কোন কমিউনিটিই তার স্বাধীন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না যদি সেই কমিউনিটি তার সাধারণ সদস্যদের নিরাপত্তা বিধান করতে না পারে, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের হাত থেকে তাদেরকে মুক্ত করতে না পারে বা মুক্ত করার সংগ্রামটা জারি না রাখে। সন্দেহ নেই আর সব কমিউনিটির মতো ব্লগারস কমিউনিটির মধ্যেও বিভিন্ন আদর্শ উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে ভিন্নমত, বিভেদ, দলাদলি ইত্যাদির অস্তিত্ব আছে এবং এগুলো থাকবে। এর মধ্যেও একটা বটম লাইন ঠিক করে ব্লগাররা দল-মত নির্বিশেষে এক হতে পারে, ব্লগারদের উপরে বিভিন্ন ব্যাক্তি গোষ্ঠী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের চালানো আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে পারে। বাংলা ব্লগের ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, জাতীয় স্বার্থ, অসাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে এরকম একটি বটম লাইন ঠিক করা যেতে পারে যার স্বপক্ষের সমস্ত ব্লগাররা ঐক্যবদ্ধ হয়ে, দল-মত-ব্যাক্তিগত বিভেদ ইত্যাদি ভুলে ঐক্যবদ্ধ লড়াই করবে।
বতর্মানে আমরা এমন একট সময় পার করছি যখন ব্লগাররা বিভিন্ন ব্যাক্তি/গোষ্ঠী/রাষ্ট্রের আক্রমণ, নিপীড়ন ও অপপ্রচারের স্বীকার। ব্লগারদেরকে মতপ্রকাশের জন্য কোপানো হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ইচ্ছা মত অপপ্রচার হচ্ছে, তাদেরকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে দাগী আসামীর মতো রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে এমনকি তাদের ফাসীর দাবীতে লংমার্চ মহাসমাবেশ পর্যন্ত হচ্ছে। এরকম একটা ক্রান্তিকালীন সময়ে আক্রান্ত ব্লগারের দোষ-গুণ, ভালো-মন্দ খুজে বেড়ানো বা তাকে নিয়ে বিদ্যমান দলাদলির কাদা ঘাটাঘাটির বদলে হুমকী আক্রমণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে ব্যাপক হৈ চৈ প্রতিবাদ প্রতিরোধ আন্দোলন সংগ্রাম করতে না পারলে যে কোন ব্লগার যে কোন সময়ে স্রেফ তার লেখার জন্য মত প্রকাশের জন্য আক্রান্ত হবে, নিপীড়িত হবে। এভাবে একজন দুইজনকে মেরে, গ্রেফতার করে, নির্যাতন করে পারে পেয়ে যেতে যেতে একসময় সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে – ও, এরা তো ব্লগার, এদেরকে তো চাইলেই মারা যায়, হুমকী দেয়া যায়, গ্রেফতার করা যায়, রিমান্ডে নেয়া যায়। এরকম একটা ধারণা/বাস্তবতা একবার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তখন কিন্তু সর্বনাশ হয়ে যাবে।
আক্রমণ কারী ব্যাক্তি/গোষ্ঠী/প্রতিষ্ঠান/রাষ্ট্রকে যদি এই বার্তাটা দিয়ে দেয়া যায় যে- মতপ্রকাশ বা লেখালেখির জন্য ব্লগারদের যে কাউকে গ্রেফতার-নির্যাতন করলে, আক্রমণ করলে বা আক্রমণের হুমকী দিলে তার বা তাদের অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি শুরু করে দেবে ব্লগাররা (সরকারকে বাধ্য করার মধ্যে দিয়ে এবং অন্যান্য কমিউনিটির সহযোগীতা সাথে নিয়ে), কেবল তখনই ব্লগারদের আক্রমণ বা আক্রমণের হুমকী দেয়ার সাহস পাবে না কেউ। এর জন্য সবার প্রথমে ব্লগারদের নিজেদের মধ্যে হুমকী ধামকীর চর্চা বন্ধ করতে হবে, সেই সাথে যে কোন ব্লগারের উপর হুমকী ধামকিকে গোটা কমিউনিটির স্বাধীন অস্তিত্বের উপর হুমকী হিসেবে বিবেচনা করে অন্যান্য