somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'দ্য আর্ট অব ওয়ার' : ১৩ : গুপ্তচর নিয়োগ

২২ শে আগস্ট, ২০১৪ ভোর ৫:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



২য় বিশ্বযুদ্ধে সব মিলিয়ে প্রায় ১৭ মিলিয়ন সৈন্য আর ৩৫ মিলিয়ন বেসামরিক লোক প্রান হারায়। ১৯৪৫ সালের হিসেবে খরচ হয় প্রায় এক ট্রিলিয়ন ইউ এস ডলার। কিন্তু জীবন, সমাজ আর অর্থনীতিতে প্রতিটা যুদ্ধের কুপ্রভাব কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে আরো অনেক বেশি। পরিনতির কথা না ভেবেই স্বার্থপরের মত যুদ্ধের ডাক দেবার চে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছুই নেই। একজন আদর্শ জেনারেল জানেন গৌরব কখনো লক্ষ্য হতে পারেনা, গৌরব হল কৃতকর্মের ইতিবাচক ফলাফল। তাই তিনি চেষ্টা করেন ব্যক্তিগত স্বার্থের উর্ধে উঠে ন্যুনতম খরচে বিজয় অর্জন করতে।

১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্যারিসের এক বনেদি হোটেল থেকে মাতা হারি কে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। অত্যন্ত আবেদনময়ী এই ডাচ নর্তকি ছিলেন অনেকের কাংখিতা আর বহুগামী। বহু ইউরোপীয় উচ্চপদস্থ সেনাকর্মকর্তা, ডাকসাইটে রাজনীতিবিদ আর হোমরা চোমরাদের সাথে ছিল তার উঠা বসা। কোন সুনির্দিস্ট প্রমান উপস্থাপন ছাড়াই বৃটিশ আর ফ্রেঞ্চ ইন্টেলিজেন্স ক্রমাগত তার বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ এনে অক্টবর মাসে ফায়ারিং স্কোয়াডে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে। একটাই প্রমান গোয়েন্দারা তার বিরুদ্ধে জোগাড় করতে পেয়েছিল, আর তা হল তার ঘরে পাওয়া এক প্রকার রহস্যময় গুপ্ত কালি, যদিও মাতাহারি দাবী করেছিলেন যে ওটা ছিল তার মেকাপ এর বিশেষ প্রসাধনী। যাহোক ১৯৭০ সালে খোলা জার্মান গোপনীয় দলিলাদি থেকে প্রমানিত হয় মাতাহারি তাদের গুপ্তচর ছিলেন, তার কোড নেম ছিল ‘এইচ-২১’।

সানজু বলেন, একমাত্র দুরদর্শিতাই পারে একজন শাসক আর জেনারেলকে বিজয়ী করতে। এই দুরদর্শিতা আধ্যাত্মিক সাধনা থেকেও আসেনা, অভিজ্ঞতা থেকেও না, এমনকি নির্ভুল হিসেব কষেও পাওয়া যায় না। এর জন্য চাই সঠিক তথ্য। শত্রুর সংখ্যা, সামর্থ্য, মোতায়েন আর পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য পেলেই শুধুমাত্র আপনি সঠিকভাবে আপনার সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। এই তথ্য সংগ্রহের জন্য চাই উপযুক্ত গুপ্তচর।

চন্দ্রগুপ্ত মুরিয়া ছিলেন মুরিয়ার রাজা আর চানক্যের ছাত্র। তার গুপ্তঘাতক আর গুপ্তচর ব্যবহারের বর্ননা পাওয়া যায় চানক্যের বিখ্যাত ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থে। প্রাচীন ইজিপসিয়ান, গ্রীক আর রোমানদের মাঝেও গুপ্তচর নিয়োগের দৃস্টান্ত প্রচুর। বর্তমানে সি আই এ, কেজিবি, মোসাদের মত প্রত্যেক দেশেরই নিজস্ব এসপিওনাজ আছে। সানজুর মতে গুপ্তচর পাঁচ প্রকার।

একঃ নেটিভ এজেন্টরা হল যে এলাকায় আপনি যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন সেখানকার স্থানীয় লোক। যুদ্ধের কারনে জনজীবন এমনিতেই অতিস্ট হয়ে যায়। স্থানীয়রা যদি এমনিতেই আপনার শত্রুর ওপর ক্ষিপ্ত থাকে, তাহলে তো কাজ খুব সোজা। অন্যথায় খাবার আর পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে তাদের কাজে লাগানো যায়। আর একেবারে বেকায়দায় মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে বা ব্ল্যাকমেইল করেও এদের ব্যবহার করা যেতে পারে।

দুইঃ ইন ওয়ার্ড এজেন্ট হল শত্রুর সামরিক অথবা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। এদের বিপুল পরিমান উৎকোচ দিয়ে অথবা অন্য উপায়ে কিনে ফেলা যায়। এদের অনেকেই নানা কারনে নিজ দেশের সরকার বা প্রশাশনের ওপর নাখোশ থাকে, তাই চেনা সহজ।

তিনঃ ডাবল এজেন্ট হল শত্রুর গুপ্তচর যে আপনার হয়েও কাজ করে। নিজ স্বার্থেই এরা দুই দিকেই তথ্য বিক্রি করে। তাই নিজেদের তথ্য যতটা সম্ভব এদের কাছ থেকে গোপন রাখতে হয়। এসপিওনাজ জগতে এদের কখনও পুর্ন বিশ্বাসের সুযোগ নেই।

