এইতো কিছুদিন আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের মহাকারবার নিয়ে একটি সংবাদপত্রে বড় আকারের এবং বিস্তারিত অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেদন ছাপা হল। এর কয়েকদিন পর একই পত্রিকায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্প ও অধিদপ্তরের দুর্নীতি তদন্তে সচিব মহোদয়ের কমিটি গঠনের প্রেক্ষিতে এর সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তা ও ডাক্তারদের সচিবকে মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেয়ার তৎপরতা সম্পর্কেও একটা প্রতিবেদন ছাপা হল। আজ ছাপা হল ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ভূমি আপিল বোর্ডে স্থানান্তরিত সেই সচিব মহোদয়ের পদত্যাগ পত্র (অবসরে যাবার অজুহাতে) জমা দেয়ার সংবাদ।
একসময় তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত সেবার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার সূত্রে এবং পেশাগত কারণে সচিবালয়ে যাতায়াত হেতু বেশ কয়েকজন উপ-সচিব, যুগ্ম সচিব ও সচিব মহোদয়ের সস্নেহ সান্নিধ্য লাভ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে বর্তমানে দু'জন জ্যেষ্ঠ সচিব পদমর্যাদায় দু'টি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন। একজন জনাব সি কিউ কে মুস্তাক আহমেদ যিনি স্বরাষ্ট্র সচিব এবং অন্যজন সদ্য স্বাস্থ্য সচিবের পদ থেকে স্থানান্তরিত প্রকারান্তরে অপসারিত জনাব হুমায়ুন কবীর।
রাজনৈতিক অথবা প্রশাসনিক কোনো বিষয়েই উচ্চতর জ্ঞান, দক্ষতা বা স্পষ্ট ধারনা না থাকা সত্ত্বেও এবিষয়ে দুয়েকটি কথা না বললে এই সব লোকদের, যাঁদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অনুজ স্নেহে ধন্য হয়েছি তাঁদেরকে অবমাননা করা হয়। আজ সবার আগে মনে পড়ছে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে অবসরে চলে যাওয়া প্রাক্তন সচিব জনাব ফজলুর রহমান সাহেবের কথা। স্মরণ করছি প্রাক্তন সচিব জনাব আ ন ম হাফিজ এবং জনাব সৈয়দ তানভীর হোসেনকে। খুব অল্প সময়ের জন্য শেষোক্ত দু'জনার সান্নিধ্য পেলেও তাদেরকে দেখেছি একাধারে বিনয়ী ও চৌকস সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে।
সৈয়দ তানভীর হোসেন সাহেব পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকাকালীন একবার ডাক পড়ল কম্পিউটার ক্রয় সংক্রান্ত দরপত্রের কারিগরি ও প্রকৃত মূল্য যাচাই নিয়ে কিছু অভিজ্ঞতা বিনিময়ের। অনেকটা উচ্ছ্বাস নিয়ে তাঁর রুমে ঢুকেছিলাম এই ভেবে যে, আজ একজন আমলাকে অন্তত বিশেষ কিছু জ্ঞান দেয়ার সুযোগ পাবো। পরিচয় পর্ব শেষে নির্ধারিত আলোচনার ভূমিকার শুরুতেই উনি বলেছিলেন 'আমি কিন্তু কম্পিউটারের কিছুই জানিনা'। অগত্যা আমি ওনাকে বাজিয়ে দেখার জন্য কম্পিউটার সংশ্লিষ্ট একদম প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু প্রশ্ন করেছিলাম। উনি মুচকি হেসে আমার প্রশ্নগুলোকে উড়িয়ে দিয়ে পাশে থাকা ব্যাগ থেকে বের করলেন একে একে দু'টি ল্যাপটপ তারপর ড্রয়ার ঘেঁটে তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত একগাদা মূল্যবান বই যেগুলো আমার কোনদিন হাতিয়ে দেখারও সৌভাগ্য হয়নি। জীবনে অল্প বিদ্যায় ভয়ংকরী হয়ে ওঠার চেষ্টা শেষে নিজের কাছে নিজে লজ্জিত হবার দুয়েকটি ঘটনার এটি একটি। যাহোক সেদিন আমি দেখেছিলাম একজন আমলাকে যিনি যুগ সচেতন এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপে সাহস রাখা সহ রাষ্ট্রীয় অর্থের সর্বচ্চ সদ্ব্যবহারে সদা সতর্ক।
