আমি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম, বলে কি এই ছেলে!আবার বললো, হাতটা ধর।
- না, তুই চলে যা।
- পরে কিন্তু আফসোস করবি।
- করবোনা।
- হুমম, যে চোখে কাজল দেয়া ফরজ সেই চোখ আমার সর্বনাশের কারণ। থাক তুই, গেলাম।
এই বলে লম্বা পা ফেলে এলোমেলো চুলের গেরুয়া পাঞ্জাবি পড়া সন্ন্যাসীর মত ছেলেটা আমার পাশ থেকে উঠে চলে গেলো। আমি চুপচাপ বসে দেখলাম, চোখের দীঘিতে পানি টলমল করছে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। ভাগ্যিস ওয়াটার প্রুফ কাজল দেই চোখে নইলে সপ্তাহে ৩/৪টা কাজল লেগে যেতো।
হাতটা ধরতে পারতাম, অমির হাত সেভাবে কখনোই আমার ধরা হয়নি। কিন্তু আজ ডক্টরের কাছে যেতে হবে, তাই ধরা হলোনা, হবে কি না তাও জানিনা....!
ডক্টরকে দেখতে বদরাগী লাগছে, আমি মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছি, হঠাত্ করে সে বলে, "আপনার লজ্জা করেনা?"
আমি ডক্টরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম, এই মধ্যবয়স্ক লোকটা আমাকে কি বোঝাতে চাইছে তা আমার মাথায় ঢুকলো না ।সে আবারো বললো, আপনার শরীরে যে ব্লাড নেই এ নিয়ে আপনার লজ্জা করে না?
আমি আমার স্বস্তির নিঃশ্বাস গোপন করে হাসিহাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। রক্তহীন আমার শরীরটাকে ভ্যাম্পায়ারের সাথে তুলনা করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, ভ্যাম্পায়ারের মত আমিও এর ওর রক্ত ধার করে বেঁচে আছি, প্রতিমাসে কোন সহৃদয়বান ব্যাক্তি আমাকে রক্তদান করে থাকে। তাই এটা নিয়ে ওরকম কিছুই বলার নেই। বের হয়ে মেঘলা আকাশ দেখে বাসায় ফেরার জন্যে রিকশা নিয়ে নিলাম, যদিও এমন আবহাওয়ায় কারো হাত ধরে রিকশায় ঘুরতে ভালো লাগার কথা। ইচ্ছে ছিলো যদি কখনো বিয়ে করি বরকে মার্সিডিজের জায়গায় একটা রিকশা কিনতে বলবো, হাঃ হাঃ হাঃ!
কেউ একজন ভাবতেই অমির নাম চলে আসে কেমন করে যেনো। আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি ছেলেটা আমার ভেতরটা জুড়ে বসে আছে। ওর কথা ভাবতে ভাবতে আকাশদেবী অশ্রু বিসর্জন শুরু করে দিলেন, আমি ভিজতে লাগলাম...
আমার জীবনের দৈর্ঘ্য খুব বড় নয় মাত্র ২২বছর, ২২বছরের অধিকাংশ সময় আমি ব্লাড আর থেরাপি নেওয়ার উপর দিয়েই কাটিয়ে দিলাম। অসুখটার নাম না হয় আপাতত নাই বা বলি আসলে কাউকে বলতে ভালো লাগেনা, মানুষের চোখে করুণার দৃষ্টি আমার সহ্য হয় না। আমি একটা অন্যরকম জীবনযাপন করি অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক, মানুষ তার মৃত্যুর ব্যাপারে অনিশ্চিত কিন্তু যখন কাউকে তার মৃত্যুর সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয় তার কাছে প্রতিটা দিন ভীষন হুল্লোড় করে বেঁচে যাওয়ার মত। যেমনটা আমি, প্রতিটা দিনকে ভীষন রকম ভালোবেসে শেষটুকু বাঁচতে চাই!
