আজ একটা এক্সিডেন্ট হওয়া দরকার!
মোটর সাইকেল চালানো অবস্থায় হঠাৎই ব্যাপারটা মাথায় এলো অফিসগামী সৌরভের। মানসিক চাপ বেশি হয়ে যাচ্ছে। ব্রাঞ্চ থেকে পরপর তিনজন বদলী হয়ে চলে গেল কিন্তু নতুন কেউ এলো না। ম্যানেজার সাহেব ওর ওপর চাপের পাহাড়ের উচ্চতা বাড়াতে শুরু করেছেন। নির্ধারিত অফিস সময়ের বাইরেও অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হয়। একে একে সবাই বের হয়ে গেলেও সে আটকা পড়ে যায়। মাঝে মধ্যে সে বলে- স্যার আপনিও ট্রান্সফার হয়ে চলে যেতে পারেন, আমি সামলিয়ে নিতে পারবো!
ম্যানেজার সাহেব কিছু বলেন না, হেসে উড়িয়ে দেন। এরকম কর্মঠ কর্মী সহজে পাওয়া যায় না, বাকী সবাই তো কম বেশি ফাঁকিবাজ! তবে ছেলেটার সমস্যা একটাই- দ্রুত মাথা গরম হয়ে যায়। যখন দেখেন সৌরভের মাথা-মেজাজ বিগড়ানো শুরু করেছে তখন তিনি ওকে ডেকে নেন কামড়ায়, চা খাওয়ান, বাসার কথা জিজ্ঞেস করেন, দু’বছর বয়েসী বাচ্চার কথা জিজ্ঞেস করেন। ধীরে ধীরে পরিবেশ শান্ত করেন নতুবা অকারণেই একবেলা ছুটি দিয়ে দেন যদিও পরদিন সেটা সুদে আসলে উসুল করে নেন। তিনি বিশ্বাস করেন, যত কম কর্মী নিয়ে ব্রাঞ্চ চালানো যাবে ততই তিনি লাভের মুখ দেখবেন।
সৌরভের আজ অফিস যেতে ইচ্ছা করছিল না, কিন্তু বাসায় থাকতেও ইচ্ছা করছিল না। স্ত্রী রত্নার সাথে মনোমালিন্য চলছে গত রাত থেকে। আগামীকাল রত্নার এক দুঃসম্পর্কের কাজিনের বিয়ে। বিয়ে মানেই একটা গিফট, মাসের টাকায় টানাটানি। আর কাছের মানুষের বিয়ে হলে তো কথাই নেই! কায়দা করে কম টাকায় ভালো একটা গিফট সে কিনেছে। কিন্তু পরবর্তী সমস্যা হলো- বিয়ের অনুষ্ঠানে সপরিবারে উপস্থিত হতে হবে। এ সকল অনুষ্ঠান খুবই বিরক্তকর লাগে। অপরিচিত লোকজনের মাঝখানে ভোলাভালা মুখ নিয়ে বসে থাকতে হয় নতুবা মুরব্বী গোছের মানুষের ভারী ভারী আলোচনায় কান গরম করতে হয়। তবে কড়া নির্দেশ- ‘মুখ গোমড়া করা চলবে না।’ আর এর মধ্যে পিচ্চিটা পুরোটা সময় বাবার কোলেই থাকবে, মা’র কাছে যাবে না। পুরো অনুষ্ঠানে রত্নাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কালে ভদ্রে দুয়েকবার এসে খোঁজ নিয়ে যাবে- সৌরভ বেঁচে আছে কিনা!
এ পর্যন্ত সে মেনেও নিয়েছে। কিন্তু গত রাতে খাবার টেবিলে বসে রত্না নতুন বায়না ধরে। আজ সন্ধ্যায় গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যেতে হবে। শুধু তাই নয়, হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য নাকি ড্রেস কোর্ট আছে! মেয়েদের জন্য একই শাড়ি আর ছেলেদের জন্য একই কাপড়ের পাঞ্জাবীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সৌরভের জন্য ওর মাপেরই পাঞ্জাবী পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন না গেলে ব্যাপারটা খুবই খারাপ হয়ে যাবে। সৌরভের গলায় ভাত আটকে যায়। খক খক করে কাশতে থাকে। রত্না পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় কিন্তু সৌরভ নেয় না। কাশতে কাশতে চোখ লাল হয়ে যায়। কাশির কারণে নাকি মেজাজ খারাপ থেকে চোখ লাল হয়েছে তা রত্না ধরতে পারে না। সে পানি খাবার জন্য চাপাচাপি করতে থাকে। সৌরভ গ্লাস এড়িয়ে পানির জগ তুলে নেয়। ঢক ঢক করে পানি খেতে গিয়ে জামা ভিজিয়ে ফেলে। এতে ওর মেজাজ আরো খারাপ হয়। কিন্তু কিছু বলতে পারে না। কিংবা ইচ্ছা করে না। খাওয়া শেষ না করেই সে উঠে পড়ে।
ঘরের চাপ সামাল দিতে গেলে অফিসে নতুন ঝামেলা তৈরি হবে। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যেতে হলে অফিস থেকে আগে বের হতে হবে। মানে ম্যানেজার সাহেবের সাথে আরেক চোট উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করতে হবে!
