৯৩৯ বঙ্গাব্দ। ৩২শে পউষ। বিকেল গড়িয়ে গোধূলির ধুলোয় চারদিক রহস্যময় হয়ে উঠছে। পদ্মা নদীর একদম মাঝখানে চারদিক পানিঘেরা বহুবছরের পুরোনো ছোট্ট চরটির এককোনায় তিনজন বদ্ধপাগল মেলা বসিয়েছেন। এই মেলা হলো আনন্দমেলা। আর আনন্দ হলো সাহিত্য নিয়ে। আজকে তারা আলোচনা করছেন ‘জাদুবাস্তবতা’ বা ‘পরাবাস্তবতা’ নিয়ে। পরাবাস্তবতা কাকে বলে, ইহা কত প্রকার ও কী কী,এবং এর উপকারিতা কতখানি, তা নিয়ে তারা সারগর্ভ আলোচনায় মগ্ন হয়েছেন।
মধুর আলোচনা ক্রমশ রসঘন হয়ে উঠছে। সেই রসে সিক্ত হয়ে তারা অনির্বচনীয় তৃপ্তি বোধ করিতে লাগিলেন। কিন্তু দেখতে দেখতে একসময় সেই আলোচনা আর মধুর থাকলো না, তা তুমুল তর্কাতর্কিতে রূপ নিতে থাকলো। কেউ বলছেন, যা বাস্তব না, অর্থাৎ যাহা অবাস্তব তাহাই পরাবাস্তব। আরেকজন বলছেন, না, যাহা বাস্তব এবং অবাস্তবের মাঝামাঝি অবস্থান করে, তাহাকেই পরাবাস্তব বলে। তৃতীয় ব্যক্তির বক্তব্য হলো- ভুতপ্রেতের কাহিনিই হলো পরাবাস্তবতা। এ বক্তব্যে বাকি দুজন প্রায় ধমকে ওঠেন। একজন বললেন, যে বিষয়টা তুমি ভাবতে পারো, কিন্তু বাস্তবে দেখা বা পাওয়া সম্ভব না, বানানোও অসম্ভব তাই হলো পরাবাস্তব।
চলমনা সঘন আলোচনায় মগ্ন বদ্ধ পাগলেরা বুঝতে পারলেন যে, তাদের একজনের মতের সাথে অন্যজনের মতের কোনো মিল নেই। একসময় তিনজনই দ্বিধায় পড়ে গেলেন, তাহলে কি ‘পরাবাস্তবতা কী বস্তু, সেটা সম্বন্ধে আমাদের কারোরই ধারণা পরিষ্কার নয়?’ আলোচনায় বোধহয় ক্লান্তি চলে এলো, তিনজনই মিইয়ে গেলেন। একটু বিরতি নেমে এলো।
কিন্তু, এভাবে বসে থাকলে তো কোনো সুরাহা হবে না, তাই মৌনতা ভাঙলেন একজন, ‘ধরো আমি তোমাদের দুজনের সাথে বসে কথা বলছি, বাস্তবে তোমাদের দুজনের কোনো অস্তিত্বই নেই। এটাই হলো পরাবাস্তবতা। অর্থাৎ, আমি যা কল্পনা করছি, তাই পরাবাস্তবতা। একবিংশ শতাব্দীতে ধরণীতে ‘সোনাবীজ’ নামক একজন মহান ব্লগার আসবেন। তার নামটা শুনে মনে হয় তার পেটের ভেতরে সোনার বীজ আছে, বাস্তবে সোনার তো কোনো বীজ হয় না। এই ‘সোনাবীজ’ নামটাই আস্ত একটা জাদুবাস্তবতা। জাদুবাস্তবতা প্রসঙ্গে মহামহোপাধ্যায় কবি মাহমুদ রহমান-০০০৭ বলেন, ‘মনের অবচেতন থেকে যাহা নির্গত হয়, তাহাই পরাবাস্তবতা বলে সাব্যস্ত। ‘আবার মনে করো, আমি স্বপ্নে দেখলাম একটা সুন্দরী নারীর আঙুল ধরে হাঁটাহাঁটি করছি, অথচ বাস্তবে আমার কোনো প্রেমিকা কেন, জীবনে কোনো মেয়েকেই চোখে দেখি নাই, এমন অবস্থায় যদি ঐ আঙুলধরা মেয়েকে নিয়া একটা প্রেমের কবিতা লিখি, ওটা তখন পরাবাস্তব কবিতা হইবেক।’
অন্য দুজন হিংসা এবং ঈর্ষায় এতক্ষণ ফুঁসছিলেন। একজন তো বলেই ফেললেন, ‘তুমি মিয়া গুগুল মামির কাছ থেকে সবকিছু কপি করে পেস্ট করতেছ। তুমি একটা সিপিএম, মানে কপি পেস্ট মাস্টার। এবং এমন অলস সিপিএম যে, লেখার নীচের ‘সংগৃহীত’ কথাটাও নিজে টাইপ না করে কপি-পেস্ট করে থাকো। তোমারে ধিক্ ধিক্ ধিক্কার।
এক পাগল অনেকক্ষণ ধরে নীরব ছিলেন। নিজেকে আর আটকাইয়া রাখতে পারলেন না। বললেন, ‘তোমরা আসলে পরাবাস্তবতা, জাদুবাস্তবতা বলে কোনোকিছুই বোঝো না। জগতে যা তুমি বোঝো না, ব্যাখ্যার অতীত, তাই হলো জাদুবাস্তবতা বা পরাবাস্তবতা। একটা সাহিত্য পইড়া যদি তুমি দেখো এর বিন্দু-বিসর্গও বুঝতে পারো নাই, এত দুর্বোধ্য, তখন নিশ্চিত থাকবা, এটা পরাবাস্তব সাহিত্য। এই সূত্রকে মনে রেখে তুমি যা লিখবা তাই পরাবাস্তব সাহিত্য হইয়া যাইব, তবে, লেখার শুরুতে বড়ো কইরা একটা ট্যাগ লাগাইয়া দিবা – উচ্চমার্গীয় পরাবাস্তব সাহিত্য।’
একটা চঞ্চল কিশোর তখন পাশ দিয়া হেঁটে যাচ্ছিল। এদের হট্টগোল শুনে সামনে এগিয়ে এসে উদ্বিগ্ন গলায় বললো, ‘এনি প্রবলেম স্যার? মে আই হেল্প ইউ?’
