somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্পঃ ত্যাগ

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৪ সকাল ১০:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রিলিফের চাল নেবার জন্যে লাইনে দাঁড়ালাম। যমুনার ঠিক পাশে আমাদের গ্রাম। গেলবারের বন্যায় অনেকেই বাড়ি জায়গা জমি হারিয়েছে, তারপর থেকে কিছু দিন পর পর সরকারি লোক এসে লিস্ট করা কিছু মানুষকে চাল দিয়ে যায়। একটা দাগটানা খাতা নিয়ে শার্ট প্যান্ট পরা একজন আমার দিকে তাকিয়ে বলল “এইটা কে? এই ছেলেকে তো আগে কখনও দেখিনি। এই তোমার নাম কি?”
শার্টের হাতায় নাকের অইগুলা মুছে যেই নামটা বলতে যাব ওমনি কই থেকে কে যেন বলে উঠলো, “স্যার ওইটা কানীর ব্যাটা”।

আমার মায়ের এক চোখ নেই। এজন্য আমাকে এলাকার সবাই ডাকে কানীর ব্যাটা বলে। তখন আমার খুব লজ্জা লাগে, আর কারও তো এই নাম নাই, সবার যার যার নাম, শুধু আমার নাম ”কানীর ব্যাটা।“ মার ওপর আমার তখন খুব রাগ হয়, ঘৃণা হয়। আমার বাবা নাই, যুদ্ধের সময় মারা গেছে। মা অন্য মানুষের বাড়িতে ঘুরে ঘুরে কাজ করে। সেইটা নিয়ে আমার কোন কষ্ট নেই। কিন্তু মায়ের একটা চোখ নেই, আর এ জন্যে আমার নাম “কানীর ব্যাটা”, এটা আমি সহ্য করতে পারিনা।

হাইস্কুলে ভর্তি হবার দিনটা ভোলার মত না। আমি মাকে অনেক বার বলেছিলাম মা তুমি আমার সাথে যেওনা, কিন্তু মা আমার কথা শোনেনি। মাকে স্কুলের গেটে রেখে আমি দৌড় দিয়ে মাঠের অন্য ছেলেগুলোর মাঝে মিশে গেলাম। কিন্তু ততক্ষনে যা হবার হয়ে গেছে। কয়েকটা ছেলে দেখে ফেলেছে যে আমার মায়ের এক চোখ কানা। দুপুরের মধ্যে সারা স্কুল জেনে গেল। এই লজ্জাটা বলার মত না, আমার মনে হল আমি মাটির সাথে মিশে যাই।
বাসায় ফিরতেই মা আমার দিকে দৌড়ে আসল, চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,”পরথম দিন কেমুন হইল বাজান?” মাকে বললাম,”তোমারে কত বার কইলাম তুমি যাইওনা আমার সাথে, তুমি তাও গেলা! তোমার যে চোখ নাই এইটা এখন স্কুলের সবাই জাইনা গেছে। সবাই আমারে কি বইলা ডাকে জান? কানীর ব্যাটা! আমার মনে হয় আমি মইরা যাইনা ক্যান?” ভেবেছিলাম মা রেগে যাবে, কিন্তু মা কিছুই বলল না, শুধু মুখের হাঁসিটা আস্তে করে মিলিয়ে গেল। আমারও যে একটু খারাপ লাগলো না তা না, কিন্তু তারপরেও মাথার ভিতরটা হাল্কা হয়ে গেল। অনেক দিন ধরে কথাগুলো জমা হয়ে ছিল।

ওই দিন রাতে খুব তেষ্টায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। উঠে কলসি থেকে পানি খেতে গেলাম। হুট করে খেয়াল করলাম মা দরজার খিলানে বসে বসে কাদঁতেছে, খুব আস্তে, খেয়াল না করলে বোঝা যাচ্ছেনা তেমন একটা, হয়ত আমার ঘুম ভেঙ্গে যাবে এজন্যে। চাঁদের আলোতে দেখা যাচ্ছে তার এক চোখ দিয়ে পানি পড়ছে আর আরেক চোখ শুকনা, গভীর একটা কালো গর্ত। দেখেই কেমন জানি আমার বীভৎস লাগলো। আমি পানি না খেয়েই আবার শুয়ে পরলাম।

