- তারপর রিনা, আজ তো বীনার বার্থ ডে, তাই না?
- হু।
- আমাকে ইনভাইট করবে না? এখনো কিন্তু সময় আছে, গিফট কিনে সময়মত পৌঁছে যেতে পারবো।
- ফোনে ইনভাইট করলে তোমার আতে ঘাঁ লাগবে না তো?
- না না, তা কেন?
- শোন, ওর জন্মদিনটা আনুষ্ঠানিকভাবে পালনের কোন প্ল্যান ছিল না, থাকলে অবশ্যই ইনভাইটেশন পেতে। তবে তোমাকে ফোন করলাম ইনভাইট করার জন্যই; কিছুক্ষণ আগে ভাইজান এসে হাজির, উইথ আ বিউটিফুল কেক! বুঝলে?
- বুঝলাম।
- আসবে তো?
- আসবো, অবশ্যই আসবো।
- আচ্ছা আজ মেডিক্যালে আসো নি কেন?
- একই প্রশ্ন তো আমিও করতে পারি!
- পার। তবে আগে তোমাকে উত্তর দিতে হব।ে
- তুমি নিজেই যাওনি, আর আমাকে প্রশ্ন করছো আমি কেন যাইনি! তবে অনুমান খারাপ না, আমি সত্যি যাইনি।
- অনুমান নয় মহাশয়, হৃদয়ের মিল।
- তাই নাকি?
- অবশ্যই। তা না হলে কি...
রিনার কথা শেষ হলো না, তার আগেই বীনা গটগট করে রুমে ঢুকে পড়েছে। রিনা অবাক হলো, একই সাথে রাগ হলো। ধমকে উঠলো, তোকে না কতবার বলেছি দরজায় নক না করে আমার রুমে ঢুকবি না।
- সরি, ডাক্তার আপু।
- তাড়াতাড়ি তোর জরুরী কথাটা বল।
কাঁদো কাঁদো স্বরে বীনা বললো, কানে মশা ঢুকেছে। একটা নয় দুটা।
- তাই কাঁদতে হবে, যা এখান থেকে।
- ডাক্তার আপু, কিছু একটা কর।
- আমার কিছু করার নেই, তিনার কাছে যা।
- আপু! কেঁদে ফেললো বীনা।
- কাঁদিস না বোন। আয় কাছে আয়। চোখ মোছ।
বীনা চোখ মুছতে মুছতে কাছে গেল। রিনা ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো, সাজেদের সাথে কথা বলবি? তোকে বার্থডে উইশ করতে চায়।
বীনা প্রচন্ড রেগে গিয়ে বেড়িয়ে গেল বড় বোনের রুম থেকে। তিনার রুমের দরজা বন্ধ। বীনা এক হাতে বাঁ কানটা চেপে ধরে আছে। খুবই কষ্ট হচ্ছে। তবে আপাতত রাগটাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। ডাক্তার আপু একটুও আগ্রহ দেখালো না! দরজার সামনে প্রায় দু'মিনিট "মেজ আপু" বলে চেঁচানোর পর তিনা দরজা খুললো।
তিনা সাজ-গোজে ব্যস্ত। ওর বন্ধু বান্ধবীরা আসবে, প্রায় সেভেনটি পার্সেন্ট বন্ধুদের ইনভাইট করা হয়ে গেছে। ওরা সবাই আসবে। কাজেই ভালভাবে সাজুগুজু করতে হবে। তিনার হাতে একটা লিপস্টিক। বললো, কী রে সৌভাগ্যবতী... বীনু সোনা!
আহ্লাদে গদগদ হয়ে বীনা কেঁদে ফেললো আবার। মেজআপু এত আদর করে অনেকদিন ডাকেনি। তাছাড়া মেজ আপুর মেজাজ তো সারা বছরই খারাপ থাকে।
- কী হয়েছে, বীনু সোনা, বলবি তো। ক্লাশ সেভেনের এত বড় একটা মেয়ে হয়ে তুই কাঁদছিস? বল তো কি হয়েছে?
- আমার বাম কানে মশা ঢুকেছে।
- হা হা হা, মশা?
- হাসবে না বলছি।
- আচ্ছা হাসলাম না। তো আমার কাছে কেন, বড় আপুর কাছে যা।
- ও তোমার কাছে পাঠিয়েছে।
- হা হা হা, ডাক্তার তোর অসুখ সারানোর জন্য পাঠালো আমার মতো একটা অপদার্থের কাছে! আমি তো আর এসব পারিনা। যা পারি তাই করবো। কি বলিস? ব্যথা পাচ্ছিস?
- হু, পাচ্ছি। ফরফর করছে।
- কানের ভেতরে মশা কামড়ায়নি তো?
- না, এখনো কামড় দেয়নি। তবে খুব লাফালাফি করছে।
- তা তো করবেই। আয় ভেতরে আয়।
- ভেতরে গিয়ে...