‘অব কোর্স নট, বাট হু আর ইউ মাই বয়?’
‘মে হু রবীন্দ্রনাথ ট্যাগোর।’
‘তব নাম ট্যাগোর? তো মাই ডিয়ার সুইট বয় ট্যাগোর, এই সাঁঝের বেলায় বাইরে ঘোরাঘুরি করতেছ কেন? কী চাও এইখানে?’
‘আজ্ঞে, আমি বিংশ শতাব্দীর একমাত্র নোবেলজয়ী বেঙ্গলি পোয়েট। টাইম ট্রাভেল করে অতীতে এসেছি পদ্মা নদীর হাওয়া খাওয়ার জন্য।’
তিন পাগলা চমৎকৃত হয়ে আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন এবং সমস্বরে ট্যাগোরকে অভিনন্দিত করলেন।
‘বৎস, আশা করি পদ্মার শীতল বাতাসে তোমার কেশ ঠান্ডা হইয়াছে।’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। গভীর আনন্দের সাথে আপনাদের জানাইতেছি যে, হাওয়া খাইতে খাইতে ইতিমধ্যে একখানা সুদৃশ্য সুররিয়াল পোয়েম রচনায় হাত দিয়াছি। কবিতাখানির নাম দিয়াছি ‘সোনার তরী’ – গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা, কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।’
পাগলারা একসাথে ‘বাহ্ বাহবা, ওয়াও ওয়াও’ করিয়া উঠিলেন।
কিশোর ট্যাগোর বলতে লাগলো, ‘এই কবিতার জন্য ফিল্ড নলেজ নিতে নদীর পাড় দিয়া ধানক্ষেতের আইল ধইরা হাঁটতেছি। কিন্তু কোথাও কোনো নৌকামাঝি, চাষী দেখতে পাইতেছি না। আকাশে মেঘও নাই।’
আজব লীলা প্রকৃতির! বলতে বলতেই আকাশ কালো হইয়া উঠিল। ঝুমবৃষ্টি শুরু হইল। নদীতে নৌকাও দেখা গেল। চাষীরা ভাড়ায় ভাড়ায় ধান লইয়া নৌকা ভরিতে লাগিল।
ভাবতেছেন ইনারা ভিজিয়া যাইতেছিলেন? জি না। তখন হঠাৎ একটা সুরম্য অট্টালিকা মাটি থেকে গজাইয়া উঠিল। এরা সবাই ঘরের ভিতর ঢুকলেন। রাজরাজড়াদের সুসজ্জিত আড্ডাঘর। আবার শুরু হইল মনোরম আলোচনা। আলোচনা দীর্ঘক্ষণ চলার পর কিশোর বললো, ‘আপনাদের আলোচনা ব্যাপক হইতেছে। আলোচনা অব্যাহত রাখিয়েন। কিছু মনে না করিলে এবার আমি উঠি। খুব খিদা লাগছে। আপনারা তো কোনো নাস্তারও আয়োজন করলেন না।’
প্রধান পাগল হেসে দিয়ে বললেন, ‘আমাদের এত কাঁচা লোক ভাইব্বো না বাপু। আমাদের নাস্তা সময়মতো আসলো বলে।’
অমনি ঘরের দরজায় হাঁক দিয়া উঠিল মহান শায়মা হক, ‘তোরা জলদি রেডি হ। গরম গরম খাইয়া নে।’
সব্বাই গরম গরম খাওয়া শুরু করলো।
খাওয়া শেষ হইলে সকলেই রান্নার খুব তারিফ করলো, বিশেষ করে শামুক ভাজাটা খাইয়া তো সবাই পাগল হইয়া যাওয়ার মতো অবস্থা।
খাওয়া দাওয়া শেষ হইলে শায়মা হক বললো, ‘যা এবার, জলদি ব্লগে যাইয়া লগিন কর। তোরা অনেক অলস হইয়া গেছস। খালি অফলাইনে পোস্ট পড়োস। কোনো লাইকও দেস না, কমেন্টও করোস না। তোরা এত কিপটা হইলি কেমনে?’
পাগলরা একটু বিব্রত হলেন। শায়মা হক যাওয়ার পর তারা আলোচনায় বসলেন- ‘আচ্ছা, মহান শায়মা তো সব সময় আমাদের ভাইয়ামণি, ভাইয়ু ডাকে, আজকে এত শুষ্ক গলায় তুই-তোকারি করলো কেন?’
ট্যাগোর উত্তর দিল : বুঝলা না ওস্তাদ? এইডাই হলো পরাবাস্তবতা, যার সাথে বাস্তবের কোনো মিল নাই
১৬ জুলাই ২০২০
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০২০ রাত ১১:০৪