খুবই বিরক্ত লাগছে। মোটর সাইকেল চালাতে গিয়ে প্রায়ই আনমোনা হয়ে পড়ছে। ঠিক এমন একটা সময়ই ভাবনাটা মাথায় এলো- আজ যদি ছোটখাটো একটা এক্সিডেন্ট হয়, সে কয়েকদিন বিছানায় পড়ে থাকে তাহলে সমস্যাগুলো আপাতত এড়ানো যাবে। রত্না চাইলে একাই বিয়ের অনুষ্ঠানে যেতে পারবে আর ম্যানেজার সাহেব বাধ্য হয়ে অন্যদের মাঝে কাজগুলো ভাগ করে দেবেন। স্নায়ু শীথিল হয়ে আসে ওর। বেশ আরাম লাগে।
তবে এরকম ভাবনা যে এমনিতেই এলো ব্যাপারটা তেমন না। পরপর দু’বার সংঘর্ষের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। প্রথমবার একটা লেগুনা পেছন থেকে হুশ করে বেরিয়ে গেল। যাবার সময়, ইচ্ছা করেই কিনা কে জানে, বাঁ দিকে একটা চাপ দিয়ে গেল। গতি কম থাকায় সময় মতো মোটর সাইকেল সরিয়ে নিয়েছে সৌরভ, অন্যথায় সংঘর্ষ এড়ানো খুব কঠিন হতো। ওর খুব ইচ্ছে হলো- দ্রুত মোটর সাইকেল চালিয়ে সামনের সিগনালে লেগুনাটাকে আটকাতে। কিন্তু দ্রুতই আবার ইচ্ছেটা মরে গেল। কী হবে লেগুনা আটকিয়ে। দেখা যাবে, ড্রাইভিং সিটে বসে থাকবে কম বয়েসী একটা ছেলে যার লাইসেন্স নেবারই বয়স হয়নি। বড়োজোড় গোটা দু’চারেক গালিগালি করে ছেড়ে দিতে হবে। বরং মনে মনে কয়েকটা গালি দিয়ে দমে গেল সে।
দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটলো, ধানমণ্ডি সাতাশ নম্বরে ওঠার আগে আগে। লালমাটিয়া এ ব্লক ধরে এগেলো ডান দিকের একটা গলি সাতাশ নম্বরে গিয়ে মিশে। সৌরভের গতি তখন চল্লিশের আশেপাশে। সামনে কালো রঙের একটা পাজেরো গাড়ি প্রায় একই গতিতে চলছিল। সৌরভ ডান ইন্ডিকেটর লাইট জ্বালিয়ে রেখেছে ডানে মোড় নেবার উদ্দেশ্যে। সামনের পাজেরো কোনো সিগানাল দিচ্ছে না, কাজেই ধরে নেয়া যায় ওটা সোজাই যাবে। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে হুট করে ডান দিকে ঘুরে গেল পাজেরোটা। সৌরভের কয়েক মুহূর্ত সময় লাগলো সেটা বুঝতে, তারপর দ্রুত হাইড্রোলিক ব্রেক চেপে দাঁড়িয়ে পড়লো। এক্ষেত্রেও সংঘর্ষ এড়ানো গেলেও খানিকটা কাত হয়ে গেল মোটর সাইকেল। মেজাজটা এমনিতেই ভালো নেই তারওপর পরপর দুইবার এরকম ঘটনায় সে খুবই বিরক্ত বোধ করতে লাগলো। প্রথমবার সম্ভাব্য সংঘর্ষ এড়ানোর পর লেগুনার ড্রাইভারকে ধরার একটা ইচ্ছে জাগ্রত হয়েছিল তবে এবার সে সাহস হলো না। কারণ পাজেরো জাতীয় গাড়িতে সাধারণ মানুষজন চলাচল করে না। হোমড়া চোমড়ারা থাকে। ওরা ইচ্ছে করলে দু’চারটা মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দিয়ে চলে যেতেই পারে, কারো বলার কিছু থাকে না। আর তাছাড়া ওদের সঙ্গে বডিগার্ড জাতীয় লোকজন থাকতে পারে যারা ফ্রিহ্যান্ডে দক্ষ! যাইহোক, মনে মনে গোটাকতক গালি দিয়ে নিজেকে সংযত করলো সৌরভ।
গলির মাথায় মোটর সাইকেল দাঁড় করিয়ে একটা সিগারেট জ্বাললো সে। উত্তেজিত অবস্থায় ড্রাইভিং করা উচিত না। আশেপাশে চায়ের দোকান দেখা গেল না। মোটর সাইকেলে ঠেস দিয়ে রিল্যাক্স হবার চেষ্টা করলো। মোবাইল ফোন বের করে মেসেঞ্জার চেক করলো। না, তেমন কোনো মেসেজ নেই। গতানুগতিক কয়েকটা গ্রুপ মেসেজ। শুভ সকাল জানানো টাইপের। কিছু কিছু মানুষের কাজ নেই, সারাক্ষণ অপ্রয়োজনীয় মেসেজ পাঠাতেই থাকে। এই মানুষগুলোকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং এর কাজে ব্যবহার করা উচিত। গ্রুপ মেসেজগুলো সাধারণত সে দেখে না। গ্রুপগুলো সে লিভও করে না, তবে মিউট করে রাখে যেন অনরবত মেসেজ নোটিফিকেশন এসে বিরক্ত না করতে পারে। খানিকক্ষণ পরে সে আবার রওয়ানা দেয়।
মগবাজার ফ্লাইওভারে ওঠার পরপরই এক্সিডেন্টের ভাবনাটা মাথায় আসে। ছোটখাটো একটা এক্সিডেন্ট হলে মন্দ হয় না। শুধু হাত-পা না ভাংলেই হয়। শরীরের কয়েক জায়গায় ছিলে যাবে, দুয়েকটা সেলাই পড়তে পারে, আর বাকীটা চলবে- অভিনয়!
