somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এমন একটি ছবি : একটি সুপ্রভাবিত কিশোর-কবিতা

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৮০-৮৩ সালে আমরা যখন ৭ম-১০ম শ্রেণিতে পড়ি, বান্দুরা থেকে এক তুখোড় ইংরেজি শিক্ষক এসে যোগদান করলেন আমাদের মালিকান্দা হাইস্কুলে। স্যারের নাম উৎপল চন্দ্র সাহা। স্যার ইংরেজি ক্লাসে পাঠ্যবিষয় তেমন পড়ান না, পড়ান শেক্সপিয়র- টু বি, অর নট টু বি দ্যট ইজ দ্য কোয়েশ্চন। আমরা বুঝি না কিছুই- কেবল হাঁ করে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি; মুগ্ধ না হয়ে খুব বিরক্ত হই। কারণ, পরীক্ষার পড়া আমাদের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আরো আছে- তিনি শুধু ইংরেজিই না, বাংলাও পড়ান। বাংলা ক্লাসে 'ছুটি' পড়াতে গিয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস থেকে শুরু করে ছোটোগল্পের ইতিবৃত্ত বয়ান করতে থাকেন। আমরা যথারীতি বিরক্ত হই- ফটিকচরিত্র আলোচনা অধিক গুরত্বপূর্ণ আমাদের জন্য। এই উৎপল স্যারের কাছেই জীবনে প্রথমবারের মতো সুকান্ত ভট্টাচার্যের নাম শুনেছিলাম- তিনিই প্রথম 'ছাড়পত্র'-এর সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
উৎপল স্যার একদিন সৈয়দ আলী আহসানের 'আমার পূর্ব-বাংলা' কবিতাটির ভূয়সী প্রশংসা করলেন এবং সেটি পাঠ করে শোনালেন। অন্য একদিন পাঠ করলেন 'ছবি' নামক একটা কবিতা। তাঁর বিবেচনায় বাংলা সাহিত্যের সেরা কবিতা যে-গুলো, তিনি আমাদের সে কবিতাগুলো পাঠ করে শোনাতেন বিভিন্ন ক্লাসে।

আমি তখন কবিতা লিখতে শুরু করেছি। একটা-দুটা ট্র্যাংক ভরে গেছে! এতো এতো কবিতার মধ্যে সুকান্ত, নজরুল, জসীমউদ্‌দীনের প্রভাবপুষ্ট কবিতার সংখ্যাই বেশি- কিন্তু যে-কবিতাটিতে 'ছবি''আমার পূর্ব-বাংলা'র সুস্পষ্ট প্রভাব বিদ্যমান, সেটির নাম 'এমন একটি ছবি'। এটির সুনির্দিষ্ট রচনাকাল আমার মনে নেই, তবে ১৯৮০ থেকে ১৯৮৬- এর মধ্যিখানে যে-কোনো একদিন লিখেছিলাম তা নিশ্চিত। নিচে আমার 'এমন একটি ছবি' এবং তারও নীচে যা থেকে এর জন্ম ঘটেছিল, সেই 'ছবি' এবং 'আমার পূর্ব-বাংলা' কবিতা দুটোও জুড়ে দিলাম। আমার পূর্ব বাংলা কবিতাটি ব্লগার তানভীর চৌধুরী পিয়েল-এর ব্লগ থেকে সংগৃহীত। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা।


এমন একটি ছবি
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই

এমন একটি ছবি আঁকে নি কোনো শিল্পী :
যেখানে পাহাড়ের কোলে
ছলছল ঝরনাধারার রোদে ঝিলিমিলি
উদার আকাশে
চপলা মেঘ-পরীদের মত্ত নাচানাচি
কিংবা
রুপালি নদীর তটে তটে
হাওয়ায় হাওয়ায় দোদুল সাদা কাশবন।

এমন একটি ছবি আঁকে নি কোনো শিল্পী :
যেখানে সবুজে ঘেরা
হাজার পাখির একটি নিবিড় বন
ঝিলের জলে
সাদা সারসের এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যাবলি
মাঝিরা রঙিন পাল তোলে নায়ে পুবালি বাতাসে
কাজল দিঘিতে
প্রস্ফুটিত একটি শাপলার মোহন হাসি
কৃষাণের হাতে ধানের একগুচ্ছ সোনালি শিষ
এবং
সারি সারি পাটের সবুজ বীথি।

এমন একটি ছবি আঁকে নি কোনো শিল্পী।
অথচ এই ছবিটি
আমি প্রতিদিন নয়ন ভরে দেখি।
তুমি যদি ছবিটি দেখতে চাও
একবার তাকাও এই বাংলায় :
কোনো নিপুণ শিল্পীর তুলিতে আঁকা নয়,
অথচ কেমন সতেজ
শ্যামল সুন্দর এই ছবিটি।



ছবি
আবু হেনা মোস্তফা কামাল

আপনাদের সবার জন্যে এই উদার আমন্ত্রণ
ছবির মতো এই দেশে একবার বেড়িয়ে যান।
অবশ্য উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো মনোহারী স্পট আমাদের নেই,
কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না- আপনার স্ফীত সঞ্চয় থেকে
উপচে-পড়া ডলার মার্ক কিংবা স্টার্লিঙের বিনিময়ে যা পাবেন
ডল্লাস অথবা মেস্ফিস অথবা কালিফোর্নিয়া তার তুলনায় শিশুতোষ!