- তোকে একটু সাজিয়ে দেবো। আজ তোর জন্মদিন না? আমার বন্ধু বান্ধবিরা সব আসবে, আর আমার বোন হয়ে তাদের সামনে তুই কেক কাটবি ফকিরনির মতো? তা হবে না, আয় ভেতরে আয়।
বীনা কোন কথা না বলে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। তিনা খুব স্বাভাবিকভাবে দরজাটা বন্ধ করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসলো, যেন বীনার সঙ্গে ওর কোন কথাই হয়নি।
বীনা রান্নাঘরের দিকে গেল; মা এখন একমাত্র ভরসা। বাবা আর ভাইজান বাসায় নেই।
আয়েশা বেগম রান্না করছেন। দুপুর দুটো বাজে। এসময় জামিল তো কোন দিন আসে না! আজ কয়েকমাস পরে এলো, দু'চারটা ডাল ভাত খাওয়াতে হবে ছেলেকে। তবে ছেলেটা ভাল দিনে এসেছে, ছোট মেয়েটার জন্মদিন। ক'বছরে যে পড়লো... তেরো। জামিল একটা বেশ কাজের কাজ করেছে। সাথে করে একটা কেক নিয়ে এসেছে। বীনা ক'দিন থেকেই প্যান প্যান করছিল। জামিলের বাবাও রাজি হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু কী দরকার অকারণে টাকা খরচ করার। বড় অভাব চারদিকে। জামিলের বাবার পেনশনরে টাকা আর জামিলের ক'টা টাকায় টেনে টুনে সংসার চলছে। তিন মেয়ের পড়ার খরচ চালাতে হচ্ছে। এর মধ্যে অকারণে খরচ কেন বাবা? মেয়ে তো আর ছোট নেই এখন।
- মা। দরজার কোণে দাঁড়িয়ে ডাকলো বীনা।
আয়েশা বেগম দেখলেন বীনার মুখটা কেমন যেন মলিন। মায়ের মন কয়েক মুহুর্তের জন্য কেঁদে উঠলেও রান্নায় মন দিতে দিতে বললেন, কীরে বীনা?
- মা কানে মশা ঢুকেছে।
মুরগীর মাংসের পাতিলে বড় একটা চামুচ দিয়ে নাড়তে নাড়তে বললেন, কানে মশা ঢুকেছে? কোন কানে?
- বাম কানে।
- তোর বোনদের কাছে যা, ওরা বের করে দেবে।
- ওরা তো আমাকে পাত্তাই দিল না।
- ও।
- তুমি বের করে দাও না মা!
- আমি? দেখছিস না রাঁধছি। আমার হাত বন্ধ। ভাবিস না, এমনি এমনি বের হয়ে যাবে।
আবারো উপেক্ষিত হয়ে বীনা কাঁদতে চাইলো, কিন্তু এবার কাঁদলো না। আজকের সবার আনন্দটা ওর জন্য কিন্তু ও যে কষ্ট পাচ্ছে অথচ ওকে কেউ সাহায্য করছে না। সবার আনন্দটা মাটি করে দিতে হবে; কিন্তু কিভাবে?
কিছুক্ষণ পর বীনাকে দেখা গেল এক তলার ছাদের ওপর; হাতে একটা লাউড স্পীকার। লাউড স্পীকারটা ভাইজানের, উনি খুব শখ করে কিনেছিলেন। বীনা লাউডস্পীকারে মুখ রেখে বললো, ডাক্তার আপু, মেজ আপু, মা তোমাদের দৃষ্টি আকর্ষন করছি। তোমাদের দৃষ্টি আকর্ষন করছি। তোমরা তাড়াতাড়ি বাসার সামনে বেড়িয়ে এসো। নতুবা মজাটা মিস করবে। ডাক্তার আপু, মেজ আপু, মা...
রিনা, তিনা, আয়েশা বেগম সবাই একে একে এসে হাজির হলেন। একটু আগেও সবার চোখে বিরক্তি ছিল, কিন্তু এখন সবার চোখে আশ্চর্যবোধক চিহ্ন। কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। সবাই দেখছে বীনা ছাদের কোনে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আশে পাশের বাসা থেকে আরো কয়েকজন এসে একটা ছোট খাট জটলার তৈরী হয়ে গেছে।
বীনার এক হাত বাম কানে আর অন্য হাত লাউড স্পীকারে। লাউড স্পীকারটা মুখের সমান্তরালে এনে বললো, আজকের দিনটা তোমাদের সবার জন্য একটা স্মরণীয় দিন, কারণ আজ আমার জন্মদিন, তাই না?
- হ্যাঁ, বকবক না করে যা বলার বলে ফেল। বললো রিনা।
- বলবো তো অবশ্যই।
- জলদি বল হাতে অনেক কাজ আছে।
- কাজ তো থাকবেই। ঐ যে ভাইজান আর বাবা আসছে। ওরা আসুক, একটু অপেক্ষা কর। কারণ মজাটা একবারই হবে, দু'বার হবে না।
মোশাররফ আলী তার বাসার সামনে ভীড় দেখে থমকে গেলেন। তারপর ছাদে ছোট মেয়ে বীনাকেও দেখতে পেলেন। কে জানে পাগলীটা আবার কী শুরু করেছে! ভীড় ঠেলে ঝটপট সামনে চলে এলেন, বললেন, বীনা কী করছিস ওখানে?
