ধারাবাহিক উপন্যাস নগ্নবেলা কিস্তি-১
ধারাবাহিক উপন্যাস নগ্নবেলা কিস্তি-২
ধারাবাহিক উপন্যাস নগ্নবেলা কিস্তি-৩
নগ্নবেলা কিস্তি-৪
নগ্নবেলা-৫
কিস্তি-৬
রাত প্রায় ১২টা। সকলে যে যার মতো বিছানায় যায়। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ঝুম পড়ে থাকে অহনা। উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তার পাহাড় ভিড় করে। একা হয়ে যাওয়ার পর পুরো রুমটি অস্তিত্বের অপরিহার্য একটি অংশ হয়ে দাঁড়ায়। যেন কসাইয়ের রাম দা’য়ের নিচে পুরো দেহ। আপন মনে খণ্ড খণ্ড মাংসের টুকরোয় পরিণত হওয়া। ডাস্টবিনে পড়ে থাকা উচ্ছ্বিষ্ট দখলে নিতে কাক কুকুরের টানাটানি। শূন্য বৃত্তের মধ্যে অহনার ভারহীন দেহ পাক খায়, আছড়ায়। রাত ক্রমশ বাড়ে। অথচ চোখে ঘুম নেই। ঘুম কোথায় গেল।
আয় আয় চাঁদ মামা ঘুম দিয়ে যা। চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা। উড়কি ধানের মুড়কি দিবো, কালো গরুর দুধ দিবো। দুধ খাওয়ার বাটি দিবো। চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা।
ঘুমের দেখা নেই। ঘরে এক শ’ ওয়াটের বাল্ব জ্বলছে। একবার অহনা ভাবলো বাতি নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে দেখলে কেমন হয়। যদি ঘুম আসে। পরক্ষণেই অন্ধকারে একা ভেবে বুকের ভেতরটা আৎকে ওঠে। অন্ধকার তার খুব ভয়। বিয়ের পর পারভেজের সঙ্গে তিন মাস অন্ধকার রুমে ঘুমিয়েছে। জীবনে ওই পর্যন্ত। আজ সাহসের বুকে পা রেখে উঠে দাঁড়ায় অহনা। বাতি নিভিয়ে দেয়। চারপাশে যখন পুঞ্জীভূত অন্ধকার। সামনে, পেছনে সর্বত্রই কালো আর কালো। তখনই বেজে ওঠে ফোন। রিসিভ করে হ্যালো বলতেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে নিপুণ।
আপু ঘুমিয়েছিস?
কে, নিপুণ?
হ্যাঁ।
কি হয়েছে?
একটা কথা ছিল?
আয়, বাল্বটা জ্বালাতে পারবি?
পারবো।
বাতি জ্বালিয়ে অহনার খাটের কোণায় এসে বসে নিপুণ। অহনা উঠে বসে।
কিরে নিপুণ, কি হয়েছে? এতরাতে কি ব্যাপার?
আপু একটা কথা।
কি কথা বল।
কথাটা বাবাকে কিভাবে বলি...
কথাটা কি?
তুই যদি আমার হয়ে একটু বলে দিতি।
কিন্তু কথাটা কি তা আগে বল।
এছাড়া কোন উপায় দেখছি না।
কি হয়েছে আগে বল।
আচ্ছা তুই-ই বল, আমার মতো একটা ছেলে কতদিন আর এভাবে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো?
আহা নিপুণ কি বলতে চাইছিস সেইটা বল।
আমার একটা চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে। এই দেখ এপয়েন্টমেন্ট লেটার।
সে তো খুব ভাল কথা। খবরটা বাবাকে দিয়েছিস? বাবা খুব খুশি হবে।
কিন্তু...।
কিন্তু কি? ইস এমন খুশির একটা খবর কিভাবে চেপে রেখেছিস? পেটে গ্যাস হচ্ছে না? তুই বস, আমি আগে বাবা-মাকে খবরটা দিয়ে আসি। তারা খুব খুশি হবে।
ছুটে যাচ্ছিল অহনা। হাত ধরে থামালো নিপুণ। বললো-
খুশির খবরটা বাবা-মাকে দিতে হলে এক লাখ টাকা লাগবে।
বুকের ভেতরে একটা ধাক্কা খেলো অহনা। বললো-
মানে!