আসুন, ছবির মতো এই দেশে একবার বেড়িয়ে যান।
রঙের এমন ব্যবহার, বিষয়ের এমন তীব্রতা
আপনি কোনো শিল্পীর কাজে পাবে না, বস্তুত শিল্প মানেই নকল
নয় কি?

অথচ দেখুন, এই বিশাল ছবির জন্যে ব্যবহৃত সব উপকরণ
অকৃত্রিম;

আপনাকে আরো খুলে বলি: এটা, অর্থাৎ আমাদের এই দেশ,
এবং আমি যার পর্যটন দপ্তরের অন্যতম প্রধান, আপনাদের খুলে বলি,
সম্পূর্ণ নতুন একটি ছবির মতো করো
সম্প্রতি সাজানো হয়েছে।

খাঁটি আর্যবংশসম্ভূত শিল্পীর কঠোর তত্ত্বাবধানে ত্রিশ লক্ষ কারিগর
দীর্ঘ নয় মাস দিনরাত পরিশ্রম করে বানিয়েছে এই ছবি।

এখনো অনেক জায়গায় রং কাঁচা- কিন্তু কী আশ্চর্য গাঢ় দেখেছেন?
ভ্যান গর্গ- যিনি আকাশ থেকে নীল আর শস্য থেকে
সোনালি তুলে এনে
ব্যবহার করতেন- কখনো, শপথ করে বলতে পারি,
এমন গাঢ়তা দেখেন নি!

আর দেখুন, এই যে নরমুণ্ডের ক্রমাগত ব্যবহার- ওর ভেতরেও
একটা গভীর সাজেশান আছে- আসলে ওটাই এই ছবির- অর্থাৎ
এই ছবির মতো দেশের থিম!


আমার পূর্ব বাংলা
সৈয়দ আলী আহসান

আমার পূর্ব-বাংলা এক গুচ্ছ স্নিগ্ধ
অন্ধকারের তমাল
অনেক পাতার ঘনিষ্ঠতায়
একটি প্রগাঢ় নিকুঞ্জ
সন্ধ্যার উন্মেষের মতো
সরোবরে অতলের মতো
কালো-কেশ মেঘের সঞ্চয়ের মতো
বিমুগ্ধ বেদনার শান্তি
আমার পূর্ব-বাংলা বর্ষার অন্ধকারের অনুরাগ
হৃদয় ছুঁয়ে-যাওয়া
সিক্ত নীলাম্বরী
নিকুঞ্জের তমাল কনক-লতায় ঘেরা
কবরী এলো করে আকাশ দেখার
মুহূর্ত
অশেষ অনুভব নিয়ে
পুলকিত সচ্ছলতা
এক সময় সূর্যকে ঢেকে অনেক মেঘের পালক
রাশি রাশি ধান মাটি আর পানির
কেমন নিশ্চেতন করা গন্ধ
কত দশা বিরহিণীর- এক দুই তিন
দশটি
এখানে ত্রস্ত আকুলতায় চিরকাল
অভিসার
ঘর আর বিদেশ আঙিনা
আকুলতায় একাকার
তিনটি ফুল আর অনেক পাতা নিয়ে
কদম্ব তরুর একটি শাখা মাটি
ছুঁয়েছে
আরও অনেক গাছ পাতা লতা
নীল হলুদ বেগুনি অথবা সাদা
অজস্র ফুলের বন্যা অফুরন্ত
ঘুমের অলসতায় চোখ বুঁজে আসার মত
শান্তি
কাকের চোখের মতো কালোচুল
এলিয়ে
পানিতে পা ডুবিয়ে-রাঙা উৎপল
যার উপমা
হৃদয় ছুঁয়ে-যাওয়া সিক্ত নীলাম্বরীতে
দেহ ঘিরে
যে দেহের উপমা স্নিগ্ধ তমাল-
তুমি আমার পূর্ব-বাংলা-
পুলকিত সচ্ছলতায়, প্রগাঢ় নিকুঞ্জ।।


***

'এমন একটি ছবি' নিয়ে কোনো কোনো ব্লগার বন্ধুর মধ্যে কিছু কনফিউশন দেখা যাচ্ছে মনে হওয়ায় শিরোনামের নিচে লেখকের (বা কবির) নাম লিখে দেয়া হলো। ভালো থাকুন বন্ধুরা।

সবাইকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০২৫ রাত ১২:৩৮
৩৪টি মন্তব্য ৩৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×