'মেয়েটা পাশের ঘরে আছে, যা'..
সাদির মুখ থেকে এই কথাটা আমার কানের ভেতর আসামাত্র মনে হল ভূমিকম্প হচ্ছে। একদিন কথার ছলে সাদিকে বলছিলাম 'আজ পর্যন্ত কোন প্রেম করতে পারলাম না,মাঝেমাঝে মনে হয় আমার সাথে কারুর প্রেম হবে না; তোদের মতো হয়ে যেতে পারলে ভাল হত। তোরা কি সুন্দর, মাথায় প্রেমট্রেমের কোন চিন্তাভাবনা নাই। আমার তো মেয়ে দেখলেই প্রেম করতে ইচ্ছা করে!'
আমার এধরনের কথা শুনে সাদি হাসতে লাগলো। আমি বললাম, 'হাসছিস কেন?' ও বলে, 'তোর কি ধারণা আমরা খারাপ?'
-নয়ত কি? দুইদিন পরপর কিসব আজেবাজে জায়গায় যাস!
আমাকে অবাক করে দিয়ে সে বলে, 'তুই যাবি নাকি? গেলে তোর জন্য সব ফ্রি!' শুনে বললাম 'কোথাও যাবনা আমি'। সে বলে, 'তাহলে মেসে নিয়ে আসি? কি বলিস?' কি মনে করে বলেছিলাম 'নিয়ে আয়' জানিনা।
'অন্তত প্রেমের ভূত তোর মাথা থেকে নামাতে হলেও নিয়ে আসব দেখিস। শহরের সবথেকে দামী মেয়েকে নিয়ে আসব তোর জন্য' সাদি ওর কথা রেখেছে। আমার অনুমতি পর্যন্ত নেবার প্রয়োজন বোধ করেনাই।
দুপুরের আগে আগে সাঈদের দোকানের বেঞ্চিতে বসে পত্রিকা পড়তেছিলাম তখন সাদির ফোন আসে। ভোরসকালে বৃষ্টি হওয়াতে স্নিগ্ধ পরিবেশ বিরাজ করছে চারপাশে। ফোনটা ধরে আমি বলি, 'নেতাসাহেব, এঈ সকাল সকাল ফোন দেয়ার কি কারন?' সাদি শুধু বলে 'দ্রুত মেসে আয়' বলেই লাইন কেটে দেয়। মানুষ যখন কোন প্রশ্ন শুনতে চায় না তখন এমন করে।
সাদির মেসের নাম 'প্লে হাউজ'। নামটা আমাদেরই দেয়া। এটা মূলত একটা পুরাতন করাতকল। ফাঁকা একটা জায়গা বহুবছর পতিত হয়ে ছিল। জমির মালিক রাস্তার পাশ ঘেঁষা দেয়াল বেশ মজবুত করেছেন, ভেতরদিকেও ভালোভাবে সীমানা প্রাচীর তুলেছেন। দামি লোহালক্কড়, সেঁওলা ধরা কাঠ রক্ষার্থে (?) দুইটা টিনের ঘর তুলেছেন। মালিক সাদির দুঃসম্পর্কিত মামা লাগে, ভাগিনা কলেজে পড়ে তাই থাকার বন্দোবস্ত (?) করেছেন। সাদি ওর বন্ধুদের নিয়ে মেস করেছে। মামার খরচে রান্নাঘর করেছে, আর আমাদের সেখানে দিনভর ক্যারাম খেলার ব্যবস্থা হয়েছে। দুই মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম প্লে হাউজে।
সাদির উপর কেমন উদ্ভটভাবে মেজাজ গরম হয়ে আছে অথবা অন্যকিছু। ওকে কিছু বলব কিন্তু বলতে পারছিনা। মনের ভেতর অন্যরকম উত্তেজনা অনুভব করছি যা আগে কখনওই হয়নি। মন বলছে ভেতর যাই আবার ভেতরদিকেও মন নিষেধ করছে। অতিরিক্ত স্নায়ুচাপে পীড়িত হয়ে যাচ্ছি।
সাদির ঘরের বারান্দাযুক্ত অংশে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর সাদি মুখোমুখি। ওদিকে রান্নাঘর থেকে কাজের বুয়া, ডাকনাম পারুল, আমায় দেখে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। সাদি আমার উপর বিরক্ত হচ্ছে। আমি পরিস্থিতি হালকা করতে গলা খাকিয়ে বললাম, 'ওই পারুল এক গ্লাস পানি দে!'