- মজা দেখাবো বাবা। তুমিও দেখবে। তবে তার আগে শানে নুযূলটা বলি, নয়তো মজা পাবে না। বলবো?
ক্লান্তিভরা কন্ঠে মোশাররফ আলী বললেন, বল।
- শোন তবে। আমার বাম কানে মশা ঢুকেছে, মনে হয় দুইটা। আমি খুব ব্যথা পাচ্ছি। বড় আপু, মেজ আপু, মা সবার কাছেই গিয়েছিলাম, কিন্তু কেউ আমাকে পাত্তাই দিল না। আমার কানে এখনো মশা দুটা লাফালাফি করছে। কাজেই আমি ঠিক করেছি হয় মশা বাঁচবে না হয় আমি বাঁচব। আমার ধারণা ছাদের উপর থেকে লাফ দিলেই আমি মারা যাবো।
- তুই তো মরবি না রে, তোর কেবল হাত পা ভাঙ্গবে। অযথাই সুসময়টাকে দুঃসময় বানাচ্ছিস। নেমে আয়, খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দেব, বললো তিনা।
- নেমেই তো আসতে চাচ্ছি, তবে সিঁড়ি দিয়ে না। আমি ভাইজানের দৃষ্টি আকর্ষন করছি, ভাইজান তোমাকে সামনে দেখছি না। তুমি যদি ছাদে আসার চেষ্টা কর, আমি সাথে সাথেই লাফ দেবো। উঃ কানে ব্যথা করছে। ভাইজান সাবধান।
আয়েশা বেগম মনে মনে আয়তুল কুরছি পড়ছেন। পাগলী মেয়েটা কখন কী করে বসে ঠিক নাই। তাই তিনি পরমকরুণাময়কে ডাকছেন।
জামিল হঠাৎ সবার মাঝে ফিরে এলো। বোঝাই যাচ্ছিল সে চুপিচুপি ছাদে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু তার আশার গুড়ে বালি পড়ে গেল। সে বললো, এর মধ্যে মজা কোথায় বীনু?
- তোমরা তো মজা খুঁজে পাবেনা। আমি কিন্তু পাব। মজা হলো দুটা; এক. আমার আজ জন্মদিন, প্লাস আজই হবে মৃত্যুদিন। সুতরাং তোমরা সারাজীবন দিনটা মনে রাখবে, চাইলেও ভুলতে পারবে না। আর নিজেদের ভুল বুঝতে পারবে। এটাই হলো প্রথম মজা। দুই. তোমরা জানবে তোমাদের আদরের ছোট বোন বীনা সামান্য দু'টো মশার জন্য প্রাণ দিয়েছে। সুতরাং আমি লাফ দিচ্ছি।
- শোন বীনু পাগলামো করিস না। কথা শোন, নেমে আয়। এখনি তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। আর তোর জন্য কেক এনেছি কেক কাটবি না?
- না কাটবো না। হে মহান পৃথিবীবাসী, সবার কাছে থেকে চির বিদায় নিচ্ছি। বিদায়।
সত্যিই বীনা লাফিয়ে পড়লো।
সন্ধ্যা নেমেছে। সেই সাথে এক তলার নীল বাড়িটাতেও শোকের ছায়া নেমে এসেছে। জন্মদিনের কেক টেবিলের ওপর সাজানো আছে। কেকের মাঝখানে লেখা "বীনুর আজ জন্মদিন"।
বীনার যখন জ্ঞান ফিরে এলো তখন সন্ধ্যা সাতটা। চোখ মেলতেই বীনার চারপাশে সব পরিচিত মুখগুলো দেখতে পেল। বললো, আমার কী হয়েছে?
রাগাহ্নিত কিন্তু অপেক্ষাকৃত কোমল কন্ঠে তিনা বললো, বেশি কিছু হয়নি, দু'একটা হাড় ভেঙ্গেছে। তখন বললাম লাফাস না। একতলার ছাদ থেকে লাফিয়ে কেউ মরে শুনিনি। ভাল হয়েছে, এখন ২/৩ মাস শুয়ে থাক বিছানায়। জ্বালাতনটা একটু কমলো।
- আহ্ কী হচ্ছে! মেয়েকে থামালেন আয়েশা বেগম।
বীনা বললো, মা পানি!
আয়েশা বেগম তড়িঘড়ি করে ছুটে মেয়ের জন্য পানি আনলেন। বীনা একগ্লাসের পুরো পানি টুকু খেয়ে বললো, মা, মশাদু'টো মনে হয় মারা গেছে। লাফালাফি করছে না।
সবাই অবাক চোখে বীনার দিকে তাকালো। কেউ কিছু বললো না। বীনা বললো, ভাইজান, কেকটা নিয়ে এসো, কেক কাটবো। আমার আজ জন্মদিন না!
১৫/১১/২০১১ইং
শেখেরটেক, মোহাম্মদপুর।
আমার লেখা অন্য গল্পগুলো:
- বৃষ্টিস্নান
- কথপোকথন
- ভয়
- কাচাগোল্লা
- একদিন প্রতিদিন
- অনেক আনন্দ