হ্যাঁ আপু, এক লাখ টাকা দিলে আগামী সপ্তাহে চাকরিটাতে জয়েন্ট করতো পারবো। আদারওয়াইজ...।
শরীরের রক্ত হিম হয়ে আসে অহনার। সে খাটের কোণায় বসে চুপ করে। ভাই-বোন কারও মুখে কথা নেই। কিছুক্ষণ নিরবতার পর অহনা বললো- নিপুণ, তুই শুতে যা। এ বিষয়ে তোর সঙ্গে আমি সকালে কথা বলবো।
আপু টাকা না পেলে...
নিপুণ, তুই তো সব জানিস। বাবা এত টাকা কোথায় পাবে।
তাহলে...
তুই এখন যা। ভেবে দেখি কি করা যায়।
নিপুণ চলে যাচ্ছিল। তাকে ডাকল অহনা। বললো- নিপুণ চাকরির কথাটা বাবা-মাকে বলিস না। তারা খুব কষ্ট পাবে। ভেবে দেখি কি করা যায়।
ফোন রিসিভ করা ছিল। কানের কাছে ফোন ধরে হ্যালো বলতেই অপর প্রান্ত থেকে বললো- এক লাখ টাকা কোন ব্যাপার হলো। তুমি চাইলে টাকাটা আমি দিতে পারি।
কে বলছেন?
আহাম্মক।
আপনি আবার ফোন করেছেন?
সকালে ঘুমের ঘোরে নম্বরটা বলো নি। এখন বলো- কত নম্বর আহাম্মক আমি?
বিকালে আপনি ফোন করেছিলেন?
সরি, সরি। কান ধরে বিশবার ওঠবস করেছি। আর কোনদিন বিকালে ফোন দেবো না। মাফ করে দিও।
এখন ফোনটা রাখুন। আমি ঘুমাবো।
সেকি কথা। আমাদের কথা ভেবে রাত ১২টার পর থেকে ফোন কোম্পানিগুলো কত বাহারি অফার দিয়েছে। অথচ তুমি কিনা...!
আচ্ছা আপনার জন্য কি ঘুমাতেও পারবো না?
মিষ্টি করে দু’একটা কথা বলো আমি ফোন রেখে দেবো?
এত মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হবে।
ভুল বললে। মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয় না। ডায়াবেটিস হলে মিষ্টি খাওয়া যায় না।
ডাক্তারিও জানেন দেখছি। আচ্ছা আপনি কে বলুন তো?
আমি কে এ প্রশ্নটা দয়া করে করবে না।
কেন?
আমাকে তুমি চেনো। তবে জানো না।
মানে?
দেখলে তুমি আমাকে চেনো। কিন্তু ফোনে আমি কে তা জান না। আর যেদিন জানবে আমি কে? সেদিন থেকে তোমাকে আর ফোন করবো না। আচ্ছা রাখি। সকালে তোমার কাস আছে আর আমারও। খোদা হাফেজ।
বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে এপাশ-ওপাশ করে অহনা। ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টা। অনেক রাত অব্দি ঘুম না আসা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। রাজ্যের কথা ইতিউতি করে মনে।
পারভেজ এখন কি করছে? প্রতি রাতে ফোন করে সে। ফোন এ সময়েই আসে। তবে আজ আসছে না কেন? সকালে কাস। যে করেই হোক বিবিএ-টা পাস করতে হবে।
পাশে পড়ে থাকা কোল বালিশটা বুকে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে অহনা। মায়ের কথা মনে পড়ে। মা বারবার জানতে চান- জামাই কিছু বলেছে? নিপুণের ব্যাপারে কতটুকু কি করতে পারলো? নিপুণরে নেয়ার ব্যবস্থা করতাছে তো?