মেডিকেলে ভর্তির পর প্রথম একা যাওয়া আসা শুরু করতে হল, আব্বু-আম্মু এত বড় মেয়েকে তো আর কলেজে আনা-নেয়া করতে পারেনা, চক্ষুলজ্জা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে!
মাসখানেক হল 1st year এর ক্লাস শুরু হয়েছে, লোকাল বাসে যাই-আসি, কারণ ওই রুটে আর কোন ট্রান্সপোর্ট নেই। সেদিন ক্লাস শেষে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি, একের পর এক বাস চলে যাচ্ছে, প্রচণ্ড ভিড়, পাদানিতে মানুষ ঝুলছে, আমার ওঠার প্রশ্নই আসেনা। একটা বাস না থামিয়েই চলে যাচ্ছিল, হঠাৎ একটা ছেলে বিরাট হাই জাম্প দিয়ে বাসের দরজা ধরে ঝুলে পড়লো, প্রায় পড়ে যেতে যেতে সামলে নিল, রাস্তার লোকজন হইহই করে উঠল, এরই মধ্যে রাস্তায় থেকে যাওয়া তার বন্ধুটি ডাক দিল, "ফাহিম..." ছেলেটা মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, চোখ পড়ল আমার চোখে। আমি তখন মনে মনে ভাবছি, এতো সেই ছেলেটা... নাম তাহলে ফাহিম... আমার মনের কথা বোধহয় মুখে প্রকাশ পাচ্ছিল, কারন ছেলেটা হেসে আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল... সিনেমার দৃশ্যের মত ছবিটা এখনও আমার চোখে ভাসে, বাস ধীরগতিতে চলে যাচ্ছে, ফাহিম আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে, মুখে হাসি... আমি কি সাড়া দিয়েছিলাম? আজ আর মনে পড়ে না...
কলেজের দ্বিতীয় সপ্তাহে আধা ঘণ্টা লেট করে একটা ছেলে ক্লাসে ঢুকল, তখন লেট করাটা এমন কোন অপরাধ না, চারদিকের মেডিকেল থেকে মাইগ্রেশন করে সমানে ছেলে মেয়ে আসছে আর যাচ্ছে, যার যখন ভর্তি কমপ্লিট হচ্ছে, সে তখনি ক্লাসে চলে আসছে। ছেলেটার ঘুম ঘুম চোখ, খাটো, হাল্কা-পাতলা মেয়েলি ধরনের চেহারা, মাথায় অনেক দিনের না কাটা বড় বড় চুল। সিটে বসেই সে মেয়েদের সারি পর্যবেক্ষণ করা শুরু করল, আমার চোখে চোখ পড়তেই হাসি দিল। আমি লাল বর্ণ ধারণ করে চোখ সরিয়ে নিলাম বটে, কিন্তু ক্লাসের বাকি আধা ঘণ্টায় আরও অনেকবার তাকাতে ভুললাম না, প্রতিবারই ওর চোখ আমার চোখকে খুঁজে নিল।
কয়েকদিন পর দোতলা দিয়ে যাচ্ছিলাম, দেখি ছেলেটা তিনতলা থেকে নেমে আসছে। আমাকে দেখে ডাক দিল, "আচ্ছা, বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাবটা কোথায় জানো?" এবার আমার হাসার পালা, আমি দেখেছি সে তিনতলা থেকে নামছে, তিনতলায় বড় বড় করে লেখা আছে, “বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরী”, বয়স্কশিক্ষার ছাত্রও পড়তে পারবে! আমি সুন্দর করে ডিরেকশন দিতে লাগলাম, আমার কথার ফাঁকে দুষ্টামি ওর কাছে অজানা থাকল না। আমাকে থ্যাংকস দিয়ে ও চলে গেল, তখনও নাম জানতাম না, সেদিন বাস স্ট্যান্ডে জানলাম।
সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্যবশত তা পরে বোঝা যাবে, ফাহিম আর আমি একই ব্যাচে পড়লাম। এনাটমি টিউটোরিয়ালে মুখোমুখি বসি, হাসি আর দৃষ্টি বিনিময় চলে। ক্লাসে আগে থেকেই সব পড়া পড়ে যাই, ওকে ইমপ্রেস করার একটা ব্যাপার আছেনা! প্রায়ই কথা হত, একবার ও ওর প্রাকটিকাল খাতার ছবি এঁকে দিতে বলল, আমি তো মহাখুশি, আমাকেও তাহলে ওর প্রয়োজন হয়! খাতা জমা দিলাম, ফেরত দেয়ার পর ও নিজের খাতার সাথে আমার টাও নিয়ে এল, ক্লাসের সবার সামনে সেদিনকার মত খুশি আমি আর হইনি, দেখা গেল দুজনের কারও খাতাই সাইন হয়নি!
