somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাল্যস্মৃতি - ১৯৭১; সত্তাগত

২৬ শে মার্চ, ২০১৫ রাত ১২:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জীবনে সর্বপ্রথম যে গানটি শুনেছিলাম

আপনাদের কি মনে পড়ে জীবনে সর্বপ্রথম কোন্‌ গানটি শুনেছিলেন?

এর আগে আমি হয়তো অন্য কোনো গান শুনে থাকবো, কিন্তু তার কিচ্ছুটুকুন মনে নেই। বা গান বলে যে একটা বস্তু বা বিষয় আছে তাও হয়তো এর আগে বুঝি নি।
তবে এ গানটি ‘গান’ হিসেবেই কবে কোথায় কীভাবে শুনেছিলাম তা আমার স্পষ্ট মনে আছে।

১৯৭১।
বর্ষার প্রথম পানিতে গাঁয়ের খাল ভরে গেছে। আমি বাবার সাথে চকে গেছি ধানক্ষেত দেখতে। সূর্য তখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে। কিছু আগে সামান্য বৃষ্টি হয়েছে, আকাশে ঝলমলে রোদ্দুর আর ক্ষেতের উপর বাতাসের ঢেউসমেত আগুনের হলকা।

বাবার সাথে গুটি গুটি পায়ে খালের পার ধরে বাড়ি ফিরছি। পারাপারের জায়গাটাতে এসে আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়াই। এখানে ডাকের খেয়া নেই, পানিতে নেবে বা সাঁকোতে খাল পার হতে হয়। ওখানে সাঁকো ছিল না।
মামা সম্পর্কের একজন ভাটি থেকে উজান টেনে নৌকা বেয়ে আসছিলেন। তাঁকে দেখেই বাবা ডাকলেন, ‘ও ইয়ার আলী, পার কইরা দেও।’

ইয়ার আলী মামা নৌকা ভেড়ালেন। বাবা আমাকে সাবধানে উঠিয়ে মাঝখানে বসালেন। ছোটোখাটো দু-একটা কথা। তারপরই নৌকা বাইতে বাইতে ইয়ার আলী মামা গেয়ে উঠলেন :

‘আমার সোনার বাংলা...’

আমার কাছে অদ্ভুত লাগলো। এমন সুন্দর গান আগে শুনি নি। যা শুনেছি তা হলো বৃষ্টি নামানোর ছড়া‌- মেয়েরা বুনোফুল আর চালুনি মাথায় নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘটীর পানিতে ভিজতো আর বৃষ্টির জন্য গাইতো।
কিন্তু...‘আমার সোনার বাংলা...’, এ তো এক আশ্চর্য গান! আমি গুন গুন করে গাইতে চেষ্টা করি, অল্প অল্প পারি।
বাড়ি গিয়ে মাকে বলি, ‘মা, ইয়ার আলী মামু গান গাইবার পারে...‘, এ কথা দ্বারা কী বোঝাতে চেয়েছিলাম মনে নেই, কিন্তু আমি ঠিক এরকম একটা কথাই মাকে বলেছিলাম...‘ইয়ার আলী মামু সোনার বাংলা গান গাইছে।’
এরপর সপ্তাহখানেকের মধ্যে আমি আরো একজনকে এ গানটা গাইতে শুনেছিলাম। তারপর অনেকের মুখেই শুনতে পেয়েছিলাম। যে যখন এ গানটা গাইতো, আমি দৌড়ে তার কাছে গিয়ে, পিছে পিছে হাঁটতে হাঁটতে গানটা শুনতাম।
ভয়াল ২৫ মার্চের উত্তাপ তো এর কত আগেই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমি কি অতোসব তখন বুঝি? যা বুঝি তা এখানে লিখে রেখেছি।

'আমার সোনার বাংলা' আমাদের জাতীয় সঙ্গীত, এ কথা জেনেছি অনেক পরে যখন ‘গান’ বুঝবার জ্ঞান হয়েছে। কিন্তু এ ঐতিহাসিক গানটার মধ্য দিয়েই আমার গান শোনার প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছিল- এ কথা ভাবতে গেলে খুব পুলকিত, বিস্মিত ও কেবল গর্বিত হতে থাকি আর আনমনে গেয়ে উঠি :

‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি
চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি...’

