প্রথম পর্ব
আমার প্রথম পালকিতে চড়া
দেশে এখন পালকির চল আছে কিনা জানি না, এবং আমাদের আজকের জেনারেশন ‘পালকি’ শব্দ কিংবা পালকি বস্তুটার সাথে পরিচিত কিনা তা নিয়েও আমার সন্দেহ আছে। কিন্তু আগের দিনে পালকিতে করে বিয়ে করা ছিল বিরাট ঐতিহ্য। তবে, বর্ষাকালে কেড়াই নৌকা, গয়নার নৌকা বা লঞ্চে করেও বিয়ের ‘চলন’ (বরযাত্রী) আসতো।
সবাই যে শুধু বিয়ে করার জন্যই বরযাত্রী সেজে পালকিতে চড়ে বউ আনতে যেত, তা কিন্তু না। বিয়ের আগেও অনেকের পালকিতে চড়ার সুযোগ ঘটতো (অসুস্থতা ছাড়াও)। পালকিতে চড়ে বউ আনার জন্য শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয় নি, কারণ, স্ত্রী হেঁটেই আমার বাসায় চলে এসেছিল তবে, ছোট্টবেলায় অন্যদের বিয়েতে আমি পালকিতে চড়েছিলাম।
মরণ মৃধা নামক আমার এক মামা (আমার আপন মামা সুরুজ মামার চাচাত ভাই) বিয়ে করেছিলেন একই গ্রামের পাষাণ ফকিরের বড়ো মেয়েকে। দু বাড়ির মাঝখানের দূরত্ব ২০০ থেকে ৩০০ গজ হবে। এত অল্প জায়গা তো হেঁটেই যাওয়া যায়, কিন্তু না, বিয়ে বলে কথা। বাপের বাড়ি থেকে বউ হেঁটে আসবে শ্বশুর বাড়িতে? কক্ষণো না। এতে ইজ্জত একেবারে মাটিতে মিশে যাবে।
সেই সময় ‘চলন’ বের হতো বেশ রাত করেই। বউ নিয়ে ফিরতি যাত্রা করতে করতে অনেক সময় ভোর হয়ে যেত (আমার রজব কাকা যখন বউ নিয়ে বাড়িতে পৌঁছেছিলেন, তখন সূর্য উঠে গেছে)।
‘চলন’ প্রস্তুত। মরণ মামা এখন পালকিতে উঠবেন। ঐ মুহূর্তে আমার ডাক পড়লো, ‘খলিল কই?’ আমি দৌড়ে কাছে এসে বললাম, ‘কী?’ – ‘পালকিতে চড়।’ বলামাত্রই আমি মামার সাথে পালকিতে উঠে বসলাম। মামা একদিকে, আমি উলটো দিকে মুখোমুখী বসে। মামার সাথে আমাকেও পালকিতে উঠানোর কারণ হলো ভারসাম্য রক্ষা করা, যাতে পালকির একদিকে ওজন বেশি, অন্যদিকে হালকা না হয়ে যায়, এর ফলে একদিকের বেহারাদের কাঁধে ওজন বেশি পড়বে অন্যদিকের চাইতে।
পালকিতে বেশ মজা লাগছিল। দুলতে দুলতে যাচ্ছিলাম, আর ভাবছিলাম, ইশ, যদি আরো অনেকক্ষণ পালকিতে বসে থাকা যেত, খুব ভালো হতো। কিন্তু, দূরত্ব কম হওয়াতে অল্প সময়ের মধ্যেই পালকি ভ্রমণ শেষ হয়ে গেল।
আমি আরেকবার, মরণ মামার ছোটোভাই মোতালেব মামার (মোতালেব মৃধা) বিয়ের চলনেও পালকিতে চড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। মামার শ্বশুর বাড়ি হলো আমাদের গ্রাম থেকে তিন মেইল দূরবর্তী জয়পাড়া গ্রামে। আনুমানিক রাত ৮টার দিকে ‘চলন’ বের হলো। কিন্তু, এখানে পালকিতে চড়া নিয়ে ভাগাভাগি হলো। গ্রামের বড়ো বাড়ির হাই ভাই (জনৈক আবুল কালাম মাদবরের ভাতিজা) ছিলেন মোতালেব মামার ‘দোস্ত’। হাই ভাই’র একটা ছোটোবোন ছিল, যার নাম আরজুদা (আরজুদা পরে আমাদের ক্লাসমেট ছিল। আমাদের এক বড়ো ভাই, মাদবর বাড়ির সুরুজ ভাইয়ের সাথে তার বিয়ে হয়)। সিদ্ধান্ত হলো, অর্ধেক রাস্তায় পালকিতে চড়বে আরজুদা, বাকি অর্ধেক রাস্তায় চড়বো আমি। তবে, আমি প্রথম অর্ধেকে চড়েছিলাম, নাকি পরের অর্ধেকে, সেটা ভুলে গেছি।
ছোটোবেলায় মোতালেব মামার বিয়েটাই আমার সবচাইতে স্মরণীয় বিয়ে অনুষ্ঠান ছিল, যেটিতে আমি খুব আনন্দ করেছিলাম। এই বিয়েতেই আমি প্রথম জানতে বা বুঝতে পেরেছিলাম যে, মেয়েরা বিয়ের দিন বাপের বাড়ি ছেড়ে আসার সময় খুব কান্নাকাটি করে। মামিদের বাড়িতে চলন পৌঁছবার একটু পর থেকেই মামির কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। প্রথমে অল্পস্বরে, এরপর প্রায় গলা ফাটিয়ে কাঁদছিলেন মামি। প্রায় ৩ মাইল রাস্তা পালকিতে আসার সময় পুরোটাই মামি কান্না করছিলেন। একটা কথা উল্লেখ করতে হয়, মামি অনেক সুন্দরী ছিলেন।
পালকিতে চড়ার সময় আমার বয়স কিন্তু খুব কম ছিল, তখনো বোধহয় স্কুলে যাওয়াই শুরু করি নি। কিন্তু ঐ ছোট্ট সময়টাই খুব মধুর ছিল, সবাই খুব আদর করতো, পালকিতে চড়াত আমি কৃতজ্ঞ ঐ মামাদের কাছে (তিন ভাই - মনা মৃধা, মরণ মৃধা আর মোতালেব মৃধা, বাবা – দৌলত মৃধা), যারা আমার বাবাকেও অনেক শ্রদ্ধা করতেন ও ভালোবাসতেন (আমার বাবা বড়ো জামাই হওয়ার কারণে শ্বশুর বাড়িতে তার একটা আলাদা স্থান ও মর্যাদা ছিল)। তাদের ভালোবাসার কারণেই তাদের বিয়ের পালকিতে আমাকে সঙ্গে চড়িয়েছিলেন।
মরণ মামা মারা গেছেন অনেক বছর হলো – ১৯৯৬/৯৭ সালের দিকে। বাকি দুই মামা এবং মামিরা এখনো জীবিত আছেন আল্লাহর রহমতে। বাড়িতে গেলে সবার সাথেই দেখা-সাক্ষাৎ হয়। আড্ডায় বসলে আমার পালকিতে চড়ার কথাটাও যে চলে আসে, তা বলাই বাহুল্য। আল্লাহ যেন তাদের দীর্ঘায়ু দান করেন ও সুস্থ রাখেন, এই দোয়া করি।
১১ আগস্ট ২০২০
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ৯:১৩