একদিন এক ভদ্রলোক মাধ্যমিক অধ্যয়নরত ছেলেকে নিয়ে এলেন শাহবাগের আজিজ মার্কেটে আমার এক কামড়ার কম্পিউটার বিক্রয় এবং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে। পরিচয় জানতে চাইলে একজন সাধারণ ক্রেতা হিসেবেই গণ্য করার জন্য বিনয়ের সাথে অনুরোধ করলেন। কম্পিউটারের কারিগরি দিক এবং মূল্য যাচাই করার পর মাত্র সাত হাজার টাকার জন্য ছোট্ট ছেলেটির আবদার রক্ষা করতে পারলেননা। ছেলেটির প্রবল আকাংখা ও আগ্রহের ইন্টেল মাদারবোর্ড আর প্রসেসরের পরিবর্তে তাকে কিনে দিলেন মাত্র সাত হাজার টাকা কম মূল্যের এএমডি মাদারবোর্ড ও প্রসেসর যুক্ত কম্পিউটার। শেষে তার এই আর্থিক অপারগতার জন্য ছেলের কাছে বিনয়ের সাথে ক্ষমা প্রার্থীও হলেন আমারই সম্মুখে। যাবার সময় অত্যন্ত বিনয়ের ভঙ্গিতে সংগে থাকা খুবই সাধারণ হাত ব্যাগ থেকে একটি ভিজিটিং কার্ড বের করে আমার টেবিলে রাখলেন। তখনই জানলাম উনি কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব। পরবর্তীতে যেকোনো কারণেই হোক ফজলুর রহমান সাহেবের স্নেহভাজন হয়েই আমি সচিবালয়ের নামোল্লেখিত ঊর্ধ্বতন সরকারী কর্মকর্তাদের সাহচর্যে যাবার সুযোগ পাই।
আমাদের প্রশাসনে অদক্ষ দুর্নীতি পরায়ণ আমলা যেমন আছে তেমনি দক্ষ ও সৎ আমলার সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। আমাদের দেশে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় যেমন অনেক ভাল পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ ভেস্তে যায়, তেমনি আমলাদের গৃহীত অনেক ভাল পরিকল্পনা ও পদক্ষেপও অঙ্কুরে বিনষ্ট হয় অদূরদর্শী ও হটকারি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারনে। কেননা কিছুদিন পরপর আমলাদের দপ্তর পরিবর্তনের কারণ যে শুধু প্রশাসনিক বাধ্যবাধকতা বা শৃঙ্খলা আনয়ন করা তা বিশ্বাস করা বড্ড কঠিন।
জনাব হুমায়ুন কবীর সাহেব একজন সজ্জন সুভাষী বিনয়ী সুশিক্ষিত দক্ষ ও সৎ সরকারী কর্মকর্তা। চট্টগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ও মানী পরিবারের সদস্য হুমায়ুন কবীর সাহেবের পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও স্ব স্ব পেশায় সাফল্যের সাথে সুনাম অর্জন করেছেন যাঁদের দুয়েকজনকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব থাকা অবস্থায় হুমায়ুন কবীর সাহেবের সাথে আমার পরিচয় এবং তাঁর সততা ও নির্মোহতার ব্যাপারে আমি অবগত। এই ভদ্রলোকের সাথে কথোপকথনের সুযোগ যাদের হয়েছে তারা জানেন পাশাপাশি বিনয় আর বিভিন্ন বিষয়ে অগাধ জ্ঞানের সম্মিলন একজন মানুষকে কোন পর্যায়ে উপনীত করতে পারে। বিভিন্ন সময় তথ্যপ্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে ওনার সাথে আলোচনা হলেও অনেকদিন পর অন্য একজনের কাছ থেকে জেনেছি, হুমায়ুন কবীর সাহেব কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের জন্য বাংলা ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় একটি বই লিখেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল গত সংসদ নির্বাচন সম্পন্নকারী নির্বাচন কমিশনের পুরোটা সময় তিনি সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন।
একজন যোগ্য সৎ ও দক্ষ সর্বচ্চ কর্মকর্তা তাঁর উপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে যদি তাঁর অধীনস্থ অসৎ ও অদক্ষ কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদেরই তার পেশাগত দায়িত্ব ও পদের জন্য হুমকি মনে করেন, তাহলে কোনো আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি তা মেনে নেবেন না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব জনাব হুমায়ুন কবীরের উপর অর্পিত প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে জনস্বার্থে তিনি যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তার দিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন সহ তাকে চ্যালেঞ্জ করে ভূমি আপিল বোর্ডের গুরুত্বহীন পদে আসীন করার গর্হিত নীল নকশা প্রণয়ন করেছিল দলীয় ও স্বার্থান্বেষী মহল। আর এই অন্যায় কাজটি সংঘটন করা সহ এর ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে জনপ্রশাসন নামে খোদ রাষ্ট্রযন্ত্রেরই একটি বিভাগের মাধ্যমে। অতএব প্রশাসনে শৃঙ্খলার ধুঁয়া তুলে রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা সংঘটিত এহেন রাষ্ট্রীয় অপরাধেরও বিচার চাইবার সময় এসেছে এখন।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মার্চ, ২০১৩ বিকাল ৩:৪০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