অমি মানে অমিত ভার্সিটির বন্ধু আমার, প্রথম দেখায় ছেলেটাকে আমার একদমই পছন্দ হয়নি। পাঞ্জাবি পড়া একটা ছেলে সারাক্ষণ খুব হৈচৈ করে আর মাঝে মাঝে ভয়ানক নির্লিপ্ত, ব্যাপারটা কেনো জানি আমার সহ্য হতো না। একদিন হুট করে ক্লাসের সকল মেয়েদের হাতে একটা পোস্টার ধরিয়ে দিলো, খুলে দেখা গেলো একটা বাংলা সিনেমার পোস্টার 'ভালোবাসা দিবি কিনা বল'। মেজাজ তিরিক্ষি করে ওর সামনে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম এসবের মানে কি। ও আমাকে বলে, দ্যাখ ভালোবাসা দিতে না চাইলে নাই কিন্তু এমন ভাবে রেগে তাকাইসনা। ভ্রু-প্লাক করিসনাই তো কপাল কুচকে তাকালে বিশ্রী লাগে'
আমি এতটা হতভম্ব হয়ে গেলাম যে ঐখান থেকে নড়তে পারছিলাম না ওর কথা শুনে। অমিত আমার সামনে শিস্ বাজাতে বাজাতে চলে গেলো...
ঐদিনের পর আমার অমিতের সাথে ভাব হয়ে গেলো, সেইরকম অবস্থা কেউ কাউকে ছাড়া থাকিনা, বন্ধুত্বর যদি কোন সংজ্ঞা লাগতো আমাদের দুজনকে দেখিয়ে দিলেই চলতো। একসময় আমরা একটা গ্রুপ হয়ে গেলাম। আমি, সাদিয়া, আশা, অমিত আর তূর্যের গ্রুপটা ক্যাম্পাসের সবচে হাড়বজ্জাত আর চেনা গ্রুপ হয়ে উঠলো দিনে দিনে। বন্ধুত্বের পর পরেরই ঘটনা, রাত ১১টার দিকে অমিত হাজির। আম্মু এসে বললো, অমিত আসছে, মনে হয় অসুস্থ, তুই ওকে যেতে দিসনা আমি গেস্ট রুম ঠিক করছি। আমি ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখি চোখটোখ লাল করে ও বসে আছে, পাশে বসতেই অমিত বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, গাঁজা খাইছি মাথায় অনেক ব্যাথা , তোর কোলে মাথা রাখবো।
সেদিন সারাটা রাত কোলে ওর মাথা রেখে সোফায় বসে রইলাম। ছেলেটার চুলে আলতো করে হাত বুলাতে বুলাতে একরাতের মাঝে একটা মায়া গ্রাস করলো ওর প্রতি!
ক্লাসের মাঝে অমিতের কবিতা লেখার আর গান গাওয়ার জোরে মেয়েদের কাছে অতি প্রিয় হয়ে উঠলো। ফ্লার্ট করতে যাওয়ার আগে তার মনে পড়তো, উফ্ আজ ত্রপার সাথে বই কিনতে যাওয়ার কথা বলেই দৌড়ে বান্দা হাজির। একসাথে ঘুরতে ঘুরতে গ্রুপের মাঝে তূর্য আর আশার প্রেম হয়ে গেলো, একটা গ্রুপে কাপল থাকা যে কি যন্ত্রণার! সারাক্ষণ লুতুপুতু কাহিনী দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে উঠলাম আমরা। আশা মাঝে মাঝে টিপ্পনি কেটে বলতো, তোর আর অমিতের কবে হবে? আমি হাসতাম। অমিত কেনো আমার কখনোই কারো সাথে কিছু হবে না।
অমিতের বন্ধুত্বে মায়ার পরিমাণ এতটা বেড়ে চললো যে, বিভিন্ন পকেটে টাকা গুজে রাখা ছেলেটার ওয়ালেট অথবা চাবির রিং প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো আমি কিনে দিতাম। অমিতও কম যেতো না...কিন্তু সমস্যাটা হলো তখন যখন অমিত টকটকে লাল গোলাপসহ একটা চিরকুট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেলো।
ঐদিন ও আমার চোখে কাজল ছিলো, কিন্তু চোখের পানিতে সব ধুয়ে গেলো চিরকুট পড়ে। এভাবে আমি যে কাউকে জড়ানোর ক্ষমতা বহু আগেই হারিয়ে ফেলেছি, আমার বাঁচার নিশ্চয়তা নেই যেখানে সেখানে কি করে আরেকজনকে জড়াই? বাসায় ফিরে না গিয়ে হসপিটালে চলে গিয়েছিলাম, থেরাপি নেয়ার তারিখ ছিল আমার....