সাদি বলে, 'তুই যাবি? না আমি আগে যামু?'
আমি বললাম, 'তুই যাইস না, আমিই আগে যামু'
বলে নিজেই রান্নাঘরের দিকে গেলাম পানি খেতে। পারুল আমার দিক যেভাবে তাকিয়ে আছে তা দেখে বললাম, 'কি হইছে? নাকমুখ ব্যাকা কইরা ওমনে তাকাই রইছস ক্যান? ডাকতাছি শুনছ না?
-শুনি ত, দেখেন না ব্যস্ত আছি, কি কন?
-কিছুনা, কি রান্না করোছ?
-মুরগিরডিম। ভাইজান, ঐ রুমে ফাইন একটা মাইয়া আইছে? সাদি ভাই কইল ঐটা নাকি আপনার পেরমিকা?
আমি বললাম, 'তুই তর কাজ কর'
পানি খেয়ে চলে আসলাম। ছোটঘর থেকে রানা ও খোকন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে করতে আসলে আমি ঢোক গিললাম। আমারদিকে এগিয়ে রানা হাতে এক প্যাকেট কনডম ধরিয়ে দিল। আশ্চর্য! ইশারায় ক্রমাগত ঘরে যেতে বলতে লাগলো, যেন আমি বাধ্য!
মনে সাহস সঞ্চার করে আমি বললাম 'তোরা বের হ মেস থেকে, তোরা মেসে থাকলে এই কাজ আমি করতে পারবো না'।
খোকন বলে, 'আমরা ছোটঘরে আছি, কেউ তোকে ডিস্টার্ব করবে না'
আমি বললাম, 'তোরা বের হ, কাজ শেষ হলে আমি ফোন করব'।
একরকম জোর করেই ওদের মেস থেকে বের করে দিলাম। নিজের হাতে মেসের দরজা লাগালাম। আরেকবার গেলাম রান্নাঘরে পানি খেতে। গলাটা সত্যি শুকিয়ে এসেছে। পারুল নিজেই ফিল্টার থেকে পানি গ্লাসে ভরে হাতে দিল। তারপর সে কৌতূহলী হয়ে বলল, 'ভাইজান, এই মাইয়াতো ভালা না। নানা কিসিমের মানুষের লগে এর উঠাবসা'।
আমি একটা ধমক দিয়ে বললাম, 'তুই তর কাজ কর'।
সাদির ঘরে মেয়েটার কাছে গেলাম, দরজা লাগালাম। তখন বিছানায় মেয়েটি বসে সিগেরেট খাচ্ছিলো। তাকে চিনতে পারলাম। এর নাম বন্যা। সে বছর দুয়েক আগের কথা। বন্ধুদের সাথে সাথী সিনেমাহলে গিয়েছিলাম ঈদের ছবি দেখতে। বন্যাদের বাসার সামনেই সিনেমাহল। প্রস্রাব করতে বেরিয়েছি, দোতলা থেকে প্রথমবার বন্যাকে দেখলাম। প্রথম দেখাতে মুগ্ধ হওয়া যাকে বলে! তারপর দীর্ঘ ছয়মাস ওর পেছন পেছন ঘুরেছি। একটা মেয়েকে 'ভালোবাসি' এটা যেভাবে বুঝাতে হয় তার সবরকম চেষ্টা আমি করেছি। বুঝাতে চেয়েছিলাম আমি যে তাকে পছন্দ করি, ভালোবাসি এটা সে উপলব্ধি করুক। সে বুঝেছে ঠিকই কিন্তু পাত্তা দেয়নি। একদিন সন্ধ্যায় ঝুমবৃষ্টিতে কলেজমোড়ের রাকিব স্টুডিওর সামনে, রিক্সায় যাবার সময়, ওকে দেখে আমি নেমে যাই। ভিজতে ভিজতে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াই। ও হয়ত কারুর জন্য অপেক্ষা করছিল। একদম ওর চোখের দিকে তাকিয়ে সেদিন বলে ফেলেছিলাম 'ভালোবাসি'। পাশে দাঁড়ানো একটা রিক্সায় উঠে ও তখন চলে যায়। পরে জেনেছি স্টুডিও মালিক রতনের ছেলে রাকিবের সাথে ওর প্রেম ছিল।
বন্যার সামনে রাখা একটা চেয়ারে আমি বসলাম, বললাম 'কেমন আছো তুমি?'