অন্যান্য দিনের মতো আজও ফ্লাইওভারের উপরে গাড়ীর জ্যাম লেগে আছে। কাজেই শামুক গতিতে এগোয় সৌরভ। এ অবস্থায় চললে অস্বাভাবিক কিছু ঘটার সম্ভাবনা কম। বরং ইচ্ছাকৃত কোনো গাড়ীকে লাগিয়ে দিলে উল্টা জরিমানা গুনতে হতে পারে।
অফিসে নিয়মিত কাজের বাইরে আজ কী কী গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকতে পারে সে নিয়ে ভাবতে শুরু করে সৌরভ। একটা স্টেটমেন্ট পাঠাতে হবে, আজ শেষ দিন। কাল সন্ধ্যায় প্রস্তুত করে রেখেছে, আজ শুধু প্রিন্ট করে স্বাক্ষর-সিলসহ পাঠাতে হবে। এই স্টেটমেন্টটি পাঠাতে দেরি হলে হেডঅফিস জরিমানা করতে পারে। ব্যক্তি পর্যায়ে জরিমানা। কাজেই এটা একটা ঝামেলাই বটে। এছাড়া কয়েকটা বিলের ভাউচার ছাড়তে হবে, ক্রেডিট কার্ডের বিল জমা দিতে হবে। নাহ, অফিস যাওয়াটা ধীরে ধীরে জরুরী হয়ে উঠছে। তাছাড়া যে কারণে রত্নার ওপর অভিমান সেটার জন্য তো গিফট ইতিমধ্যে কেনা হয়ে গেছে। গিফটটা অনুষ্ঠানে না দিতে পারা মানে আরেকটা অপচয়। তাছাড়া আজ অফিস থেকে সন্ধ্যায় বের হতে না পারলে তো কিছু করার নেই। বিকালের দিকে রত্নাকে জানিয়ে দিতে হবে যে সে যেতে পারছে না, আজকেই মতো ও যেন একাই চলে যায়। মূল অনুষ্ঠানে না হয় যেতেই হলো। আরেকটা বিষয়ও ভাবতে হচ্ছে, ছোট-বড়ো যেমনই হোক, এক্সিডেন্ট হলে তো ওকে হাসপাতালে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে রত্নাকেও অনেক ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হবে। আজ তো সে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যেতেই পারবে না, এমনকি কালও বিয়েতে যেতে পারবে না। মাঝখান থেকে মেয়েটার সব আনন্দ মাটি হয়ে যাবে।
মনটা খারাপ হয়ে গেল সৌরভের। কী সব ভাবছে! এভাবে এক্সিডেন্টের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হলে তো হাসপাতালগুলোতে সিটই খালি পাওয়া যেত না। না, হাবিযাবি বাদ। অফিসে গিয়ে স্টেটমেন্টটা পাঠানোই প্রথম কাজ, তারপর ক্রেডিট কার্ডের বিল দিতে হবে। আর বিকালের অনুষ্ঠানটা বাতিল!
ফ্লাইওভার থেকে নেমেও শামুক গতিতেই চলছিল সকল যানবাহন। সামনে বাঁয়ে একটা মোড় নিল সে। সাধারণত সকালের দিকে এই গলিটা সামান্য হালকা থাকে। মোটর সাইকেলের গতি বাড়ছিল ক্রমাগত। সামনের গাড়িটা হঠাৎই হার্ড ব্রেক কষলো! আনমনা সৌরভ ব্যাপারটা বুঝতে সামান্য দেরি করে ফেললো। গাড়ির সাথে সম্ভাব্য সংঘর্ষ এড়াতে বাঁয়ে কাটলো। রাস্তার বামের অংশ আগে থেকে না দেখার কারণে সেখানে যে সদ্য খোড়া একটা গর্ত থেকে বড়ো বড়ো কয়েকটা রড বের হয়ে আছে তা সে দেখতে পেল না। সৌরভের মোটর সাইকেলের হাইড্রোলিক ব্রেকটা সাধারণত মিস হয় না কিন্তু হয়তো প্রথমবারের মতো সে ব্রেক চাপতে ভুলে গেল।
ছবি: গুগলমামা।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২০ সকাল ১১:৫৩