ভার্সিটিতে এসে দেখি অমিত অসম্ভব কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ওর পিঠে একটা থাপ্পড় মেরে বললাম, গার্লফ্রেণ্ড পাইছিস? ও আমার সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে প্রথমে অবাক, চোখে মুখে একটা বিরক্তির ছাপ ফেলে চলে গেলো।
এভাবে ভার্সিটির ৩টা বছর কিভাবে যেনো পার করে দিলাম, না আমি অমিতের চিরকুটের কোন উত্তর দেইনি। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতে যখন অনুভূতিগুলো বুঝতে শুরু করলাম আচমকা টের পেলাম আমি অদ্ভুত ভাবে অমিতকে ভালোবেসে ফেলেছি!
কোন কিছু আর আগের মত নেই আমার উপহার দেয়া ওয়ালেটের জায়গায় অমিতের হাতে নতুন ওয়ালেট আমাকে সেটা জানান দিলো। আমি চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকানোর পর অমিত লাজুক হেসে বললো, সাদিয়া দিয়েছে। সবকিছু বদলাতে লাগলো পাঞ্জাবি ছেড়ে অমিত টিশার্ট ধরলো, সাদিয়া তার সবচে অপ্রিয় রঙ এর পোশাক পড়ে আসতো অমিতকে খুশি করতে। একেকটা দিন কাটতো, আমি ঈর্ষায় পুড়তাম। ক্লাসমেটের প্রেমে পড়ার যন্ত্রণা অসহ্যকর, চাইলেও এড়িয়ে যাওয়া যায় না, প্রতিদিন দেখা হবেই। অথচ এই ভয়েই ভালোবাসি কথাটা বলিনি ওকে, যদি একবার অমিত না বলে দেয় আমার ভার্সিটি লাইফ পুরাই নরক হয়ে যাবে। আমি অমিতের চোখে সাদিয়ার জন্য মুগ্ধতা খেলা করতে দেখতাম, আমার সবকিছু ভয়ানক বিষাদময় হয়ে উঠলো। আমি সহ্য করতে পারছিলাম না আর কোন কিছু। সীমা অতিক্রমটা করলো যখন পিজ্জাহাটে খেতে গিয়ে সাদিয়া এনাউন্স করলো অমিত আর সে এখন একে অন্যের, They are in a relationship!
আমি ওয়াশরুমে গিয়ে কেঁদে আসলাম, ওয়াটারপ্রুফ কাজল নোনা জলে কিছুই হলোনা। ফিরে আমি হাসতে হাসতে ওদের সাথে গল্প করতে লাগলাম।
বাসায় ফিরে আমি দরজা লাগিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম, আমার চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো। ভেতরটা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেলো, মনে হচ্ছিলো তীব্র একটা ব্যাথা আমাকে শেষ করে দিবে। এগিয়ে টেবিলটার কাছে গেলাম, ডায়রি খুলে পুরোনো চ্যাপ্টা গোলাপটায় হাত বুলাতে বুলাতে ঝরঝর করে কেঁদে দিলাম। চিরকুটের কাগজটা ৩বছরে অনেকখানি হলদেটে, বিবর্ণ হয়ে গেছে গোলাপটার মত। গোলাপটা আর চিরকুট একসাথে দিয়েছিল অমিত আমাকে, চিরকুটটা খুলে আবার পড়তে লাগলাম,
"ত্রপা,
আমি তোর চোখের মধ্যে বাস করি- এ কথা আমার সকল সৃষ্টিছাড়া অক্ষরের গায়ে লেখা থাকে , বুজে গেছি আশ্চর্য সন্ধ্যায় দৃষ্টি এবং দৃশ্যেকল্পের আঙুলে বকুল ফোটাতে গিয়ে! কিন্তু পাশেই পড়ে থাকে ধূসর সন্ধ্যার উপাখ্যান, উপাখ্যানের ভেতর ভেঙ্গে পড়ে শীতঘুম। আশ্চর্য রোদ শীতঘুম ভেঙ্গে চোখের কাঁখে।
তোর চোখে কি আছে কোন হাওয়ামেঘের ডানা? বাচাল হাওয়া মেঘকে আদর করে কাছে টানব, গল্প হবে বৃষ্টি এবং কদম ফুলের প্রেমের। খুনসুটি হবে বৃষ্টির চুলে মাখা আদরে। অন্ধকার আঁকা কি তোর চোখের কালোয়? নির্জন অন্ধকারে কি ডেকে যায় কোন ডাহুক, প্রাচীন কোন অতৃপ্ততা নিয়ে? ঐ চোখে আমার ঘর, আমার বসন্তদিন, সুখপোকাদের মায়াবী চাদর। চোখের প্রান্তরের ঐ অন্ধকার চিনিনা।
সারাবেলার নৈঃশব্দ্যের অসুখ তোর চোখে। দীর্ঘশ্বাস বুনে যায় নিষ্পলক, একঝাক রাজহাঁস বসে থাকে এখানে, সকল অসুখ ডানা মেলে উড়ে যায় চোখের গভীরে আরণ্যক নির্জনতায়, শুন্যতার পলেস্তার ভালোবাসায় খসে পড়ে!