*পুরোনো, ০৭ ই মে, ২০০৯ সকাল ১০:৫৭


যেদিন প্রথম পতাকা হাতে তুলে নিয়েছিলাম

ব্যাপারটা ভেবে আপনিও বিস্মিত হবেন- কখনো কি জাতীয় পতাকা হাতে তুলে নিয়েছেন? অনেকের এরূপ অভিজ্ঞতা থাকলেও আমাদের কিন্তু খুব কমই সুযোগ আসে জাতীয় পতাকা হাতে তুলে নেবার।

কোনো জাতীয় অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের অনেক অনেক আগে আমি একটা পতাকা হাতে তুলে নিয়েছিলাম। সেই মামুলি কাহিনিটা বলি।
সেদিন দুপুরে এক মিছিল এলো। ছেলেবুড়ো, যুবক সবাই সেই মিছিলে। তাদের কণ্ঠে উদাত্ত শ্লোগান। তাদের কারো হাতে পতাকা। দৌঁড়ে যাচ্ছে মিছিল- দৌড়ে যাচ্ছে।
মিছিল গিয়ে জমায়েত হলো স্কুলের ময়দানে। চারদিক থেকে ছুটে আসতে লাগলো মানুষের ঢল। বিরাট মাঠ মানুষে ভরে গেলো। মাইকে অনবরত বেজে চলছে আমার সোনার বাংলা গানটি।
১৯৭১-এ আমার বয়স কত ছিল জানি না। আর যেদিনটার কথা বললাম তখন বুঝি নি, শুধু জ্ঞান হবার পরই সুনিশ্চিত ধারণায় বুঝেছিলাম ওটা ছিল ১৬ই ডিসেম্বর। যখন গাঁয়ের রাস্তা জনস্রোত আর গগনবিদারী শ্লোগানে টলমল করছিল, হাতে ছিল পতাকা- কী মহোল্লাসে আমারও চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠেছিল- কী অভূতপূর্ব উত্তেজনা, এক দুর্দমনীয় নেশা হাতে একটা পতাকা ধরবার। কিন্তু ন্যাংটো শ্রীযূত কোথায় পাবে পতাকা?
আমার মতো আরো অনেকের হাতেও এমন পতাকা ছিল- তাই একমুহূর্ত দেরি নয়, হাতের নাগালেই ছিল বাঁশের কাড়াল, আর ছিল আমার প্রিয় গামছাটি। আমি কাড়ালের মাথায় গামছা বেঁধে একপলকে বানিয়ে ফেললাম বাংলাদেশের পতাকা- আর দৌড়ে মিশে গেলাম রাস্তার মিছিলে।

বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা এভাবেই আমার হাতে প্রথম এসেছিল।

*পুরোনো, ০৮ ই মে, ২০০৯ রাত ১২:৪৫


১৯৭১ - আমার যুদ্ধে না যাবার কথা

আঠার বছর বয়স,
কিংবা যে বয়সে যুদ্ধে নামে যুবকেরা, আমার তা ছিল না একাত্তরে
আমার ছিল
রঙিন ঢাউস, ডুবসাঁতার, গেছোমেছো, চড়ুইভাতি আর বেতজঙ্গলে
ঘোড়াঘাপটি খেলা দুরন্ত দুপুর
আমার ছিল
বাবার কাঁধে চড়ে পৌষসংক্রান্তিতে নূরপুরের মাঠে তুমুল ঘোড়দৌড় দেখা
আমার ছিল
শীতের ধামাইল, শানাল ফকিরের ওরস, না-বোঝা জারিসারি গান রাতভর

আমার একটা বিশাল যুদ্ধদল ছিল, অঙ্গুলি দর্শনে
আলের পর আল মাড়িয়ে ওরা ছুটে আসতো মাষকলাই পোড়ানোর মাঠে;
আমার যুদ্ধদল- চোখের ইশারায় পরনের গামছা
কিংবা লুঙ্গি একটানে ছুঁড়ে ফেলে দল্লে গাছের শাখা হতে ঝাঁকে ঝাঁকে
দিগম্বর লাফিয়ে পড়তো খালের পানিতে;
আমার যোদ্ধারা অমায়িক আর খুব বিশ্বস্ত ও বাধ্যগত ছিল; আমার অধীনে