সে একটা মুচকি হাসি দিল।
মেয়েদের সিগেরেট খাওয়ার দৃশ্য সত্যি অনেক বিশ্রী হয় সেদিন বুঝেছি। এমন সময় আমারও সিগেরেট খেতে ইচ্ছা করল, বন্যাকে বললাম, 'তোমার কাছে এক্সট্রা সিগেরেট হবে?'
ও বলল, 'না, আচ্ছা.. তুমি তাহলে আমাকে এনেছো?'
-তোমার হাতের সিগেরেটটা দাও, চেনার জন্য ধন্যবাদ
-এতো দেরি করলে কেন ভেতরে আসতে?
-কাপড় খুলো, বেশি কথা ভালো লাগছে না
-আগে সিগেরেটটা ত শেষ করো, তাড়াহুড়োর কিছুই নেই। আমাকে আজ সারাদিনের জন্য আনা হইছে
-কাপড় খুলতে বলছি, খুলো আমি দেখব
-তোমার বন্ধুদের আসতে বল, তোমার সামনে কাপড় খুলব না আমি
-কাপড় খুলবি না এর মানে কি?
-মানে কিছুনা! চুপ করে বস তুমি, এইভাবে কাঁপতেছ কেন?
লোকমুখে অনেকবার শুনেছি বন্যার পরিণতির কথা। কারন ঘাটতে ইচ্ছা করেনি, বিশ্বাস করতেও হয়নি। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। তারপর একহাতে হঠাৎ বন্যার হাত ধরলাম, ধরে থেকেই ওকে সাথে নিয়ে অন্যহাতে রুমের দরজা খুললাম। মেসের গেট খুলে দিলাম ওর চলে যাবার জন্য, বললাম 'তুমি এবার আসতে পার'। বলে রুমে চলে আসলাম, আর পেছন ফিরে তাকাইনি। পারুল সবকিছুই দেখল এবং সেইসাথে কিছুই বুঝল না।
বিছানায় বসে আছি, ঘামছি! পারুল কখন রুমে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। আমি বললাম..
'পারুল তোর বয়স কত?'
-কত আর, তেইশ -চব্বিশ হইব, ক্যান এই কথা জিগাইলেন ক্যান?
-না, এমনিতেই। তুই কি কিছু বলবি?
- হ বলতাম ত, গেইটটা লাগাই দ্যান, আমি চইলা যাইতেছি, রান্না শ্যাষ
- হুম.. তুই বলতো আমার বয়স কত হবে?
-কইবার পারুম না, দেইখা কি বুঝা যায়!
-জানিস, আমার বয়স চব্বিশ এবং আমি এখনও কোন মেয়ের সাথে শুইনাই। তুই কি আমাকে একটু তোরে ছুঁয়ে দেখতে দিবি, কিছুই করব না, শুধু তোকে একটু স্পর্শ করব!
-ভাইজান আমারে এইভাবে ছুঁইতে চাইয়েন না, একবার ছুঁইলে এর জ্বালা আপনে সহ্য করতে পারবেন না!