কমিউনিটির সাথে পারস্পারিক সহযোগীতার মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার। আর এই কাজে প্রভাবশালী, প্রথিত যশা ব্লগার/অনলাইন এক্টিভিষ্টদের দ্বায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। এই বিষয়ে ব্লগাররা যে মাঠে নাই বা প্রতিবাদ করছেন না তা নয়, ব্লগারদের গ্রেফতার কিংবা আক্রমণের প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই অনেক ব্লগার মাঠে নেমে এসেছেন, মিছিল সমাবেশ করেছেন, লেখালেখি করেছেন এবং এখনও করছেন। কিন্তু সকলের অংশ গ্রহণের মধ্যে দিয়ে যে ব্যাপক মাত্রায় এটা হওয়া দরকার তা এখন পর্যন্ত হয় নি।
ব্লগারদের থেকে ভিন্ন ধরণের একটি কমিউনিটির উদাহরণ থেকে আমরা এ ব্যাপারে ধারণা নিতে পারি। সাধারণ ভাবে শ্রমিকরা এবং বিশেষত বর্তমান সময়ে গার্মেন্টস শ্রমিকরা কেমন করে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বা করার চেষ্টা করে?সাধারণত তাদের পক্ষে রাষ্ট্র নাই, মালিক নাই, সুশীল সমাজও নাই- বলতে গেলে তারা ছাড়া তাদের পক্ষে আর কেউ ই থাকে না বরং তাদেরকে শোষণ করবার, নিপীড়ন করবার ব্যাক্তির/গোষ্ঠীর অভাব নাই। ব্লগারদের এখনও এরকম খারাপ অবস্থা হয় নাই। তো, কোন এলাকার বা কারখানার গার্মেন্টস শ্রমিকরা যখন শোনে তাদের কোন সহকর্মীকে নিপীড়ন করা হয়েছে, আক্রমণ করা হয়েছে, ছাটাই করা হয়েছে বা ছাটাই করার হুমকী দেয়া হয়েছে, তারা কিন্তু তখন সেই আক্রান্ত শ্রমিককে নিয়ে দলাদলিতে লিপ্ত হয় না, সেই শ্রমিকের উপর চালানো জুলুমের বিরুদ্ধে শুধু সেই নির্দিষ্ট কারখানাই না, গোটা এলাকার প্রায় সমস্ত কারখানা থেকে শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসে। এর মাধ্যমে যে গার্মেন্টস শ্রমিক শোষণ, নিপীড়ন বন্ধ হয়ে গেছে তা না, বিদ্যমান রাষ্ট্র ব্যাবস্থায় তা হওয়া সম্ভবও নয়, যে কোন ইস্যুতেই তারা দাবী দাওয়া নিয়ে রাস্তায় নামলেই নিপীড়িত হয়। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক নিপীড়ন ততটুকুই বন্ধ করা গেছে, যতটুকু সেই কর্মক্ষেত্র ও তার আশপাশের শ্রমিকরা তার বিরুদ্ধে তোলপাড় করতে পেরেছে। এটা না করতে পারলে, গার্মেন্টস শ্রমিকদের সার্বিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হতো। বস্তুত, আজকে ইউরোপে শ্রমিক সহ সাধারণ মানুষের জন্য ন্যূনতম যে নিরাপত্তা ব্যাবস্থা রয়েছে, তা কিন্তু এরকম অসংখ্য যৌথ আন্দোলন সংগ্রামেরই ফল।
বাংলাদেশে বর্তমানে কয়েক লক্ষ ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট রয়েছেন। এই ক্রান্তিকালে ব্লগারদের গ্রেফতার নির্যাতন আক্রমণ হুমকী ধামকি অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ভার্চুয়াল অ্যাক্টিভিজমের পাশাপাশি ব্লগারদের সকলের ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নেমে আসার এখনই চূড়ান্ত সময়। চারিদেকে অন্ধকারের শক্তির সাথে যে আপোষ আতাত ষড়যন্ত্রের খেলা চলছে, অন্ধকারের শক্তির প্রদর্শনী চলছে, তার বিরুদ্ধে এখনই ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাল্টা শক্তি প্রদর্শন করতে না পারলে কমিউনিটি হিসেবে স্বাধীন শক্তিশালী অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকতে পারবো না আমরা ব্লগাররা।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই এপ্রিল, ২০১৩ দুপুর ২:৩২