মূলত আমার মাথায় ঘটে যায় এইসব-তোর কাজল চোখের মধ্যেই সমস্ত বিষাদ নিয়ে ডুবে যেতে চেয়েছি!
- অমিত "
চিরকুটটা বুকের সাথে চেপে ধরে রাখলাম আমি, চোখ দিয়ে অবিরত পানি পড়ছে। ৩টা বছর আগে আমি এই চিরকুট আর লাল গোলাপের কোন জবাব দিইনি ওকে, তবে আজ কেনো এত লাবণ্য বিলাপ? ঘড়ির দিকে তাকালাম, সময় রাত ৩.১৫। বাইরে ঝড়ের তাণ্ডব আর ভীষন বৃষ্টি, আমি চুপিচুপি ছাদে উঠে গেলাম। আষাঢ় মাসে জন্মেছি বলেই হয়তো বৃষ্টির প্রতি এক অন্যরকম টান অনুভব করি সবসময়, তাই রাত ৩টা বাজেও বৃষ্টির ডাক উপেক্ষা করার মত ক্ষমতা নিয়ে আমি পৃথিবীতে আসিনি। হাটুতে মুখ গুটিশুটি মেরে ছাদের এক কোনায় বসে রইলাম, দমকা বাতাসে বৃষ্টির বড় ফোঁটাগুলো শেলের মতে বিঁধছে আমার শরীরে। আমার ব্যাথা হৃদয়ের এ কোন থেকে ও কোনে ছড়িয়ে গেলো, পুরো ভেতরটা জুড়ে তাণ্ডব চলছে আমার। ছাদে শুয়ে পড়লাম, আমার চোখের পানি গড়িয়ে বৃষ্টির সাথে মিশে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে চোখ বুজলাম। আমার কাজল চোখে সমস্ত বিষাদ নিয়ে ডুবে যাওয়া মানুষটি আর আমার জন্যে নেই.....!
পরিশিষ্ট : পরেরদিন বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ছাদে ত্রপার নিথর দেহটি পাওয়া যায়। শীতল দেহটির হাতের মুঠোয় অস্পষ্ট একটা কাগজ ছিল যার লেখা কালি বৃষ্টি আর ত্রপার চোখের জলে মিশে ছিল...
(কবিতাটার জন্য স্পেশালি থ্যাংকস ব্লগার প্লিওসিন অথবা গ্লসিয়ার। কবিতাটা না থাকলে হয়তো গল্পটা পূর্ণতা পেতোনা।
গল্পটা আড়াইমাস ধরে লিখেছি কেটেছি, লিখেছি আর কেটেছি, শেষ হয়েছে প্রায় ২দিন হলো। যখন শেষ হলো ত্রপার তীব্র ব্যাথা আমাকেও গ্রাস করেছে এবং আমি লাবণ্য বিলাপ করেছি। )
প্রথম প্রকাশঃ সচলায়তন
তারিখ: সোম, ০৮/২৭/২০১২ - ৭:৪৩অপরাহ্ন