চারঃ এক্সপান্ডেবলস হল সেই সব গুপ্তচর যারা শত্রুকে বিভ্রান্ত করতে আপনার দেয়া ভুল তথ্য নিয়ে ইচ্ছেকরে শত্রুর হাতে ধরা দেয়। শত্রু আপনার ভুল তথ্যের ওপর কাজ করতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়, আর আপনি তাকে পরাস্ত করতে পারেন।

পাঁচঃ সারভাইভিং বা জীবিত গুপ্তচরেরা আপনার নিয়োগ দেয়া গুপ্তচর যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শত্রুর তথ্য সংগ্রহ করে ফিরে আসে। সেরা গুপ্তচরেরা সহজে আর লাভজনকভাবে যুদ্ধজেতার মত তথ্য এনে দিতে সক্ষম।

যখন এই পাঁচ ধরনের গুপ্তচরেরা একত্রে কাজ করে, তখন সানজু একে বলেন, ‘মহান রেশমের গুটি।’ রাস্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের লোকেরাই শুধু এদের ব্যাপারে জানে। এমন সংস্থা আর তাদের কাজ রাস্ট্রের সবচে স্পর্শকাতর আর গুরুত্বপুর্ন বিষয়। তাই গুপ্তচরদের সবসময় উন্নত পারিশ্রমিক আর সুবিধাদি দিয়ে রাখতে হয়। গুপ্তচরেরা অবশ্যই অত্যন্ত মুল্যবান অস্ত্র, তাই তাদের উপযুক্ত ব্যবহার আর তদের কাছ থেকে প্রকৃত তথ্য বের করে আনার মত প্রজ্ঞা থাকা আবশ্যক। এসপিওনাজ পরিচালনা অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। ঘরে বাইরে সবখানে এদের ব্যবহার করা যায়। তাই গুপ্তচরদের ডাবল এজেন্ট হবার ঝুঁকি সম্পর্কে যেমন সজাগ থাকতে হয়, তেমনি তাদের আত্মত্যাগের প্রতিও সহানুভুতিশীল থাকা জরুরী।

গুরুত্বপুর্ন তথ্য জানা গুপ্তচরদের নজরে রাখুন। অপারেশনের আগে আপনার প্ল্যানের নিরাপত্তার খাতিরে এদের সরিয়ে দিন। শত্রু জেনারেল, তাদের স্টাফ অফিসার আর অন্যান্যদের সম্পর্কে আপনার গুপ্তচরেরা আপনাকে যত বেশি তথ্য দেবে, আপনার কাজ তত সহজ হবে। শত্রুর গুপ্তচরদের সনাক্ত করতে চেষ্টা করুন আর খুঁজে পেলে তাদের অত্যাচার না করে কিনে ফেলতে চেষ্টা করুন। এক্ষেত্রে কার্পন্য না করাই শ্রেয়, কারন সে যদি ডাবল এজেন্ট হতে রাজি হয় তাতে আপনারই লাভ। ডাবল এজেন্টরা উপযুক্ত স্থানীয় আর ইন ওয়ার্ড গুপ্তচর নিয়োগে সহায়তা করতে পারে। এছাড়াও তার তথ্যের ওপর ভিত্তিকরে আপনার গুপ্তচরদের আপনি সঠিকভাবে নিয়োগ করতে পারবেন। সবশেষে, যখন তার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে তখন তাকে ভুল তথ্য দিয়ে শত্রুর কাছে ফেরত দিতে পারেন। তবে ডাবল এজেন্টদের দেয়া তথ্যই সবচে গুরুত্বপুর্ন। কারন এরা সহজাতভাবেই শত্রু সম্পর্কে আপনার গুপ্তচরদের চেয়ে ভাল জানে। মনে রাখা ভাল যে, জেরা করলে আপনি জানতে পারবেন যা আপনি জানতে চান, কিন্তু যদি তাকে কিনে নিতে পারেন তাহলে সে আপনাকে জানাবে যা আপনার জন্য জানা জরুরী।

আপনার সবচেয়ে মেধাবী লোকদের আপনি কোথায় নিয়োগ দেন, তা খুব গুরুত্বপুর্ন। আপনি কি তাদের সম্মুখ যুদ্ধে পাঠাবেন, নাকি অন্যদের প্রশিক্ষিত করতে প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেবেন, নাকি গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ করবেন? যেকোন যুদ্ধে সিক্রেট অপারেশনের গুরুত্ব অপরিসীম, কেননা যুদ্ধক্ষেত্রে আপনার প্রত্যেকটা চাল এর উপর নির্ভরশীল।

যুগের পর যুগ অভিজ্ঞতা আর সাধনায় লব্ধ প্রজ্ঞা বা উইজডম সবসময়ই এক বিরল অর্জন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই প্রজ্ঞার সঠিক হস্থান্তর রাস্ট্রের পরম্পরাকে সমুন্নত রাখে; কিন্তু একবার যদি কোনভাবে তা হারিয়ে যায়, তবে রাস্ট্রের পতন হয়, আর এই প্রজ্ঞা পুনরায় অর্জন করতে দীর্ঘ সময় আর সাধনার প্রয়োজন। তাই যেকোন জাতির অনুজদের জন্য তাদের অগ্রজদের এই কস্টার্জিত প্রজ্ঞাকে ধারন, চর্চা আর লালন করতে না পারার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছুই নেই!

সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ১:২৬
১৬টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইসলামে পর্দা মানে মার্জিত ও নম্রতা: ভুল বোঝাবুঝি ও বিতর্ক

লিখেছেন মি. বিকেল, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১:১৩



বোরকা পরা বা পর্দা প্রথা শুধুমাত্র ইসলামে আছে এবং এদেরকে একঘরে করে দেওয়া উচিত বিবেচনা করা যাবে না। কারণ পর্দা বা হিজাব, নেকাব ও বোরকা পরার প্রথা শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×