আমাদের টাকা পয়সা নাই, অনেক গরীব এই জিনিসটা আমি সহ্য করতে পারতাম না। বুঝতে পেরেছিলাম এই অসহনীয় অবস্থা থেকে বের হতে চাইলে আমাকে পড়াশোনা করতে হবে অনেক, আমি পড়াশোনা করতামও। কলেজে অনেক ভাল রেজাল্ট হল। ভাগ্যবশত একটা ভাল ভার্সিটিতে চান্সও পেয়ে গেলাম।

আমি গ্রাম থেকে শহরে চলে আসলাম। ভার্সিটির প্রথম দিন বিশাল মাঠের মাঝে নতুন ভর্তি হওয়া ছেলেমেয়ের মাঝে ঢোকার সময় জীবনে প্রথম বারের মত একটা ফিলিংস হল। মনে হল আমি মুক্ত। এখানে আমার কোন অতীত নেই। আমার সেই দুঃসহ ঘটনাটার মুখোমুখি হতে হবে না। সবাইকে বললাম আমার বাবা মা নেই, বড় হয়েছি চাচার বাসায়। জীবনে মনে হল প্রথম বারের মত আমাকে সবাই আমার আসল নাম ধরে ডাকল।
পরের দশটা বছর আমি আর বাড়ি যাইনি। গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করলাম খুব ভাল রেজাল্ট নিয়ে, মাস্টার্স করলাম। বিয়ে করলাম ভার্সিটিরই এক জুনিওর মেয়েকে। ছোট্ট একটা মেয়ে হল পরীর মত দেখতে, ঠিক তার মায়ের মত। জীবন এখন অনেক সহজ। বেসরকারি একটা প্রতিষ্ঠানে অনেক বড় চাকরি করি। পুরনো সেই জীবন এখন আমার কাছে ভুলে যাওয়া একটা দুঃস্বপ্নের মতই।

ঠিক এমন সময় এক ছুটির দিনে সকালে বারান্দায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি আর খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছি, হটাৎ কলিংবেলের শব্দ। আমার মেয়ে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েই একটা চিৎকার। সে চিৎকার করতে করতে ভয়ার্ত মুখ নিয়ে বাসার ভেতর ঢুকে গেল। আমি তাড়াতাড়ি দরজার কাছে গিয়ে দেখি ছেড়া নোংরা কাপড় পরে একজন বৃদ্ধা একটা বাঁশের লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে একটা ছেড়া কাগজের টুকরা, সেখানে একটা ঠিকানা লেখা। বৃদ্ধার ডান চোখের জায়গাটা কুৎসিত ভাবে কুঁচকে ভেতরে ঢুকে গেছে। আমার মা। পেছনে তাকিয়ে দেখি আমার বউ এসে দাঁড়িয়েছে। আমার মাথার ওপর পুরো আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। এত বছর ধরে আমি সবার মাঝে আমার যে নতুন পরিচয় তৈরি করেছি সেটা এক মুহূর্তে ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম। আমি চিৎকার করে বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে বললাম, “আপনি কে?এই বাসায় এসেছেন কেন?এই বাসায় কলিংবেল চাপার সাহস আপনাকে কে দিল? নিজের দিকে একবারও দেখেছেন? মেয়েটা আপনাকে দেখে কত ভয় পেয়েছে জানেন আপনি?”
মা কিছুক্ষন আমার দিয়ে চেয়ে থাকল, তারপর অঃফুস্ট স্বরে বলল, “আমারে মাফ করে দিও বাজান!” হাতের ছেড়া কাগজটার দিয়ে তাকিয়ে বলল, “ঠিকানাটা মনে হয় ভুল হইছে আমার।“ তারপর ঘুরে লাঠি ধরে ধরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল।
আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক মা চিনতে পারেনি। কিছুটা খারাপ লাগল, কিন্তু নিজেকে বোঝালাম বছরের পর বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা আমার এই নতুন জীবন নতুন পরিচয় রক্ষা করার জন্য আজেকের এই ঘটনাটা যত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়া যায় ততই ভাল।

