আঠার বছর বয়স,
কিংবা যে বয়সে যুদ্ধে নামে যুবকেরা, আমার তা ছিল না একাত্তরে
আমার ছিল
রঙিন ঢাউস, ডুবসাঁতার, গেছোমেছো, চড়ুইভাতি আর বেতজঙ্গলে
ঘোড়াঘাপটি খেলা দুরন্ত দুপুর
আমার ছিল
বাবার কাঁধে চড়ে পৌষসংক্রান্তিতে নূরপুরের মাঠে তুমুল ঘোড়দৌড় দেখা
আমার ছিল
শীতের ধামাইল, শানাল ফকিরের ওরস, না-বোঝা জারিসারি গান রাতভর
আমার একটা বিশাল যুদ্ধদল ছিল, অঙ্গুলি দর্শনে
আলের পর আল মাড়িয়ে ওরা ছুটে আসতো মাষকলাই পোড়ানোর মাঠে;
আমার যুদ্ধদল -চোখের ইশারায় পরনের গামছা
কিংবা লুঙ্গি একটানে ছুঁড়ে ফেলে দল্লে গাছের শাখা হতে ঝাঁকে ঝাঁকে
দিগম্বর লাফিয়ে পড়তো খালের পানিতে;
আমার যোদ্ধারা অমায়িক আর খুব বিশ্বস্ত ও বাধ্যগত ছিল; আমার অধীনে
আমার আড়িয়াল বিল ছিল,
বাহারি কচুরি ফুল, কার্তিকের ভোরে ঠেলাজালে চিংড়িপোনা
টেংরাপুঁটি আর টাটকিনির খলবলানিতে সকাল-দুপুর মত্তবেলা
আমার ভেলানৌকো ছিল, আর বাবার ছিল ছোট্ট ডিঙিনৌকো।
অনেক দুপুর সাঙ্গপাঙ্গদের লয়ে ভান করে ঘুমিয়েছি ভেলা
আর নৌকোর পাটাতনে।
আমাদের জলমান আমনক্ষেতে ভেসে থাকা লাশগুলো
কলার ভেলা আর ডিঙিনৌকোয় ঠেলে প্রতিদিন স্রোতের পানিতে
ভাসিয়ে দিতেন বাবা।
বাবার চোখ ছিল রুক্ষ ও অস্থির; আমি তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী ছিলাম।
আমার চাচা গ্রাম ছেড়ে চলে গেলেন। আমার চাচি কাঁদেন।
আমার দাদি কাঁদেন।
আমার বাবা ও চাচাতো ভাইবোনেরা কাঁদেন।
চাচা আমাকে কত্ত আদর করতেন; চাচাকে না পেয়ে আমিও কাঁদতাম;
কতদিন গোপনে।
আমার চাচা যেদিন যুদ্ধ থেকে ফিরে এলেন
১৬ ডিসেম্বরের পর কোনো এক উজ্জ্বল সায়াহ্নে-কী ভীষণ কান্নার রোল,
আর হৈচৈ- চাচা আর বেঁচে নেই, এই ভেবে কত আগে আমরা মনকে পাষাণ করেছিলাম।
চাচার গল্পমুখর সন্ধ্যা ছিল; আমার ছিল অবিরাম আক্ষেপচাচার মতো
যুদ্ধ না করতে পারার দুঃখ
আমার একটা গান ছিল, সমগ্র কৈশোরে প্রথম বোধন-
‘চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি’
আমার একটা পতাকা ছিল- কাড়ালের মাথায় প্রিয়সঙ্গী গামছাটি বেঁধে
ভোঁ ভোঁ উড়িয়েছিলাম উড়ন্ত মিছিলের পথে, টগবগে ময়দানে
এসব আমি কিছুই বুঝি নি কোনোদিন;
শুধু টের পেতাম, বুকের ভেতর ক্রমশ গজিয়ে উঠছে অনিবার্য ঘাস,
সবুজ সবুজ কচি পাতা; স্বপ্নের মতো তুলতুলে বাংলাদেশ
২২ অক্টোবর ২০০৯
১৯৭১ - অস্পষ্ট স্মৃতি থেকে