আমি অনভিজ্ঞ ছিলাম, কিন্তু বোকা ছিলাম না, ফাহিম কেমন ছেলে তা আমি ভালই জানতাম, সেই বিশেষ হাসি ও ক্লাসের সব মেয়েদের দিকেই তাক করত। শার্টগুলো শেষ হত কোমরের ওপরেই, প্যান্ট শুরু হত আরও দুই ইঞ্চি নিচ থেকে, কলেজে স্যান্ডেল পরায় কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ওকে কখনও শু পরতে দেখিনি। নিজের চোখে দেখে তারপর বিশ্বাস করেছি, যে এই বয়সেই ও চেইন স্মোকার, অথচ বিশ্বাস না করার কারণই ছিলনা।
পাঁচ মাস পরের কথা... কলেজে কোন একটা অনুষ্ঠান হবে, ফাহিম কবিতা আবৃত্তি করবে। আমি অনুষ্ঠানে থাকব না, তাই বাসায় চলে যাচ্ছি, পথে দেখি ফাহিম আর একটা মেয়ে, ওর আবৃত্তি পার্টনার, একসাথে যাচ্ছে, ফাহিম পাঞ্জাবি আর মেয়েটা শাড়ি পরা, ওদের হাতে ডেকোরেশনের জন্য ফুল। হঠাৎ নিজেকে আমার একটা গাধা মনে হতে লাগল, কি ভেবেছিলাম আমি? পড়াশোনা করলেই সব হয়? সারাজীবন শুধু লেখাপড়াই করে গেছি... কিছুই শিখিনি। আমার মত ঘরকুনো মেয়েকে দিয়ে কি হবে? ফাহিম কেন চাইবে আমাকে? আমার জীবনে এক্সাইটিং এমন কি আছে?
সেদিন বোকার মত ভেবে বসলাম, যে করেই হোক, নিজেকে ফাহিমের চোখে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে... এমনভাবে, যে ও শুধু আমাকেই চাইবে। বোকা, জেদি রামছাগল আর কাকে বলে!
আমি তখনও জানিনা, ফাহিম প্রতিটা মেডিকেলের প্রতি ব্যাচে থাকা সেই ত্রাস, যারা গাঁজার ধোঁয়ায় বসে রাজনীতির চর্চা করতে করতে পাঁচ বছরের MBBS পাশ করে ফেলে।
আমি আরও জানিনা, সহপাঠী পিউ'র সাথে ততদিনে ওর "আনফিসিয়াল অ্যাফেয়ার"(!!) চলছে। যখন জানলাম তখন ধাক্কাটা এমনভাবে লাগল যে কি বলব! কারন একেতো পিউ আমার স্কুল-কলেজের ১২ বছরের সহপাঠী, তার ওপর সবাই বলতে লাগল, ওদের রোমান্স নাকি শুরুই হয় সন্ধ্যার পর, হোস্টেলের পাশের মাঠে, লাইব্রেরির কোনায়, আর টং দোকানের পিছে!
ব্যাপারগুলো বিশ্বাস করতে এবং মেনে নিতে আমার এক বছর সময় লেগেছে। এই এক বছরে কোন যুক্তি দিয়েই নিজের মনকে বোঝাতে পারিনি, শুধু পিউ হতে চেয়েছি, প্রতিদিন ক্লাসে পিউ'র দিকে তাকিয়ে ভেবেছি, ওর কি আছে, যা আমার নেই! একবারও ভাবিনি, আমার পিউ হওয়ার দরকার নেই, আমি আমার মত ভাল, পিউ ওর মত ভাল। অন্তত একদিক থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম, ফাহিম কে আর ফেস করতে হতনা, নেতা বড় ভাইদের পথ অনুসরণ করে ও বহু আগেই ক্লাসে আসা বন্ধ করেছে।
ফাহিমকে আমি কোনদিনই ভালবাসিনি, সাময়িক একটা ভাল লাগা ছিল, যেটা ওই বয়সে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার, কিন্তু যুক্তি দিয়ে বিচার করার বদলে নিজের বোকামি আর জেদের কারনে একটা বছর অদ্ভুত কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হল, এখান থেকে আমি কিছুই শিক্ষা নেইনি। এই ঘটনা থেকে recover করার আগেই আরেকটা সম্পর্কে ঝাঁপিয়ে পরেছি, সেটা এর চেয়ে অনেক বেশি কষ্টদায়ক আর অপমানজনক ছিল, শেষও হয়েছে অনেক ভয়াবহভাবে, দুটোর মধ্যে পার্থক্য একটাই, এক্ষেত্রে আমার ভাললাগা বা তথাকথিত crush নয়, সত্যিকারের ভালবাসাই ছিল। আর সন্দেহ হয়... এই ভালবাসা হারানোর কষ্ট হয়ত আমি কোনদিন ভুলতে পারব না।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৩:০২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