আমার আড়িয়াল বিল ছিল,
বাহারি কচুরিফুল, কার্তিকের ভোরে ঠেলাজালে চিংড়িপোনা-
টেংরাপুঁটি আর টাটকিনির খলবলানিতে সকাল-দুপুর মত্তবেলা

আমার ভেলানৌকো ছিল, আর বাবার ছিল ছোট্ট ডিঙিনৌকো।
অনেক দুপুর সাঙ্গপাঙ্গদের লয়ে ভান করে ঘুমিয়েছি ভেলা আর নৌকোর পাটাতনে।
আমাদের জলমান আমনক্ষেতে ভেসে থাকা লাশগুলো
কলার ভেলা আর ডিঙিনৌকোয় ঠেলে প্রতিদিন স্রোতের পানিতে ভাসিয়ে দিতেন বাবা।
বাবার চোখ ছিল রুক্ষ ও অস্থির; আমি তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী ছিলাম।

আমার চাচা গ্রাম ছেড়ে চলে গেলেন। আমার চাচি কাঁদেন।
আমার দাদি কাঁদেন।
আমার বাবা ও চাচাতো ভাইবোনেরা কাঁদেন।
চাচা আমাকে কত্ত আদর করতেন; চাচাকে না পেয়ে আমিও কাঁদতাম;
কতদিন গোপনে।
আমার চাচা যেদিন যুদ্ধ থেকে ফিরে এলেন
১৬ই ডিসেম্বরের পর কোনো এক উজ্জ্বল সায়াহ্নে- কী ভীষণ কান্নার রোল, আর হৈচৈ-
চাচা আর বেঁচে নেই, এই ভেবে কত আগে আমরা মনকে পাষাণ করেছিলাম।

চাচার গল্পমুখর সন্ধ্যা ছিল; আমার ছিল অবিরাম আক্ষেপ- চাচার মতো
যুদ্ধ না করতে পারার দুঃখ

আমার একটা গান ছিল, সমগ্র কৈশোরে প্রথম বোধন-
‘চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি’
আমার একটা পতাকা ছিল- কাড়ালের মাথায় প্রিয়সঙ্গী গামছাটি বেঁধে
ভোঁ ভোঁ উড়িয়েছিলাম উড়ন্ত মিছিলের পথে, টগবগে ময়দানে

এসব আমি কিছুই বুঝি নি কোনোদিন;
শুধু টের পেতাম, বুকের ভেতর ক্রমশ গজিয়ে উঠছে অনিবার্য ঘাস,
সবুজ সবুজ কচিপাতা; স্বপ্নের মতো তুলতুলে বাংলাদেশ

*পুরোনো, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ২:৪২


বাংলাদেশ: জ্বলে ওঠো অগ্নিগর্ভা ইতিহাস

আমাদের মাটি আমাদের ঘর দিগন্তখোলা ছাদ
আমাদের বায়ু পাহাড়-বনানি আমাদের নদনদী
এটুকু লয়েই প্রাণের ভেতর আজন্ম পুষিতেছি
শোণিতরাঙা ঝলসানো এই প্রিয় ভূখণ্ডখানি

আমাদের দেহে আর্যানার্য আদি বাঙালির লোহু
বীর পুরুষের বীজ বুনে গেছে শত শতাব্দী কাল
আমরা কাহারো পরাভব মেনে সত্তা দিই নি বেঁচে
আলেকজান্ডারও লেজুড় গুটিয়ে পিছু হঁটে গিয়েছিল

আমাদের আছে গর্ব করার ইতিহাস সম্ভার
আমরা টুটেছি শোষণকারীর দর্প-অহংকার
সেই ইতিহাস খুঁড়ে খুঁড়ে আজ আগুনের খনি থেকে
চিনে নিতে হবে শান নিভে যাওয়া আমাদের সত্তাকে

সেই চেতনায় জোয়ার আসুক, কাটুক কুটিল রাত
ঝলসে উঠুক বীর বাঙালির সংঘবদ্ধ হাত
আমাদের বায়ু পাহাড়-বনানি আমাদের নদনদী
আমাদের মাটি আমাদের ঘর দিগন্তখোলা ছাদ

*পুরোনো, ১৭ ই এপ্রিল, ২০১০ দুপুর ২:১৭




৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×