমাদের।ষাঁড় ও নির্বিঘ্নে দয়ালু হয়ে আশ্রয় দাতার মত ব্যবহার করল। ঐতিহাসিক ঘষেটি বেগমের বাড়ির পাশ দিয়ে পাশাপাশি কোথাও নেমে পড়লাম আমরা জিঞ্জিরা। সেখানেই আমাদের বাসার মালিকের পৈতৃক বাড়ি। তিনি আসার সময় আমাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন তখনই বাসা ছেড়ে আসার জন্য। জানা ছিল না, তিনিই যে মুক্তিযোদ্ধাদের মা! খুবই গোপন ছিল এ কথা। আমরা কিন্তু রাস্তায় না বেরিয়ে বাসায় সম্মানের সাথে মরণ বরণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। এটাই ছিল যুদ্ধের শেষ দিন।
নদীর ওপার থেকে বংগ ভবন, আর ঢাকার প্রয় সবই চোখে পড়ে। পরদিন সকালেই যুদ্ধ শেষ! পাক-বাহিনীর আত্নসমর্পন। যুদ্ধ জয়ের আনন্দে আকাশ বাতাস মুখর!মানুষ ছুটে আসছে স্রোতের মত বুড়িগঙ্গা পার হতে। তুমুল আওয়াজ, যুদ্ধ জয়ের আনন্দ! নাচে, গানে, বাদ্যে ফাঁকা বন্দুকের শব্দে সে এক আনন্দ লড়াই। তার সাথে হাততালি তালে তালে। আজ বাংলাদেশীর মহা প্রাপ্তি। স্বাধীন বাংলাদেশ! সাবাস!!!
পুরস্কার, মহান পুরস্কার। ফিরে এলাম সাধের স্বর্গে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