তার কিছুদিন পর আমার সেই পুরাতন হাইস্কুল থেকে একটা চিঠি পেলাম, স্কুলের পঁচিশ বছর পূর্তি এবং আমাকে অনেক অনুরোধ করা হয়েছে আমি যেন যাই, আমাকে প্রধান অতিথি করতে চাচ্ছেন তারা। দেখা যাচ্ছে স্কুল থেকে বের হওয়া সবার মাঝে আমিই সবচে ভাল অবস্থানে আছি।
সিদ্ধান্ত নিলাম যাব। বাসায় বললাম বিজনেস ট্রিপ। তারপর চলেও গেলাম। স্কুলের অনুষ্ঠান শেষে কি জানি এক অজানা কারনে আমি পায়ে পায়ে হেঁটে গেলাম আমার সেই পুরনো বাড়ির দিকে। গিয়ে দেখি উঠোনে বুনো লতাপাতা গাছ জন্মে গেছে, দরজার একপাটি ভাঙ্গা, চালটা একপাশে ভেংগে হেলে পড়েছে। দরজার খিলান পার হয়ে ঘরের ভেতর ঢুকলাম, দেখি ভাংগা একটা খাটের পাশে আমার মায়ের নিথর শরীর মাটিতে ঝুকে পড়ে আছে, তার একটা হাত শক্ত করে দড়ি দিয়ে খাটের পায়ার সাথে বাঁধা। অন্যহাতে দোমড়ানো মোচড়ানো একটা কাগজ। হাতে নিয়ে ভাজ সোজা করে দেখি একটা চিঠি, আমাকে লেখা –
“খোকা, আমার মনে হয় আমার জীবনে আর খুব বেশি দিন বাকি নেই। আর কখনও তোর বাসার দিকেও যাওয়া হবেনা। অনেক দিনের জমানো টাকা নিয়ে গিয়েছিলাম, এখন সেটাও শেষ। আর যাওয়া মনে হয় ঠিক’ও হবে না। কিন্তু তোকে খুব দেখতে ইচ্ছা করে বাবা, বুকটা ফেটে যায়। তুই কি অনেক দিন পর হলেও আসতে পারবি আমার কাছে একবার করে? তোকে একটু চোখ ভরে দেখতাম!
আমি যে কত খুশি হয়েছিলাম যখন সবার কাছে শুনলাম তুই আসবি।আমার জীবন ফেটে যাচ্ছিল ছুটে তোর কাছে যেতে, তোর দুইটা হাত ধরতে, তোকে একটু ছুঁয়ে দেখতে। কিন্তু এই মানুষটা সবার মাঝে তোর কাছে গেলে কেমন করে হবে বাবা?তুই আবারো বড় বড় মানুষের সামনে অনেক ছোট হবি, লজ্জা পাবি। যদি নিজেকে সামলাতে না পারি এ জন্যে একটা হাত দড়ি দিয়ে খাটের সাথে বেঁধে রেখেছি।
খুব কষ্ট হচ্ছে বাবা, লিখতে পারছি না, শুধু নিজেকে বোঝাচ্ছি আমি তো তোর সাথেই আছি সবসময়।আমি না থাকি আমার চোখটা তো আছে। যখন তুই খুব ছোট ছিলি, তখন একটা দুর্ঘটনায় তোর একটা চোখ নষ্ট হয়ে যায়। মা হয়ে আমি এটা সহ্য করতে পারিনি যে আমি দুই চোখ দিয়ে এই রঙ্গিন পৃথিবী দেখব, আর আমার সন্তান বড় হবে এক চোখ নিয়ে।তাই আমার একটা চোখ তোকে দিয়ে দিই। আমি কিছু না দেখলাম, আমার সন্তান তো দেখবে, পৃথিবীর সব সৌন্দর্য, আমার হয়ে, আমার চোখ দিয়ে, আর কারো সন্তানের চেয়ে এতটুকুও কম না!
তোর ওপর আমার কোনও মন খারাপ নেই খোকা। তোর সেই ছোট্টবেলার কথাগুলো খুব মনে পড়ে। এই এততুকু ছিলি, সারাদিন আমার শাড়ি ধরে ধরে ঘুরতি, আমি একটু দূরে গেলেই মা মা বলে চিৎকার করে আমার বুকের মধ্যে এসে ঢুকতি...


আর পারছি না খোকা, বুক ভেংগে চুরমার হয়ে যাচ্ছে...... সেই ছোট্টবেলার তোকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে.........খুব............”




আমার মাথার ওপর পুরো আকাশ ভেঙ্গে পড়ল, পুরো পৃথিবী, আমার আমিত্ব ভেংগে গুড়োগুড়ো হয়ে গেল, আমি চিৎকার করে কেঁদে হাঁটু ভেংগে মাটিতে শুয়ে পরলাম, আমার সেই মানুষটা আর নেই, যে তার সারাটা জীবন বেঁচে ছিল শুধু আমার জন্যে...
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:৩১
১৩টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×